একুশে বইমেলা

গাভী বিত্তান্ত: প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয়ের মনস্তাত্ত্বিক দলিল

অনিরুদ্ধ সাজ্জাদ

ক্ষমতা মানুষকে ঠিক কী করে? তাকে কি নতুন করে তৈরি করে, নাকি তার ভেতরের ঘুমন্ত সত্তাটাকে কেবল জাগিয়ে তোলে? এই সনাতন প্রশ্নের সবচেয়ে বিদ্রূপাত্মক, নির্মোহ এবং ভয়ংকর বাস্তবসম্মত উত্তরগুলোর একটি পাওয়া যায় আহমদ ছফার ‘গাভী বিত্তান্ত’ উপন্যাসে। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র মিয়া মোহাম্মদ আবু জুনায়েদ কোনো দানব হিসেবে আবির্ভূত হন না। তিনি বরং আমাদের চারপাশেই দেখতে পাওয়া একজন অতি সাধারণ, কিছুটা হীনম্মন্যতায় ভোগা ‘সজ্জন’ শিক্ষক, যিনি হয়তো সারাজীবন আর দশজনের মতোই একটি জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন।

কিন্তু উপাচার্য হওয়ার পর সেই সাধারণ মানুষটির ভেতর থেকে যা বেরিয়ে আসে, তা যে কোনো স্বৈরাচারের মনস্তত্ত্বের চেয়ে কম কৌতূহলোদ্দীপক নয়। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিণত করেন এক ব্যক্তিগত খামারে, আর সেই খামারের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে একটি গাভি। কেন? এই ‘কেন’-এর উত্তর খুঁজতে গেলেই আমরা ঢুকে পড়ি প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয় ও ব্যক্তিগত মনস্তাত্ত্বিক পতনের এক আঁতকে ওঠার মতো জগতে। ‘গাভী বিত্তান্ত’ তাই কেবল একটি উপন্যাস থাকে না, হয়ে ওঠে আমাদের সময়ের প্রতিষ্ঠানগুলোর এক্স-রে রিপোর্ট।

এক আবু জুনায়েদের পতন, নাকি সিস্টেমের পচন?আবু জুনায়েদের এই যে রূপান্তর, তা কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। আহমদ ছফা দেখাচ্ছেন, যখন কোনো প্রতিষ্ঠান মেধা বা যোগ্যতার চেয়ে আনুগত্যকে বেশি পুরস্কৃত করে; তখন আবু জুনায়েদের মতো ব্যক্তিত্বহীন লোকেরাই ক্ষমতার জন্য সবচেয়ে নিরাপদ বিকল্প হয়ে ওঠেন। কারণ, তারা নিয়ন্ত্রণযোগ্য। কিন্তু ক্ষমতা পেয়ে সেই নিয়ন্ত্রণযোগ্য মানুষটিই হয়ে ওঠেন অপ্রতিরোধ্য, কারণ তার ভেতরের শূন্যতা পূরণের জন্য ক্ষমতার আস্ফালন ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকে না। উপাচার্য আবু জুনায়েদ যখন দেখেন যে, শিক্ষক রাজনীতির জটিল সমীকরণ, ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাস বা প্রশাসনিক দীর্ঘসূত্রিতা তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে, তখন তিনি এক গভীর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করেন।

এই ব্যর্থতাবোধ থেকেই তার মনস্তাত্ত্বিক পলায়নপরতা শুরু হয়। তিনি এমন একটি জগৎ খোঁজেন, যেখানে তিনি একচ্ছত্র অধিপতি। আর সেই জগৎটি তিনি খুঁজে পান তার পোষা গাভি ‘নূরজাহান’-এর মধ্যে। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একে ‘অবজেক্ট ফিক্সেশন’ বলা যেতে পারে, যেখানে একজন ব্যক্তি তার নিয়ন্ত্রণহীন জীবনের সবটুকু মনোযোগ ও কর্তৃত্ব একটি বস্তুর ওপর অর্পণ করে মানসিক শান্তি খোঁজেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো জরুরি কাজের চেয়ে গাভির খাদ্য, স্বাস্থ্য ও বাসস্থান তার কাছে মুখ্য হয়ে ওঠে। কারণ গাভির জগতে কোনো বিদ্রোহ নেই, প্রশ্ন নেই, আছে কেবলই আনুগত্য। গাভির পরিচর্যার মাধ্যমে তিনি সেই আত্মবিশ্বাস ও কর্তৃত্ব ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করেন, যা তিনি উপাচার্যের চেয়ারে বসে হারিয়ে ফেলেছিলেন। তাই ‘নূরজাহান’ কেবল দুর্নীতির প্রতীক নয়, সে একজন পরাজিত মানুষের ভাঙা মনস্তত্ত্বের একমাত্র আশ্রয়।

আরও পড়ুনসাদাকালো ক্যানভাসে স্মৃতিময় গল্প: একজন জাফরুল্লাহ চৌধুরীশূন্য রথের ঘোড়া: হৃদয়ে গেঁথে থাকা উপাখ্যান

‘জি হুজুর’ সংস্কৃতি এবং বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াত্বএকজন আবু জুনায়েদ একা একটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করতে পারেন না। তার জন্য প্রয়োজন হয় একদল সুবিধাবাদী ও চাটুকার পরিবেষ্টনীর। উপন্যাসের শেখ তোফাজ্জল হোসেনের মতো চরিত্ররা হলেন সেই ব্যবস্থার স্তম্ভ। তারা জানেন, জ্ঞানচর্চা বা নীতি-নৈতিকতার চেয়ে উপাচার্যের স্তুতি করা অনেক বেশি লাভজনক। তাদের আত্মসম্মানবোধ এতটাই নিচে নেমে যায় যে, উপাচার্যের গাভির দুধ নিয়ে গবেষণা করা বা তার জন্য কচি ঘাস জোগাড় করাকেই তারা নিজেদের প্রধান প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব বলে মনে করেন।

এরা সবাই মিলে উপাচার্যের চারপাশে একটি ‘ইকো চেম্বার’ বা প্রতিধ্বনিকক্ষ তৈরি করে। যেখানে উপাচার্যের সবথেকে অযৌক্তিক সিদ্ধান্তকেও ‘যুগান্তকারী’ বলে প্রশংসা করা হয়।

এই ‘জি হুজুর’ সংস্কৃতি আবু জুনায়েদের অহংকে আরও স্ফীত করে এবং বাস্তবতা থেকে তাকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ফলে, উপাচার্যের বাসভবনে গোয়ালঘর তৈরি হওয়া বা বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় গাভির জন্য ভুট্টার চাষ হওয়ার মতো ঘটনাগুলো ধীরে ধীরে স্বাভাবিক বলে গৃহীত হয়। যারা এর সামান্যতম বিরোধিতা করেন, তারাই হয়ে যান প্রতিষ্ঠানের ‘শত্রু’। আহমদ ছফা দেখান, একজনের পাগলামি নয় বরং বহুজনের নীরবতা, সুবিধাবাদ ও সম্মিলিত চাটুকারিতাই একটি প্রতিষ্ঠানকে ভেতর থেকে খেয়ে ফেলে।

‘গাভী বিত্তান্ত’ কেন আজও প্রাসঙ্গিক?উপন্যাসটির সবচেয়ে ভীতিকর দিক হলো, এটি কোনো নির্দিষ্ট সময়ের গল্প নয়। এটি প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয়ের এক চিরকালীন চিত্র। আবু জুনায়েদ একজন ব্যক্তি নন, একটি প্রবণতার নাম। যে প্রবণতায় একজন অযোগ্য ব্যক্তি সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হলে নিজের অযোগ্যতা ঢাকতে পুরো প্রতিষ্ঠানকেই একটি সার্কাসের মঞ্চ বানিয়ে ফেলেন। আর তার চারপাশের সুবিধাভোগীরা সেই সার্কাসের দর্শক হয়ে হাততালি দিতে থাকেন।

আহমদ ছফা কোনো সমাধান দেননি, তিনি কেবল রোগটি নির্ভুলভাবে শনাক্ত করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, অবক্ষয় একটি চক্রাকার প্রক্রিয়া। অসুস্থ প্রতিষ্ঠান অসুস্থ নেতার জন্ম দেয়, আবার সেই অসুস্থ নেতা প্রতিষ্ঠানকে আরও অসুস্থ করে তোলে। ‘গাভী বিত্তান্ত’ তাই নিছক কোনো ব্যঙ্গাত্মক উপন্যাস নয়। এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক দলিল, যা আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয়, প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদের অযৌক্তিকতাকে যখন সরল বাক্যে মেনে নেওয়া হয়; তখন পুরো সিস্টেমের পচন অনিবার্য হয়ে ওঠে। আজকের বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে যখন আমরা আমাদের চারপাশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকাই, তখন কি ‘গাভী বিত্তান্ত’র চরিত্রগুলোকে খুব অচেনা মনে হয়? এ প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আহমদ ছফার সার্থকতা।

লেখক: শিক্ষার্থী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়ময়নসিংহ।

এসইউ/এএসএম