আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এখন শুধু কূটনীতির পাঠ নয় বরং বৈশ্বিক রাজনীতি, নিরাপত্তা, অর্থনীতি, জলবায়ু, মানবাধিকারসহ নানা বিষয় নিয়ে বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের আধুনিক ক্ষেত্র। বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ও সংঘাত-সহাবস্থানের যে চিত্র দেখা যাচ্ছে; সেখানে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের গুরুত্ব, চাকরির ক্ষেত্র, উচ্চশিক্ষার সুযোগ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—
জাগো নিউজ: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে পড়ার যোগ্যতা কী?ড. দেলোয়ার হোসেন: সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক। স্নাতকে (সম্মান) পড়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাথমিকভাবে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্যতা বিবেচনা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মানুযায়ী লিখিত পরীক্ষা বা এমসিকিউ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যারা মেধাতালিকায় ওপরের দিকে থাকেন; তারাই সাধারণত এ বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে পড়ার যোগ্যতা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বা সমমানের পরীক্ষায় (৪র্থ বিষয়সহ) প্রাপ্ত জিপিএর যোগফল সাধারণত বিজ্ঞান শাখার জন্য ন্যূনতম ৮ (আলাদাভাবে ন্যূনতম ৩.৫) এবং মানবিক শাখার জন্য ন্যূনতম ৭.৫ (আলাদাভাবে ন্যূনতম ৩.০) থাকতে হবে।
জাগো নিউজ: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয় পড়তে কোন কোন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া যায়?ড. দেলোয়ার হোসেন: ১৯৪৭ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ চালু হয়। পরবর্তীকালে আরও কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়টি পড়ানো শুরু হয়। যেমন- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)। পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটিতে গ্লোব্যাল স্ট্যাডিজ নামে একটি বিষয় আছে। যেখানে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়টি পড়ানো হয়।
জাগো নিউজ: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রাোগ্রামে কী কী বিষয়ে পড়ানো হয়?ড. দেলোয়ার হোসেন: আন্তর্জাতিক সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় বিষয় পড়ানো হয়। আইআর একটি গতিশীল বিষয়। এ বিষয়ের পঠিত কোর্সগুলোর নাম থেকে একটা ধারণা পাওয়া যাবে। যেমন- আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিচিতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিচিতি, বিশ্ববিষয়ক বিভিন্ন মতাদর্শ, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞানের পরিচিতি, পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষণ, কূটনীতি, নিরাপত্তা, যুদ্ধ পরিচালনা কৌশল প্রণয়ন, বাণিজ্যিক কূটনীতি, অর্থনৈতিক কূটনীতি, ভূ-রাজনৈতিক বিষয় ও কৌশলগত বিষয়গুলো গুরুত্ব সহকারে পড়ানো হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক সংস্থা, আন্তর্জাতিক আইন—বিষয়গুলোও পড়ানো হয়। গত কয়েক দশক ধরে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কারিকুলামে বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থনীতি, বিশ্বায়ন, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদসহ অনেক বিষয় গুরুত্ব দেওয়া হয়। পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের রাজনীতি, কূটনীতি এবং নিরাপত্তার বিষয়গুলো পড়ানো হয়—একে এরিয়া স্ট্যাডিজ বা আঞ্চলিক বিষয়ে পড়াশোনা বলা হয়। পাশাপাশি বর্তমানে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, শরণার্থী, অভিবাসন, নারী অধিকার—বিষয়গুলো গুরুত্ব সহকারে পড়ানো হয়।
আরও পড়ুনচাকরি ও ক্যারিয়ারের মধ্যে পার্থক্য কী?নিজেকে সব সময় আত্মবিশ্বাসী রাখার চেষ্টা করেছি: শারমিন
জাগো নিউজ: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে পড়ে কোথায় চাকরির সুযোগ আছে?ড. দেলোয়ার হোসেন: কলা ও সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলো অধ্যয়নের ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ আছে। বাংলাদেশে এমপ্লয়মেন্ট পলিসি বা কর্মক্ষেত্রের মধ্যে উচ্চশিক্ষার সংযোগ এখনো সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠেনি। দেখা যায় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা কৃষি বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেও ব্যাংকিং সেক্টরে কাজ করেন। তারপরও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গ্র্যাজুয়েটরা বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস, আর্থিক ও ব্যাংকিং সেক্টর, আন্তর্জাতিক সংস্থা (জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক), বিভিন্ন বিদেশি মিশন, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, দেশীয় গণমাধ্যমে কাজের সুযোগ আছে। পাশাপাশি উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে এ বিভাগের শিক্ষার্থীরা বিশেষভাবে আগ্রহী থাকেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন দেশ ও সংস্কৃতির সাথে একধরনের পরিচিত লাভ করে। এ ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষার বিষয়ে আগ্রহ তৈরি হয় এবং সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নেওয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টি সহযোগিতা করে থাকে। তাছাড়া বাংলাদেশের বেসরকারি খাত বিশেষ করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, এনজিও, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, নীতি বিশ্লেষক, কর্পোরেট পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়ে থাকেন। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সুযোগ আছে।
জাগো নিউজ: বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে গ্র্যাজুয়েটদের প্রয়োজনীয়তা কেমন?ড. দেলোয়ার হোসেন: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে ডিগ্রিধারী গ্র্যাজুয়েটদের প্রয়োজনীয়তা আছে। বিষয়টি বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যয়নের যাত্রা শুরু হয়েছে ১৯৪৭ সালে। সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যখন বিশ্ব স্নায়ুযুদ্ধসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যু দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হতে শুরু করে। সেই সময়ের শুরুতে বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বপ্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয় পড়ানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা হয়। ফলে ২০২৫ সালে এসেও আমরা এ বিষয় নিয়ে কথা বলছি। স্বাভাবিকভাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে গ্র্যাজুয়েটদের প্রয়োজনীয়তা আছে। বিশেষ করে একটি রাষ্ট্র বা সরকারের নীতিনির্ধারণ, পররাষ্ট্র নীতি বিশ্লেষণ, বৈশ্বিক যোগাযোগ রক্ষা, কূটনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা ঝুঁকি বিশ্লেষণ, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সহযোগিতার বিষয়গুলো অনুধাবন করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যয়নের প্রয়োজন আছে। উন্নয়ন, নিরাপত্তা এবং শান্তির বিষয়গুলো সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান প্রয়োজন। বর্তমানে বিশ্ব ব্যবস্থায় এক দেশ আরেক দেশের সাথে ওতপ্রোতোভাবে জড়িত। সেই প্রেক্ষাপটে কূটনৈতিক দক্ষতা বৃদ্ধি প্রয়োজন।
জাগো নিউজ: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রোগ্রামে উচ্চশিক্ষার সুযোগ-সুবিধা কেমন?ড. দেলোয়ার হোসেন: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে উচ্চশিক্ষার যথেষ্ট সুযোগ আছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি মাল্টিডিসিপ্লিনারি বিষয়। এ বিষয়ে অধ্যয়নের ফলে বিদেশে স্নাতকোত্তরে একাধিক বিষয়ে পড়ার সুযোগ আছে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে এ বিষয়ে অধ্যয়নের সুযোগ আছে। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গুরুত্ব সহকারে এ বিষয় সম্পর্কে পড়ানো হয়ে থাকে। পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপান, চীন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও পাকিস্তানে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে পড়ানো হয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সাথে যুক্ত অন্যান্য নামে এ বিষয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ আছে। এ ছাড়া নিরাপত্তা, রাজনীতি, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক উন্নয়নের বিষয় সম্পর্কে পড়ার সুযোগ আছে। বৈশ্বিক শান্তি, পরিবেশ রাজনীতি, আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের ওপর পড়ার সুযোগ আছে। সেইসাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে অনার্স, মাস্টার্স ও পিএইচডির সুযোগ আছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফুলব্রাইট বৃত্তি, যুক্তরাজ্যের শিভেনিং, অস্ট্রেলিয়ার অসএইড, কমনওয়েলথের বৃত্তিতে পড়ার সুযোগ আছে।
জাগো নিউজ: যারা এ বিষয়ে পড়াশোনা করতে চান, তাদের উদ্দেশ্যে আপনার পরামর্শ কী?ড. দেলোয়ার হোসেন: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে পড়াশোনার জন্য এ বিষয় সম্পর্কে পূর্ব ধারণা থাকা ভালো। এ বিষয় সম্পর্কে জানাশোনা ও তথ্য থাকা উচিত। একজন শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার ভাবনার সাথে সংগতি রেখে বিষয় নির্বাচন করা প্রয়োজন। তবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয় পড়তে হলে এর সম্পর্কে যথেষ্ট আগ্রহ থাকা প্রয়োজন। একজন শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় পছন্দের বিষয় না পেলেও বিষয়টি পড়ার ক্ষেত্রে আগ্রহে ঘাটতি থাকলে শিক্ষাজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে আগ্রহ ও আগে থেকেই বিষয়গুলো সম্পর্কে একটা ধারণা থাকলে শিক্ষার্থীরা বিষয়টি উপভোগ করবে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা প্রয়োজন। আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ঘটনা, নিরাপত্তা ও শান্তি বিষয়ে আগ্রহ থাকা প্রয়োজন। সর্বোপরি একটি দেশের আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে ধরনের ঘটনাগুলো ঘটছে এবং যে বিষয়গুলো গুরুত্ব পেয়ে থাকে সেগুলো চর্চা করার আগ্রহ থাকতে হবে। তাহলেই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে পড়াশোনা নিঃসন্দেহে সার্থক হবে।
এসইউ/এমএস