ফিচার

ঝুঁকির চূড়ায় ঝুলে থাকা জীবন

ঢাকার আকাশ ছোঁয়া ভবনগুলোর চকচকে কাচে প্রতিদিনই প্রতিফলিত হয় সূর্যের আলো, বিলাসবহুল অফিসের ঝলক, শহরের রূপকথা। কিন্তু সেই কাঁচের পেছনে, কিংবা বলা যায় সেই কাচের বাইরেই ঝুলে থাকে কিছু মানুষের জীবন। তারা হলো সেই নিঃশব্দ শ্রমিক, যারা দড়ি ও সাহসের ভরসায় বহুতল ভবনের কাঁচ পরিষ্কার করেন। তাদের কাজ যতটা দরকারি, ততটাই বিপজ্জনক।

কারওয়ান বাজারের ব্যস্ত সড়কের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ চোখে পরে একজন মানুষ ঝুলে আছেন বিশাল ভবনের বাইরের দিকের কাচে। নিচে তাকালে মাথা ঘুরে যায়, কিন্তু তার মুখে নেই ভয়, নেই দ্বিধা। হাতে পানির বোতল, কাপড় আর ক্লিনার-এই তিনটিই তার অস্ত্র, আর দড়ির গিঁটই তার জীবনের ভরসা।

এই শ্রমিকদের বেশিরভাগই আসে গ্রামের সাধারণ পরিবার থেকে। কেউ ক্ষেতে কাজ করত, কেউ নির্মাণ শ্রমিক ছিল। কিন্তু শহরের উচ্চ ভবনগুলোর চাহিদা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জন্ম নিয়েছে এই নতুন পেশা ‘বিল্ডিং গ্লাস ক্লিনার’। তাদের কোনো বিলাসবহুল অফিস নেই, নেই নিয়মিত ছুটি, নেই বিমা। সকালবেলা তারা আসে ভবনের ছাদে, কোমরে বাঁধে সেফটি বেল্ট, তারপর শুরু হয় ঝুলে থাকা জীবনের দিনযাপন।

আমরা যেসব ভবনের ঝকঝকে কাচ দেখে মুগ্ধ হই, তার পেছনে আছে তাদের কঠোর পরিশ্রম। দুপুরের গরমে, বৃষ্টির দিনে, এমনকি তীব্র বাতাসেও তারা কাজ থামাতে পারেন না। কখনো দড়ির গিঁট আলগা হলে বা সেফটি বেল্টে ত্রুটি ঘটলে ঘটে যায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা। কিন্তু তবু তারা কাজ চালিয়ে যান, কারণ তাদের হাতে অন্য কোনো বিকল্প নেই। প্রতিটি মাসে তাদের আয়ের টাকায় চলে গ্রামের বাড়িতে থাকা মা-বাবা, সন্তানদের স্কুলের খরচ, সংসারের রোজকার ব্যয়।

এই পেশায় কাজ করা শ্রমিকদের জন্য কোনো প্রশিক্ষণ বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুব একটা নেই। অনেক সময় দেখা যায়, দড়ি বা বেল্ট পুরোনো হয়ে গেছে, কিন্তু তবুও ব্যবহার করা হচ্ছে, কারণ নতুন সরঞ্জামের খরচ প্রতিষ্ঠান দিতে চায় না।

শ্রম অধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, উচ্চ ভবনে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সময় যথাযথ সেফটি না থাকায় প্রতিবছর অনেক শ্রমিক দুর্ঘটনায় আহত বা নিহত হন। কিন্তু এসব খবর খুব কমই আসে মিডিয়ার আলোচনায়। তাদের নাম থাকে না কোনো প্রতিবেদনে, তাদের গল্প হারিয়ে যায় শহরের ব্যস্ততার ভিড়ে।

বিলাসবহুল অফিসের ভেতর বসে যখন কেউ জানালার বাইরে তাকায়, হয়তো সে খেয়ালও করে না-তার সামনেই একজন মানুষ ঝুলে আছে মৃত্যুর ভয়কে জয় করে। তাদের হাতের ছোঁয়ায় কাচ ঝলমল করে, শহর পায় উজ্জ্বল চেহারা। কিন্তু সেই ঝলকানির পেছনে থাকে ক্লান্ত হাত, ঘামে ভেজা শরীর আর একরাশ সাহস।

এরা শুধু ‘শ্রমিক’ নয়, এরা আমাদের শহরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের জন্য থাকা উচিত নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, বীমা সুবিধা, নিয়মিত প্রশিক্ষণ। কারণ একটিমাত্র ভুল গিঁট খুলে গেলে হারিয়ে যায় এক পুরো জীবন, এক পুরো পরিবার ভেঙে পড়ে।

রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানগুলো যদি সামান্য যত্ন নেয়, তবে এই পেশাটিও হতে পারে সম্মানজনক ও নিরাপদ। উন্নত দেশগুলোতে যেমন স্কাই ক্লিনারদের জন্য নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ, বীমা ও মানসম্মত সরঞ্জাম থাকে-তেমন উদ্যোগ আমাদের দেশেও নেওয়া সময়ের দাবি।

জেএস/