স্মার্টফোন এখন শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, হাতের মুঠোয় থাকা এক বিশাল পৃথিবী। আঙুলের স্পর্শেই চোখের সামনে খুলে যায় অসংখ্য ভিডিও, ছবি ও গল্পের ভান্ডার। কিন্তু এই ডিজিটাল জগতে যতটা আলো আছে, অন্ধকারও কম নয়।
একটি ক্লিকেই অনেক তরুণ জড়িয়ে পড়ছে এমন কনটেন্টের ফাঁদে, যেগুলো শুধু মানসিকভাবে নয়, আইনগতভাবেও বিপদের কারণ হতে পারে।
ইন্টারনেট ব্যবহারের সহজলভ্যতা তরুণদের তথ্য ও বিনোদনের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। কিন্তু সেই একই সহজলভ্যতাই তৈরি করেছে নিষিদ্ধ ভিডিও সংস্কৃতি বা পর্নোগ্রাফি। যেখানে কৌতূহল, প্রলোভন আর অজানার টান একসঙ্গে কাজ করে। অনেকে বন্ধুর পরামর্শে, কেউবা ট্রেন্ড ধরে রাখতে গিয়ে, অজান্তেই এমন কনটেন্টে জড়িয়ে পড়ছে যা তাদের ভবিষ্যৎকে কালো করে দিতে পারে।
ডোপামিন আসক্তি থেকে শুরুদ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আসক্তি বিশেষজ্ঞ ডা. আনা লেম্বকি বলেছেন, আমাদের স্মার্টফোন আমাদের ডোপামিন নেশায় আসক্ত করে তুলছে। প্রতিটি ‘সোয়াইপ,’ ‘লাইক’ বা ‘টুইট’ আমাদের মস্তিষ্কে আনন্দ সঞ্চারক রাসায়নিক ডোপামিন নিঃসরণ করে। তখন সামাজিক মাধ্যম, শর্ট ভিডিও অ্যাপ বা নিষিদ্ধ ওয়েবসাইটের প্রলোভনও তরুণদের কাছে খুবই আকর্ষণীয় লাগে। কিন্তু সমস্যা তখনই শুরু হয়, যখন সেই আগ্রহ আসক্তিতে পরিণত হয়।
এক সময় এসব ভিডিও দেখার পাশাপাশি কেউ কেউ এগুলো শেয়ার, সংরক্ষণ এমনকি নিজেরাই কনটেন্ট তৈরি করতেও শুরু করেন। যার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ।
বাংলাদেশে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২ অনুযায়ী এ ধরনের কনটেন্ট তৈরি, প্রচার বা সংরক্ষণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে এই অপরাধে জড়িত তরুণদের সংখ্যা বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। অনেক সময়ই তারা বুঝতেও পারেন না যে, তারা যেটিকে ‘মজার কনটেন্ট’ ভাবছেন, সেটিই হতে পারে তাদের বিরুদ্ধে আইনি মামলা।
শুধু আইনের দিক থেকে নয়, মানসিকভাবেও এটি এক বিপজ্জনক প্রবণতা। মনোবিজ্ঞানী এম. প্রিভারা বলেছেন, নিয়মিত প্রাপ্তবয়স্ক কনটেন্ট দেখার ফলে মস্তিষ্কের ডোপামিন প্রভাবিত হয়। এর ফলে স্বাভাবিক আনন্দ পাওয়ার ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যায় এবং ব্যক্তির মনোযোগ কমতে শুরু করে।
এছাড়াও এর ফলে বাস্তব জীবনের সম্পর্ক, পড়াশোনা বা কর্মজীবনে মনোযোগ নষ্ট হয়। অনেকে হতাশা, আত্মগোপন কিংবা সামাজিক বিচ্ছিন্নতায় ভুগতে শুরু করে।
আবার বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তৈরি ডিপফেক ভিডিও তরুণদের জন্য নতুন ঝুঁকি তৈরি করছে। যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে মানুষের মুখ বসিয়ে ভুয়া ভিডিও তৈরি করা হয়। এতে নির্দোষ মানুষও হয়রানির শিকার হন। এসব ভিডিও দ্রুত সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, আর একবার অনলাইনে চলে এলে তা সম্পূর্ণ মুছে ফেলা প্রায় অসম্ভব।
তবে সব দায় শুধু প্রযুক্তির নয়। সমাজে সচেতনতার অভাব, পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হওয়া এবং অনলাইন শিক্ষার সঙ্গে নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রশিক্ষণ না থাকা - এসব কারণেও তরুণরা সহজেই এই ফাঁদে পড়ে।
তাহলে সমাধান কী?সমাধান হতে পারে শিক্ষা ও সচেতনতার মাধ্যমে। স্কুল-কলেজে সাইবার সচেতনতা বিষয়ক ক্লাস সাহায্য করতে পারে। এছাড়াও পিতা-মাতার সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা এবং অনলাইন নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ তরুণদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে পারে। আর সবচেয়ে জরুরি, নিজেকে বারবার মনে করানো - ডিজিটাল জগতে প্রতিটি ক্লিকের পেছনে থাকে আমাদের দায়বদ্ধতা।
ইন্টারনেটের স্বাধীনতা আমাদের উন্নতির পথ খুলে দিয়েছে, কিন্তু সেই স্বাধীনতাকে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ব্যবহার করাই প্রকৃত জ্ঞানীর পরিচয়। কারণ একবার যদি কেউ নিষিদ্ধ ভিডিওর ফাঁদে পড়ে যায়, সেখান থেকে বেরিয়ে আসা অনেক সময় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
তথ্যসূত্র: পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন- ২০১২, সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন, এপিএ, দ্য গার্ডিয়ান, পিএমসি
এএমপি/এমএস