ভ্রমণ

৬০০ বছরের পুরাকীর্তি ধানুকা মনসাবাড়ির মন্দির

পুরাতন ভবনগুলোতে লেগে আছে সুলতানি ও মুঘল আমলের নির্মাণশৈলীর ছাপ। যা জানান দিচ্ছে অন্তত ছয়শ বছরের পুরাকীর্তির অস্তিত্ব। এমনই এক দর্শনীয় ও ঐতিহাসিক স্থান শরীয়তপুরের ধানুকা মনসাবাড়ি ও মন্দির। এটি শুধু এই জেলায় নয়, পুরো ভারত উপমহাদেশের এক কালের স্বাক্ষীও বটে। কেননা একসময় এ মন্দিরের পূজোকে ঘিরে আগমন ঘটতো ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের হিন্দু ধর্মের লোকদের। তবে কালের বিবর্তনে মন্দির ও বাকি ভবনগুলো এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। স্থানীয়রা বলছেন, প্রশাসন পদক্ষেপ নিলে ইতিহাস বহন করা মন্দিরটি টিকে থাকবে যুগের পর যুগ।

স্থানীয় ও ঐতিহাসিক তথ্য অনুসন্ধানবিদরা জানান, শরীয়তপুর পৌরসভার ধানুকা এলাকায় মন্দিরটির অবস্থান। একসময় এলাকাটি ছিল জলমগ্ন, যে কারণে এর নাম ধানুকা। ধারণা করা হয়, ১৩০০ শতাব্দীতে এ অঞ্চলে বসতি গড়েন ভারতের কৌনজ থেকে আসা কৃষ্ণনন পঞ্চানন ভট্টাচার্য নামের এক ব্যক্তি। মূলত তারা ছিলেন শিক্ষা ও অর্থবিত্তে সমৃদ্ধ একটি পরিবার। তিনি ধীরে ধীরে জলমগ্ন জায়গাটিকে বসবাসের উপযোগী করতে পুকুর খনন করে মাটি ভরাট করেন। এ পরিবারের সদস্য ময়ূর ভট্ট। মূলত তার সময়ে এসে ১৪০০ শতাব্দীতে এখানে নির্মাণ করা হয় মনসা মন্দির। পরে লোকজন এটি ভট্টাচার্য বাড়ির চেয়ে মনসাবাড়ি বলেই ডাকতেন।

সেসময়ে এ অঞ্চলের মধ্যে এ বাড়িতেই মনসার পূজা হতো। পূজায় অংশ নিতে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে হিন্দু ধর্মের লোকদের আগমন ঘটতো। এ ছাড়া বাড়িতে সংস্কৃত শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে একটি টোল খোলা হয়। এ টোলে শিক্ষাগ্রহণের জন্য ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষের আনাগোনা বাড়তে থাকে। পরে সুলতানি ও মুঘল আমলের নির্মাণশৈলীতে এ বাড়িতে পাঁচটি ইমারত নির্মাণ করা হয়। যার মধ্যে আছে মনসা মন্দির, দুর্গা মন্দির, সংস্কৃত টোল বা পাঠাগার, নহবতখানা ও আবাসিক ভবন।

একসময় মনসাবাড়ি ও আশপাশে অনেক মূল্যবান জিনিসপত্র ছিল, যা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চুরি ও নষ্ট হয়ে যায়। ১৯৭৯ সালে শরীয়তপুরের প্রথম মহকুমা প্রশাসক আমিনুর রহমানের নেতৃত্বে মনসাবাড়িটির সংস্কারকাজ শুরু হয়। তবে দক্ষ জনবলের অভাবসহ নানা জটিলতায় সংস্কারকাজ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আর মন্দিরটিতে সংস্কার করা হয়নি। ফলে ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে পুরাকীর্তিটি।

আরও পড়ুন৭০০ বছরের ঐতিহ্য ও পুরাকীর্তির অনন্য নিদর্শন ক্ষুদ্রঋণে টিকে আছে ফুলগাজীর ঐতিহাসিক গান্ধী আশ্রম 

স্থানীয় সাইফুল ইসলাম আকাশ বলেন, ‘আমাদের বাড়ির পাশেই মনসাবাড়ি। ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি এবং বড়দের কাছে শুনেছি এ বাড়ির ইতিহাস। মাঝেমধ্যেই দূর-দূরান্তের অনেক লোক মন্দিরটি দেখতে আসেন। আমরা চাই প্রাচীন এ ঐতিহাসিক মন্দির ও আশপাশের ভবনগুলো রক্ষা করা হোক। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ যদি এখানে সংস্কারকাজ পরিচালনা করে, তাহলে ঐতিহ্যের নিদর্শনটি টিকে থাকতো বছরের পর বছর।’

ধানুকা মনসাবাড়ির মন্দির পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক গোবিন্দ চক্রবর্তী বলেন, ‘ইতিহাস বহন করা কালের নিদর্শন এ মনসামন্দির। এখানে অনেক লোকজন ঘুরতে আসেন। তবে এটি এখন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে অবগত করেছি। যদি এ বাড়ি এবং এখানকার নিদর্শন রক্ষায় সরকারিভাবে পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তাহলে এটি হারিয়ে যাবে। আমরা চাই, এটি পুরোপুরি নষ্টের আগে সরকার যেন পদক্ষেপ নেয়।’

শরীয়তপুরের ঐতিহাসিক তথ্য অনুসন্ধানবিদ শ্যামসুন্দর দেবনাথ বলেন, ‘মনসাবাড়িটি অন্তত ছয়শ বছর আগে তৈরি হয়েছিল। এখনো এটি কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িটি শুধু বাংলাদেশের নয়, ভারত উপমহাদেশের নিদর্শন। দিন দিন অযত্ন আর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এটি নষ্ট প্রায়। আমরা চাই, ঐতিহাসিক স্থানটি সংরক্ষণ করে পর্যটকদের কাছে তুলে ধরা হোক।’

সংরক্ষণের ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক তাহসিনা বেগম বলেন, ‘আমরা খোঁজ-খবর নেবো। তাছাড়া এটি যেহেতু একটি ঐতিহাসিক স্থান, তাই সংস্কারে উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। পাশাপাশি মন্দির কমিটির সাথে কথা বলে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এসইউ/জিকেএস