আমাদের তরুণ প্রজন্মের চোখে আমরা আগ্রহ আর অনিশ্চয়তার এক অদ্ভুত মিশেল দেখেছি। কিছুক্ষণের জন্য একটি সাধারণ রোবট দেখেই তারা মুগ্ধ হয়ে যায়, কিন্তু পরক্ষণেই তাদের সহজ-সরল প্রশ্নটি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার গভীর সংকটকে উন্মোচন করে দেয় "স্যার, এটা থেকে আমরা কী পাই?" এই একটি বাক্যই বলে দেয়, আগ্রহ থাকলেও আমাদের শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তিকে জীবিকার সাথে মেলাতে পারছে না। তাদের মধ্যে অনেকেরই দারুণ মেধা আছে, কিন্তু তাদের সামনে সুযোগ ও সঠিক দিকনির্দেশনার অভাব। এই অভিজ্ঞতা থেকেই আমার মনে হয়েছে, প্রযুক্তিকে অবহেলা করাটা আমাদের জন্য একটি আত্মঘাতী পদক্ষেপ হতে পারে।
বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তি এমন দ্রুত গতিতে পরিবর্তিত হচ্ছে যে এর প্রভাব আমাদের দৈনন্দিন জীবন, চাকরির বাজার, এমনকি নাগরিক অধিকারকেও প্রভাবিত করছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এখন আর কেবল বিশেষজ্ঞদের গবেষণাগারে সীমাবদ্ধ নয়। এটি ব্যাংকিংয়ে ঝুঁকির হিসাব, হাসপাতালে রোগ নির্ণয়, কিংবা ছোটো উদ্যোক্তাদের বাজারে পৌঁছানোর উপায় সবকিছুতেই এক অপরিহার্য অংশ। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যদি এই পরিবর্তনকে ধরতে না পারে, তাহলে আমরা প্রযুক্তির ভোক্তা হয়েই থাকব, যা কখনোই একটি টেকসই ভবিষ্যৎ নয়। আসলে, এই 'পরিবর্তন' মানে কেবল নতুন কোর্স বা আধুনিক ল্যাব তৈরি করা নয়। এর মূল অর্থ হলো শিক্ষকের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো, শিক্ষার পদ্ধতি পরিবর্তন করা এবং স্কুল, সমাজ, শিল্প ও উদ্যোগ এই সবকিছুর মধ্যে একটি সমন্বয় তৈরি করা। আর এই সমন্বয়ই আমাদের এখনও অধরা।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) আর ভবিষ্যতের কোনো কল্পবিজ্ঞান নয়। এটি ইতোমধ্যেই বৈশ্বিক অর্থনীতি, কর্মসংস্থান এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিযোগিতার কেন্দ্রে রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং ইউরোপের মতো দেশগুলো ইতোমধ্যেই বুঝে গেছে, এআই-চালিত যুগে টিকে থাকতে হলে শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন অপরিহার্য। তারা প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পাঠ্যক্রমে AI, মেশিন লার্নিং, ডেটা সায়েন্স, রোবোটিক্স, সাইবার নিরাপত্তা, ব্লকচেইন, থ্রিডি প্রিন্টিং ও ডিজিটাল নৈতিকতা অন্তর্ভুক্ত করেছে। শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিল্প-অ্যাকাডেমি অংশীদারিত্ব এবং সমান প্রযুক্তি প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, যাতে শিক্ষার্থীরা উদ্ভাবন এবং উচ্চ প্রযুক্তিগত কর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা করার জন্য প্রস্তুত হয়।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি: সম্ভাবনা আছে, কিন্তু সমস্যাও আছেআমাদের দেশে আগ্রহ ও উদ্ভাবনী শক্তির কোনো অভাব নেই। কয়েকটি উদাহরণ দেখলেই তা স্পষ্ট হয়:
এই সমস্ত বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ প্রমাণ করে যে আমাদের মধ্যে মেধা ও উদ্ভাবনী শক্তি বিদ্যমান। কিন্তু সমস্যা হলো, এই সম্ভাবনাগুলোকে একটি জাতীয় কৌশল হিসেবে ছড়িয়ে দেওয়া যায়নি। অর্থাৎ, আমাদের সম্ভাবনা আছে, কিন্তু তা দুর্বল অবকাঠামো আর সুসংগঠিত পরিকল্পনার অভাবে ঠিকভাবে বিকশিত হচ্ছে না। এটি একই মুদ্রার দুই পিঠ: একজন গ্রামীন শিক্ষক আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে চাইলেও তার স্কুলে ইন্টারনেট নেই, আবার একজন তরুণ উদ্যোক্তা দক্ষ কর্মী খুঁজে পাচ্ছে না।
বৈশ্বিক তুলনা: আমরা কোথায়?ক্ষেত্র
যুক্তরাষ্ট্র
চীন
ইউরোপ
বাংলাদেশ
পাঠ্যক্রম
প্রাথমিক থেকে কোডিং ও AI
সর্বস্তরে AI ও STEM বিনিয়োগ
ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষা, AI নৈতিকতা
মুখস্থ নির্ভর; AI অন্তর্ভুক্ত নয়
শিক্ষক প্রশিক্ষণ
ধারাবাহিক উন্নয়ন
জাতীয় পর্যায়ের পুনঃপ্রশিক্ষণ
EU-সমর্থিত কর্মসূচি
বিচ্ছিন্ন ও সীমিত
শিল্প-অ্যাকাডেমি সংযোগ
গবেষণা ও ইন্টার্নশিপ
ইনোভেশন হাব
শিল্প-অংশীদারিত্ব
দুর্বল সংযোগ
প্রযুক্তি প্রবেশাধিকার
সর্বজনীন
ব্যাপক অবকাঠামো বিনিয়োগ
সমান সুযোগ নিশ্চিতকরণ
বৈষম্যমূলক প্রবেশাধিকার
দক্ষতা
সমালোচনামূলক চিন্তা, সৃজনশীলতা
উদ্ভাবন, উদ্যোগ
আন্তঃবিষয়ক সমস্যা সমাধান
মুখস্থ নির্ভরতা
চাকরিযোগ্যতা
আজীবন শিক্ষার কাঠামো
হাইটেক খাত প্রশিক্ষণ
আজীবন শিক্ষা সংস্কৃতি
উচ্চ বেকারত্ব ও দক্ষতার অমিল
উদীয়মান চাকরির বাজার বনাম আমাদের প্রস্তুতিচাকরির ক্ষেত্র
প্রয়োজনীয় দক্ষতা
বাংলাদেশের অবস্থা
এআই ইঞ্জিনিয়ার
কোডিং, ডেটা মডেলিং
সীমিত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত
ডেটা সায়েন্টিস্ট
পরিসংখ্যান, ভিজ্যুয়ালাইজেশন
তাত্ত্বিক জ্ঞান সীমিত
রোবোটিক্স ইঞ্জিনিয়ার
প্রোগ্রামিং, সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন
প্রায় অনুপস্থিত
ডিজিটাল হেলথ স্পেশালিস্ট
বায়োইনফরমেটিক্স, AI বিশ্লেষণ
হাতে গোনা কিছু
এআই নৈতিকতা উপদেষ্টা
সামাজিক ও নৈতিক প্রভাব বোঝা
কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই
সাইবার নিরাপত্তা বিশ্লেষক
AI-চালিত প্রতিরক্ষা ও সনাক্তকরণ
সীমিত সুযোগ
অটোমেশন ও IoT বিশেষজ্ঞ
IoT ডিজাইন, অটোমেশন ইন্টিগ্রেশন
প্রায় অনুপস্থিত
সৃজনশীল AI ভূমিকা
মাল্টিমিডিয়া, AI-সহায়ক ডিজাইন
অবহেলিত ক্ষেত্র
AI প্রোডাক্ট ম্যানেজার
প্রযুক্তি-বাণিজ্য সমন্বয়
দুর্বল
কোয়ান্টাম গবেষক
কোয়ান্টাম তত্ত্ব, AI অ্যালগরিদম
অনুপস্থিত
প্রশ্নটা এখন আর কোনো তত্ত্বীয় নয় আমরা কি দর্শকের আসনে বসে থাকব, নাকি মাঠে নেমে খেলার গতিপথ বদলে দেব? এই সিদ্ধান্ত এখনই নিতে হবে। বাংলাদেশ সংকটাপন্ন মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। তরুণ প্রজন্ম আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ, কিন্তু দক্ষতায় রূপান্তরিত না হলে তা সম্ভাবনাহীন হয়ে যাবে। শিক্ষা সংস্কার ছাড়া বাংলাদেশ এআই-চালিত বৈশ্বিক অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতা করতে পারবে না। নীতিনির্ধারকদের আজকের সিদ্ধান্ত আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। সাহসী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি-কারণ AI বিপ্লব অপেক্ষা করে না।
বাংলাদেশকে এখনই যা করতে হবেনীতিনির্ধারক ও শিক্ষা পরিকল্পনাবিদদের জন্য সুপারিশ:
পাঠ্যক্রম পুনর্বিন্যাস – সকল শিক্ষা স্তরে AI, মেশিন লার্নিং, ডেটা সায়েন্স, রোবোটিক্স, থ্রিডি প্রিন্টিং, ব্লকচেইন, সাইবার নিরাপত্তা, জৈবপ্রযুক্তি ও মানব-যন্ত্র ইন্টারফেস অন্তর্ভুক্ত করা। শিক্ষক প্রশিক্ষণকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া – জাতীয় পর্যায়ে পুনঃপ্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা। প্রযুক্তিতে সমান প্রবেশাধিকার – দেশব্যাপী ডিজিটাল অবকাঠামো ও AI প্ল্যাটফর্মের প্রাপ্যতা উন্নত করা। শিল্প সহযোগিতা – ইন্টার্নশিপ, পরামর্শদান ও হাতে-কলমে শেখার প্রকল্পের জন্য বেসরকারি খাতের সাথে শক্তিশালী অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা। ভবিষ্যতের দক্ষতায় জোর দেওয়া – সৃজনশীলতা, সমালোচনামূলক চিন্তা, AI নীতিশাস্ত্র এবং আন্তঃবিষয়ক সমস্যা সমাধানকে শিক্ষার মূল লক্ষ্য করা। আজীবন শিক্ষার কাঠামো গড়ে তোলা – কর্মজীবনের প্রতিটি ধাপে দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ নিশ্চিত করা।বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ: কী করা দরকার?
ধাপ ১: প্রাথমিক ১-২ বছর (কোর-অ্যাকশন)
২০-৫০টি সরকারি স্কুলে 'ডিজিটাল-হাব' স্থাপন ১০,০০০ শিক্ষককে ৬-১২ মাসের প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয় ও স্টার্টআপ অংশীদারিত্বে 'ইন্টার্ন প্ল্যাটফর্ম' চালুধাপ ২: মাঝারি-মেয়াদী ৩-৫ বছর
পাঠ্যক্রম সংস্কার গ্রামে কমিউনিটি টেক-সেন্টার গড়ে তোলা গবেষণা ও স্টার্টআপ ফান্ড তৈরিধাপ ৩: দীর্ঘমেয়াদী ৫-১০ বছর
জাতীয় AI রোডম্যাপ তৈরি AI নৈতিকতা পরামর্শক বোর্ড গঠন আজীবন শিক্ষার ইকোসিস্টেম গড়ে তোলাঅর্থায়ন ও বিনিয়োগ: বাস্তব পথ খোঁজা
এই বিশাল পরিকল্পনার জন্য অর্থায়ন অপরিহার্য। তবে এটি কেবল বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভর করে সম্ভব নয়; আমাদের নিজেদের ভেতর থেকেও টেকসই অর্থের পথ বের করতে হবে। প্রথমত, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (PPP)-এর মাধ্যমে দেশীয় প্রযুক্তি কোম্পানি, মোবাইল অপারেটর, ব্যাংক এবং করপোরেট হাউসগুলোকে যুক্ত করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক তহবিল যেমন বিশ্বব্যাংক, ADB, UNESCO বা UNICEF-এর শিক্ষা প্রকল্প থেকে অর্থ সংগ্রহ করা। তৃতীয়ত, স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমে বিনিয়োগ ভেঞ্চার ফান্ড, অ্যাঞ্জেল নেটওয়ার্ক বা ক্রাউডফান্ডিং প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে। চতুর্থত, সরকারের পক্ষ থেকে একটি “ন্যাশনাল এডুকেশন টেক ফান্ড” তৈরি করা যেতে পারে। সবশেষে, প্রবাসী বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণও বাড়ানো দরকার অর্থ, জ্ঞান ও নেটওয়ার্ক দিয়ে।
ঝুঁকি ও নীতিগত সতর্কতা: আশার পাশাপাশি শঙ্কাও বাস্তবপ্রযুক্তি নিয়ে আশাবাদী হওয়া জরুরি, তবে ঝুঁকি অবহেলা করা মানে নিজের ভবিষ্যৎকে ঝুঁকিতে ফেলা।
ডেটা নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা: সঠিক নীতি না থাকলে অপব্যবহার ও বৈষম্যের ঝুঁকি। বিদেশি প্ল্যাটফর্মে অতিরিক্ত নির্ভরতা: প্রযুক্তিগত স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে। কৌশলগত ভুলের ঝুঁকি: শুধু কোর্স যোগ করা যথেষ্ট নয়, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও বাস্তবভিত্তিক শিক্ষার প্রয়োজন। শহর-গ্রামের বৈষম্য: সুযোগ বৈষম্য বাড়লে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। নৈতিকতা ও সামাজিক প্রভাব: চাকরি হারানো, ভুয়া তথ্য, বৈষম্য এসব মোকাবিলা করতে হবে ভারসাম্যের মাধ্যমে।একটি সাহসী পদক্ষেপের আহ্বান
বাংলাদেশ এখন এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের হাতে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়, উদ্ভাবনী স্টার্টআপ, এবং এক বিশাল কর্মঠ তরুণ জনগোষ্ঠী। এই সম্পদগুলোকে যদি একটি সুসংহত জাতীয় কৌশলে যুক্ত করা যায়, তবে আমরা দ্রুতই দারুণ সাফল্য পেতে পারি। তবে এটি কেবল একটি 'প্রকল্প' নয়, এটি একটি জাতীয় রূপান্তর। এর জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছা, শিক্ষা বিভাগ, শিল্প এবং সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
প্রশ্নটা এখন আর কোনো তত্ত্বীয় নয় আমরা কি দর্শকের আসনে বসে থাকব, নাকি মাঠে নেমে খেলার গতিপথ বদলে দেব? এই সিদ্ধান্ত এখনই নিতে হবে। বাংলাদেশ সংকটাপন্ন মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। তরুণ প্রজন্ম আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ, কিন্তু দক্ষতায় রূপান্তরিত না হলে তা সম্ভাবনাহীন হয়ে যাবে। শিক্ষা সংস্কার ছাড়া বাংলাদেশ এআই-চালিত বৈশ্বিক অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতা করতে পারবে না। নীতিনির্ধারকদের আজকের সিদ্ধান্ত আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। সাহসী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি-কারণ AI বিপ্লব অপেক্ষা করে না।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, গণিত ও পদার্থবিদ্যা বিভাগ, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি।
এইচআর/জেআইএম