মুহাম্মাদ রাহাতুল ইসলাম
রাতের অন্ধকার ভেদ করে আমরা রওয়ানা দিয়েছিলাম সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের পথে। শহরের আলো আর কোলাহল দূরে ফেলে, পথে চলতে চলতে শুধু মনে হচ্ছিল—প্রকৃতির এক অদৃশ্য আমন্ত্রণ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা এই ভ্রমণে ছিলাম একটি ছোট টিমের সঙ্গে। সবাই একে অপরকে খুব ভালোভাবে চিনি না, অথচ রাতের যাত্রা শুরু হতেই যেন অপরিচিতর বদ্ধমূলতা দূরে সরে গেল। অপরিচিত হলেও আমরা সহজেই একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হয়ে গেলাম, গল্প করতে করতে, হাসি-মজা ভাগাভাগি করতে করতে এক নতুন বন্ধুত্বের সূচনা হলো।
ভোরের দিকে পৌঁছালে দেখা মিললো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির। মৃদু বর্ষণে ভিজে থাকা পথ আর পাহাড়ের ছায়া যেন স্বাগত জানাচ্ছিল আমাদের। বৃষ্টির সঙ্গে মাটির গন্ধ মিশে মনকে শান্তি দিচ্ছিল আর মনে হচ্ছিল, এক নতুন দিন প্রকৃতির কাছে যেন ভিন্ন রকম উপহার নিয়ে এসেছে। হালকা কুয়াশা আর শীতল বাতাস মনে করাচ্ছিল, প্রতিটি মুহূর্তই উপভোগ করা উচিত।
নৌকাভ্রমণে হাওরের বিস্তারবৃষ্টি থাকতে থাকতেই আমরা নৌকায় চড়ে হাওরের দিকে এগোলাম। জলরাশির মধ্য দিয়ে ভেসে যেতে যেতে চারপাশে ছড়িয়ে থাকা সবুজ টিলা আর নীলিমার দৃশ্য চোখে যেন সোনার ফ্রেমে বন্দি হয়ে গেল। নৌকার ছাদের ওপর বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে আর ধীর স্রোতের সাথে নৌকা দুলছে—মুহূর্তগুলো যেন স্থির হয়ে গেছে হৃদয়ে।
টাঙ্গুয়ার হাওরের অবারিত জলরাশি, পাখির কলরব, পাহাড়ের ছায়া এবং হাওরের শান্ত ঢেউ—সব মিলেমিশে এক নির্জন সুর তৈরি করেছে। আমরা নৌকার ধীর ছন্দে ভেসে যাচ্ছিলাম, চারপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে সময়ের হিসাব ভুলে গিয়েছিলাম তখন। হাওরে বসবাসকারীরা সবে ঘুম থেকে উঠেছেন আর জেলেরা মাছ ধরছিলেন। তাদের সাধারণ জীবনযাত্রা ও প্রকৃতির সঙ্গে মিলে যাওয়া দেখে বোঝা যায়, কেমন করে মানুষ ও প্রকৃতি একে অপরের সঙ্গে সহমিলনে বেঁচে আছে। আমরা টিমের সঙ্গে মিলে এই মুহূর্তগুলো উপভোগ করছিলাম, একে অপরের অভিজ্ঞতা শোনাচ্ছিলাম এবং হাসিমুখে মুহূর্তগুলো ভাগাভাগি করছিলাম।
নীলাদ্রি লেকের নীলাভ স্বপ্নপরবর্তী গন্তব্য ছিল নীলাদ্রি লেক। লেকের পানি এত নীল, মনে হচ্ছিল আকাশ নেমে এসেছে পানির বুকে। বিকেলের আলো নেমে আসার আগে লেকের পার্শ্বে বসে আমরা প্রকৃতির নিখাদ সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। লেকের নীরবতা, পানির মৃদু ঢেউ আর পাহাড়ের ছায়ার মিলন এক অমোঘ অনুভূতি তৈরি করেছিল। আমরা নীরবে বসে প্রকৃতির এই নিখাদ সংগীত শুনলাম—হাওরের ঢেউ, পাখির ডাক, বাতাসে ভেসে আসা পানির হালকা ফোঁটার শব্দ সব মিলিয়ে যেন এক একক ছন্দে পরিণত হয়। টিমের সবাই একে অপরের সঙ্গে চুপচাপ বসে এই সৌন্দর্য উপভোগ করছিলেন।
আরও পড়ুনসিলেটের মনোমুগ্ধকর পরিবেশে ভ্রমণভোলাগঞ্জের সাদা পাথরে যা দেখলাম
পাহাড়, গ্রাম ও সীমান্তের রূপহাওরের পর আমরা গিয়েছিলাম বারেক টিলা এবং হাওরের পাশের ছোট নদী দেখতে। পাহাড়ের ছায়া, সীমান্তের নীরবতা, গ্রামের মানুষের অতিথিপরায়ণতা—সবই ভ্রমণকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। ছোট ছোট কুঁড়েঘর, মাটির রাস্তা, শিশুর খেলাধুলা—সব মিলিয়ে যেন একটি শান্ত গ্রামীণ কবিতার অংশ। পাহাড় থেকে নেমে আসা সৌন্দর্য ও পুরো হাওরের বিস্তৃতি জলরাশি একসাথে চোখে পড়ে। আকাশ আর জল একাকার করে মনে হয় প্রকৃতি নিজেই আঁকছে এক বিশাল ক্যানভাস। আমরা টিমের সঙ্গে মিলেমিশে এই দৃশ্যগুলো উপভোগ করছিলাম, ছবি তুলছিলাম, একে অপরের সঙ্গে মুহূর্তগুলো ভাগাভাগি করছিলাম।
যাদুকাটা নদীর নীরবতাএক মুহূর্তের জন্য যদি চোখ বন্ধ করি, মনে পড়ে যায় যাদুকাটা নদীর নীরব প্রবাহের কথা। নদীর নীল জলে ভেসে থাকা নৌকা, দুই পারের সবুজ টিলা আর হালকা বাতাসে নাচতে থাকা ঝলমলে ঢেউ—সব মিলিয়ে যেন এক শান্ত, স্বপ্নীল গল্প বলে যাচ্ছে। এই নদীর সঙ্গে পথ চলা, ভেসে যাওয়া, চোখে ধরা নীলিমার প্রতিফলন—সবই একদিনের যাত্রাকে স্মরণীয় করে রাখে।
অভিজ্ঞতা ও অনুভূতিরাতের যাত্রা, ভোরের বৃষ্টি, নৌকাভ্রমণ, হাওরের বিস্তার, নীলাদ্রি লেক এবং যাদুকাটা নদী—সব মিলিয়ে একদিনের তাহিরপুর যাত্রা মনে রেখে যায় এক অনন্য অভিজ্ঞতা। শহরের ব্যস্ততা, কোলাহল আর ক্লান্তি ভুলে যেতে চাইলে, মনকে নতুন করে সাজাতে চাইলে একবার অবশ্যই যেতে হবে এই সীমান্তঘেঁষা প্রাকৃতিক স্বর্গে। টিমের সঙ্গে ভাগ করা এই মুহূর্তগুলো মনে রাখার মতো, কারণ অচেনাদের সঙ্গে পরিচয় হয়ে এক মুহূর্তেই বন্ধুত্বের শুরু—এই অভিজ্ঞতা ভ্রমণকে আরও জীবন্ত করে তুলেছে।
প্রকৃতির নীলিমা, পাহাড়ের ছায়া, হাওরের সুর—সব মিলিয়ে তাহিরপুর এক অপরূপ ঠিকানা। এখানে যাত্রা শুধু চোখকে নয়, মনকেও ভরিয়ে দেয়। জীবনকে নতুন করে অনুভব করতে চাইলে শহরের ধুলো থেকে দূরে এই একদিনের যাত্রা যথেষ্ট।
এসইউ/এএসএম