অতিবৃষ্টি ও বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে গাইবান্ধার চরাঞ্চলের কৃষকেরা আগাম জাতের সবজি চাষে নেমেছেন। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জমি তৈরি, বীজ চারা রোপণসহ পরিচর্যা করছেন। জেলা সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি এবং সাঘাটা উপজেলার প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে বস্তায় মাটি ভরে সবজি ও মসলা চাষ করছেন। বন্যার উচ্চতা বিবেচনায় সারিবদ্ধভাবে মাচা স্থাপন করে উৎপাদন করা হচ্ছে আদা, হলুদ, লাউ, কুমড়া, বেগুনসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি ও মসলা। বন্যার প্রভাব মোকাবিলায় অভিনব পন্থায় চাষাবাদে কৃষকের সাথে উৎসাহিত হচ্ছেন গৃহিণীরাও।
অতিরিক্ত বন্যায় পানির উচ্চতা বেড়ে জমির ফসল এবং বসতভিটা ভিত্তিক নিত্যপ্রয়োজনীয় শাক-সবজি নষ্ট হয়ে যায়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মতো গাইবান্ধার চরবেষ্টিত চারটি উপজেলার কৃষকেরাও এমন ক্ষতির হাত থেকে রেহাই পান না। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের পথ খুঁজতেই জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্যোগে বাস্তবায়িত হচ্ছে বস্তায় মাটি ভরে মাচায় অথবা উঁচু স্থানে শাক-সবজি ও মসলা চাষপদ্ধতি।
জেলার প্রায় ১৬৫টি চর এবং নদী তীরবর্তী ১৮টি ইউনিয়নে প্রতি বছর কম-বেশি নিয়মিত বন্যার পানিতে কৃষিপণ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়। এমন পন্থায় চাষাবাদ করতে কৃষক এবং গৃহিণীদের উৎসাহিত করতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ এবং চর্চা অব্যাহত রাখতে যৌথ পরিকল্পনায় কাজ করছে জেলা কৃষি বিভাগ এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন এসকেএস ফাউন্ডেশন।
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের নখিয়ার পাড়া গ্রামের কৃষক মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘চরের ৭০ ভাগ গ্রামই প্রতি বছর বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। যে সময় বন্যা হয়; তখন ঘরের মধ্যেও পানি ওঠে। মাঠের ফসলও ডুবে যায়। বসতভিটায় গৃহিণীরা যে সবজি চাষ করে; সেটিও পানিতে তলিয়ে পচে যায়। তাই তারা মাচায় সবজি চাষ করে নিজের চাহিদা মিটিয়ে কিছু টাকা আয় করতে পারেন।’
চর চরিতা বাড়ি গ্রামের আসমা বেগম বলেন, ‘আমি ৫০টি বস্তায় আদা চাষ করে মাসে ৭-৮ হাজার টাকা আয় করেছি। যা দিয়ে সংসার চালাই।’
সাঘাটা উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়নের গৃহিণী মনি বেগম বলেন, ‘প্রথমে প্রশিক্ষণ নিয়ে বস্তায় সবজি চাষ শুরু করি। এখন বাড়িতে সবজি ভালো হওয়ায় পাশের গ্রামের প্রায় ১২ জন এভাবে বস্তায় হলুদ, আদা ও বেগুনসহ বিভিন্ন ধরনের শীতকালীন সবজি চাষ শুরু করেছেন।’
আরও পড়ুনচারপাশে উঁকি মারছে দীপ্ত লুচি, চেনেন কি?ফেনীর পতিত জমিতে পেয়ারা চাষে অপার সম্ভাবনা
একই গ্রামের কৃষক আইজ উদ্দিন বলেন, ‘বন্যার সময় এমনিতেই সব ধরনের শাক-সবজির দাম চড়া থাকে। তারপর আমাদের পক্ষে শাক-সবজি কিনে খাওয়া কষ্টের ব্যাপার। মাচায় বস্তার মধ্যে শাক-সবজি চাষ নতুন হলেও বন্যা কবলিত এলাকার মানুষ যদি এ পদ্ধতিতে চাষ করি, তবে অল্প জায়গায় বাড়ির উঠানেই চাষ করে খাওয়া সম্ভব।’
পার্শ্ববর্তী গ্রামের কৃষক মো. সুফিয়ান বলেন, ‘বন্যায় ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। প্রতি বস্তায় লাভ হবে ২২০ টাকা। তাই আগামী বছর ৪০০ বস্তায় হলুদ চাষ করে প্রায় ৮০ হাজার টাকা লাভের পরিকল্পনা করেছি।’
সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা নুরুল হুদা বলেন, ‘বস্তায় আদা, হলুদসহ বিভিন্ন সবজি এবং মসলা চাষে স্থানীয় কৃষক এবং বসতবাড়ি ভিত্তিক নারীদের মধ্যে বেশ উৎসাহ দেখা যাচ্ছে। এ ইউনিয়নে এ পদ্ধতি উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় কৃষকের মাঝে সাড়া জাগিয়েছে। যেটি আগামী দিনে এ অঞ্চলের পরিবারভিত্তিক সবজির চাহিদা পূরণে সহায়ক হবে। পাশাপাশি অনেকে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছেন। যা এলাকায় অর্থনৈতিকভাবে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকারিভাবে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে হরিপুর ইউনিয়নে ১০০-এর অধিক পরিবারের বসতবাড়িতে বস্তায় সবজি, আদা ও হলুদ চাষ করা হয়েছে।’
দিন দিন এ পদ্ধতি গাইবান্ধার মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। যেখানে কৃষক এবং বসতবাড়িভিত্তিক গৃহিণীদের এ পদ্ধতি আকর্ষণ করছে। আগামী দিনে গাইবান্ধার চরাঞ্চলে বস্তায় চাষপদ্ধতি সম্ভাবনার দ্বার খুলে বন্যা সহনশীল পদ্ধতি হিসেবে বন্যাজনিত ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনতে সহায়ক হবে।
গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘চরাঞ্চলের কৃষকেরা মাচাপদ্ধতিতে সবজি চাষ করে নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বাজারে বিক্রি করতে পারছেন। এতে তাদের যেমন আয় হচ্ছে; তেমনই নিজের পুষ্টির অভাব পূরণ হচ্ছে। যারা এভাবে সবজি চাষে আগ্রাহী, তাদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে।’
আনোয়ার আল শামীম/এসইউ/এএসএম