বর্তমান বিশ্ব শিক্ষা খাত দ্রুত রূপান্তরিত হচ্ছে। প্রযুক্তি এখন কেবল সহায়ক নয়, বরং পাঠ্যসামগ্রী তৈরি থেকে শুরু করে মূল্যায়ন প্রক্রিয়া পর্যন্ত শিক্ষার প্রায় সব স্তরকে স্পর্শ করছে। বিশেষত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) শিক্ষায় এক নতুন বিপ্লব ঘটাতে চলেছে। বাংলাদেশেও ইতোমধ্যে পাঠ্যবই তৈরিতে ডিজিটাল কনটেন্ট, অনলাইন শিক্ষা, এবং পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরিতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে।
বিশ্বব্যাংক, UNESCO ও ADB-এর একাধিক গবেষণায় বলা হয়েছে, AI-ভিত্তিক অভিযোজিত শিক্ষণ (adaptive learning) শিক্ষার মান উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। এটি শিক্ষার্থীর শেখার ধরণ বিশ্লেষণ করে ব্যক্তিগতকৃত কনটেন্ট দিতে পারে, শিক্ষকের কাজের চাপ কমিয়ে সৃজনশীল কার্যক্রমে মনোযোগী হতে সহায়তা করতে পারে। কিন্তু এই সুফলের পাশাপাশি রয়েছে গুরুতর ঝুঁকিও। AI মডেলগুলোতে পক্ষপাত থাকতে পারে, তথ্যের সত্যতা যাচাই না হলে পাঠ্যসামগ্রীতে ভুল বা বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে। সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য ও শিক্ষার ডেটা—যদি এর নিরাপত্তা ও ব্যবহারবিধি নিয়ে সুস্পষ্ট নীতি না থাকে, তবে অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। ICT Division কর্তৃক প্রকাশিত AI Readiness Assessment Report (2025)-এও উল্লেখ করা হয়েছে যে শিক্ষা খাতে AI ব্যবহার কার্যকর করতে হলে অবিলম্বে সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকা প্রয়োজন।
বিশ্বব্যাপী অনেক দেশ ইতোমধ্যে শিক্ষায় AI ব্যবহারের জন্য নীতিমালা বা গাইডলাইন তৈরি করেছে। ভারত, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার উদ্যোগগুলো দেখায়, নীতি ছাড়া AI ব্যবহার বিপজ্জনক হতে পারে। UNESCO-এর “AI and Education” নির্দেশিকাতেও স্পষ্টভাবে বলা আছে—নীতিমালা ছাড়া AI শিক্ষা বৈষম্য বাড়াবে এবং শিক্ষার্থীর অধিকার খর্ব করবে। বাংলাদেশে এখনো পূর্ণাঙ্গ AI-শিক্ষা নীতিমালা নেই। যদিও সরকার ICT খাতে 'AI Policy Draft' প্রণয়ন করেছে, কিন্তু শিক্ষা খাতের জন্য আলাদা নির্দেশিকা এখনো তৈরি হয়নি। এখনই সরকার, শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, প্রকাশনা সংস্থা ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানকে একসাথে বসে একটি জাতীয় AI-শিক্ষা নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। এই নীতিমালা শিক্ষার্থীর অধিকার রক্ষা করবে, শিক্ষককে শক্তিশালী করবে, শিক্ষায় বৈষম্য কমাবে এবং সর্বোপরি অ্যাকাডেমিক বইয়ের মান নিশ্চিত করবে।
AI নিয়ন্ত্রণহীনভাবে শিক্ষায় ব্যবহার করা উচিত না। কারণ নীতিমালা ছাড়া AI শিক্ষা-খাতে নতুন বৈষম্য তৈরি করতে পারে। শহর-গ্রামের মধ্যে ডিজিটাল ব্যবধান বাড়বে, কপিরাইট ও স্বত্ব সংরক্ষণের প্রশ্ন উঠবে, এবং শিক্ষকের ভূমিকা দুর্বল হতে পারে। তাই বলতে হবে, বাংলাদেশে অ্যাকাডেমিক বই ও শিক্ষায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের জন্য একটি জাতীয় নীতিমালা করা এখন সময়ের দাবি।
আমরা এখন জানি যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) কেবল একটি প্রযুক্তি নয়; এটি শিখনের কৌশল, পাঠ্যসামগ্রী ও মূল্যায়ন প্রণালি বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। মডেলগুলোতে থাকা পক্ষপাত (bias), ব্যক্তিগত শিক্ষার ডেটার অপব্যবহার, কপিরাইট-যুক্ত পাঠ্যবস্তুর অননুমোদিত ব্যবহার, এবং অপ্রতুল শিক্ষক প্রশিক্ষণ—এসব ইস্যু নীতিনির্ধারকদের সামনে বিশাল চ্যালেঞ্জ দাঁড় করায়। বাংলাদেশে AI বাস্তবায়নের জন্য যে সরকারি ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগগুলো শুরু হয়েছে; জাতীয় AI নীতি খসড়া ও দেশের AI রেডিনেস অ্যাসেসমেন্ট— সেগুলোতেই সেগুলো তুলে ধরেছে যে খাসতরক (governance) ও সুনির্দিষ্ট শিক্ষা-খাতভিত্তিক নির্দেশনার অভাব থেকেই বড় রিস্ক। সুতরাং, অ্যাকাডেমিক বই ও শিক্ষায় AI ব্যবহারের নীতিমালা তৈরি করতে হলে প্রথমত স্পষ্ট মৌলবিন্দু নির্ধারণ করা জরুরি — উদ্দেশ্য, পরিধি ও অগ্রাধিকার।
বই-রচনায় AI ব্যবহারের ক্ষেত্রে নীতিনির্দেশনায় থাকতে হবে: (ক) কীসের জন্য AI ব্যবহার করা যাবে (উদাহরণ: অনলাইন অনুকূলতা, অনুকরণমূলক মূল্যায়ন, অটোমেটেড ইন্টারঅ্যাকটিভ অনুশীলনী), (খ) কোন ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকবে (উদাহরণ: পরীক্ষার মূল্যায়ন স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য করে দেওয়া ছাড়া), এবং (গ) শিক্ষাসামগ্রীতে কপিরাইট ও স্বত্বরক্ষার নিয়ম কীভাবে প্রয়োগ হবে। UNESCO ও ADB-এর নির্দেশনাগুলো এই ধরনের মৌলিক কাঠামো তৈরিতে প্রমাণভিত্তিক গাইড হিসেবে কাজ করবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শিক্ষাকে ব্যক্তিগতকৃত, দ্রুততর ও কার্যকর করে তুলতে পারে। কিন্তু নীতিমালা ছাড়া এটি যেমন ঝুঁকি বাড়াবে, তেমনি শিক্ষাব্যবস্থায় অস্থিরতা সৃষ্টি করবে। তাই বাংলাদেশের শিক্ষা খাতের সামনে এখন সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো অ্যাকাডেমিক বই ও শিক্ষায় AI ব্যবহারের জন্য একটি সুস্পষ্ট, কার্যকর ও সময়োপযোগী জাতীয় নীতিমালা করা। নীতিমালা ছাড়া এই প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণহীন স্রোতের মতো হবে, যা শিক্ষার তীর ভেঙে দেবে; আর নীতিমালার মাধ্যমে এটি হবে উন্নয়নের সেতুবন্ধন।
নীতিমালাটা হবে কীভাবে? প্রাথমিক ভাবে ডাটা নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা হবে নীতির কেন্দ্রবিন্দু। শিক্ষার্থীর পারফরম্যান্স, আচরণগত মেটা-ডেটা ও ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহের আগে স্পষ্ট সম্মতি, সংরক্ষণকাল, অ্যাক্সেস নিয়ন্ত্রণ ও ডেটা আর্কাইভিংয়ের নীতিসমূহ থাকতে হবে। এসব নীতিমালা একদিকে আইনগত বাধ্যবাধকতা পূরণ করবে, অন্যদিকে শিক্ষার্থীর মানুষের মর্যাদা ও অধিকার রক্ষা করবে। স্থানীয় পরিপ্রেক্ষিতে ডেটা হোস্টিং (বাংলাদেশে ডেটা থাকছে কি না), তৃতীয়-পক্ষের ক্লাউড সেবা ব্যবহারের নিরাপত্তা, এবং বিদ্যমান তথ্য নিরাপত্তা আইন-ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য নিশ্চিত করা নীতিগত বাধ্যতামূলক। আর শিক্ষক ও পাঠ্য-রচনা কারিগরি সক্ষমতা বাড়াতে রাষ্ট্র ও শিক্ষাব্যবস্থাকে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে।
AI-টুল ব্যবহারের জন্য শুধু সফ্টওয়্যার নয়—শিক্ষকদের জন্য কার্যকর প্রশিক্ষণ, কোর্স মডিউল, এবং ধারাবাহিক পেশাগত উন্নয়ন দরকার, যাতে তারা AI-সাহায্য প্রাপ্ত পাঠ্যকে কার্যকরভাবে মূল্যায়ন ও আয়ত্ত করতে পারেন। UNESCO ও World Bank-এর নির্দেশনায় শিক্ষক-ক্যাপাসিটি বিল্ডিংকে প্রধান স্তম্ভ হিসেবে দেখা হয়েছে; এটি বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে নীতি প্রণয়নেও প্রতিফলিত হওয়া উচিত। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকা কর্তব্য। পাঠ্যবই বা অনলাইন কোর্সে ব্যবহৃত AI যদি সিদ্ধান্ত নিতে বা গ্রেড নির্ধারণে ভূমিকা রাখে, তাহলে সেই মডেলের কার্যপ্রণালি, সীমাবদ্ধতা ও রেস্পনসিবিলিটি কোথায়—এসব স্পষ্টভাবে খোদ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের জন্য প্রকাশ্য হতে হবে।
বাংলাদেশের শিক্ষাখাতে AI-এর সফল ও ন্যায্য ব্যবহার নিশ্চিত করতে দরকার: স্পষ্ট আইনগত কাঠামো, ডেটা-গভর্ন্যান্স, শিক্ষক-শক্তি উন্নয়ন, সমঅর্থনৈতিক প্রবিধান ও স্বচ্ছতার ওযবস্থা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শিক্ষাকে ব্যক্তিগতকৃত, দ্রুততর ও কার্যকর করে তুলতে পারে। কিন্তু নীতিমালা ছাড়া এটি যেমন ঝুঁকি বাড়াবে, তেমনি শিক্ষাব্যবস্থায় অস্থিরতা সৃষ্টি করবে। তাই বাংলাদেশের শিক্ষা খাতের সামনে এখন সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো অ্যাকাডেমিক বই ও শিক্ষায় AI ব্যবহারের জন্য একটি সুস্পষ্ট, কার্যকর ও সময়োপযোগী জাতীয় নীতিমালা করা। নীতিমালা ছাড়া এই প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণহীন স্রোতের মতো হবে, যা শিক্ষার তীর ভেঙে দেবে; আর নীতিমালার মাধ্যমে এটি হবে উন্নয়নের সেতুবন্ধন।
এইচআর/জেআইএম