বাঘের সংখ্যা বেড়েছে। এটি নিঃসন্দেহে এক ধরনের আশার বার্তা। কিন্তু সুন্দরবনের গভীরে যাদের প্রতিদিন যাওয়া হয়, যারা বনের ভেতর মাছ ধরেন, মধু সংগ্রহ করেন কিংবা গাছের পাতা কেটে আনেন; তারা কি বাঘকে আগের মতো ভয় পান! নাকি ভয়টা এখন অন্যকিছু? এ প্রশ্নটা এখন খুব জরুরি। বিশেষ করে যখন ‘বিশ্ব বাঘ দিবসে’ বলে উঠি ‘বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি, সুন্দরবনের সমৃদ্ধি’।
নতুন জরিপ বলছে, বর্তমানে বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা ১২৫টি। এর আগে ২০১৫ সালে ছিল ১০৬টি। এ বৃদ্ধিকে স্বাগত জানানো যেতেই পারে। কিন্তু ২০০৪ সালের জরিপে বাঘের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪৪০টি। বন ছিল গাঢ়, নিস্তব্ধতায় টানটান, বাঘ ছিল নীরব পাহারাদার। ২০০৯ সালেও বলা হয়েছিল, সুন্দরবনে ৪০০ থেকে ৪৫০টি বাঘ আছে। বাঘেরা আজ আগের মতো বনে নেই। না সংখ্যায়, না উপস্থিতির ছায়ায়।
২০১৫ সালের শুমারিতে বাঘ নেমে এসেছে ১০৬টিতে। এরপর ২০১৮ সালে জরিপে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ১১৪টিতে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের মার্চে শেষ হওয়া ক্যামেরা ট্র্যাপ জরিপে দেখা গেছে, বর্তমানে বাঘের সংখ্যা ১২৫টি। এ জরিপ চালাতে ৩১৮ দিন লেগেছে। বসানো হয়েছিল ১ হাজার ২১০টি ক্যামেরা। খরচ হয়েছে ৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা। ছবির সংখ্যা ১০ লাখের বেশি। যার মধ্যে ৭ হাজার ২৯৭টি বাঘের ছবি। এসব পরিসংখ্যান নিঃসন্দেহে কঠোর পরিশ্রমের ফল। সংখ্যার এ উল্লম্ফন কি প্রকৃতপক্ষে সুন্দরবনের নিরাপত্তা কিংবা বাঘের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে?
আরও পড়ুন গাছের নাম হাজার সন্তানের জননী বর্ষাকালই উপযুক্ত সময় বৃক্ষরোপণেরবাঘের ভয় এখন একমাত্র ভয় নয়। বনজীবীরা তা খুব ভালো বুঝতে পারেন। এখন তারা প্রতিনিয়ত বয়ে বেড়ান চোরা শিকারী ও বনদস্যুদের ভয়। যারা বনের গভীরে আগে থেকে ফাঁদ পেতে রাখেন, যারা বনের চেনা মানুষদের চেয়েও বেশি জানেন কোন পথে বাঘ হেঁটে যায়, কোথায় গেলে শিকার পাওয়া যাবে। হয়তো অনেক সময় বাঘের অবস্থান শনাক্ত করতে যে ক্যামেরা বসানো হয়; সেই ক্যামেরার স্থান আগেই চিহ্নিত করে নেয় অপরাধী চক্র! বাঘের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, বিশেষ করে চামড়া, দাঁত, হাড় আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি হয় কোটি টাকায়। ফলে সুন্দরবনে এখন যে ভয়; তা আসলে মানুষে মানুষে।
এ ভয় বাইরের কেউ টের পান না। নদী পেরিয়ে বনের গভীরে যেসব মানুষ পেশাগত বা জীবিকার জন্য প্রবেশ করেন, তাদের কাছে এখন বাঘ নয়; মানুষের হাতেই প্রাণ বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা বেশি। যারা বনের অভ্যন্তরে শিকারে আসেন, তাদের হাতে আধুনিক অস্ত্র, তথ্যভিত্তিক মানচিত্র ও ছদ্মবেশ থাকে। অনেক সময় ক্যামেরা ট্র্যাপ বসানোর আগেই চিহ্নিত হয়ে যায় জায়গাগুলো। ফলে বনরক্ষীদের প্রযুক্তির চেয়েও এক ধাপ এগিয়ে অপরাধীরা। কেউ ধরা পড়েন, কেউ ধরা পড়েন না। বনের গহীনে পাতা ফাঁদে বাঘের মৃত্যু হয় নীরবে। বনজীবীরা জানেন, মুখ খুললে ক্ষতি হতে পারে! এ নীরবতার ভয়ই আজ সবচেয়ে ভয়ংকর।
বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধিতে আমাদের গর্ব হতে পারে কিন্তু গর্ব তখনই অর্থবহ হয়; যখন এ সংখ্যা নিরাপদ থাকে। যেদিন বনজীবীরা নিশ্চিত হবেন ‘বাঘ আছে, তবু ভয় নেই’। চোরা শিকারীরা বুঝে যাবেন, অপরাধ করলে ধরা পড়বেন এবং শাস্তি এড়ানোর কোনো পথ নেই। সেদিনই বাঘের সংখ্যা বাড়ার সার্থকতা আসবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমরা এখনো সেই নিরাপত্তা দিতে পারিনি। বাঘ সংখ্যা বাড়ছে ঠিকই কিন্তু তাদের জন্য বন নিরাপদ নয়।
এসইউ/জিকেএস