কৃষি ও প্রকৃতি

আমন ধানে অচেনা রোগ, উৎপাদন নিয়ে শঙ্কায় চাষিরা

গাইবান্ধার ৭ উপজেলায় মাঠজুড়ে আমন ধানে দেখা দিয়েছে অজানা রোগ। আক্রান্ত ধান গাছের পাতা ২ সপ্তাহের মধ্যে শুকিয়ে বাদামি হয়ে যায়। শীষ গঠনের আগেই গাছ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বাজারে প্রচলিত কীটনাশক ব্যবহার করেও রক্ষা করতে পারছেন না চাষিরা। দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তারা। নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে। এভাবে চলতে থাকলে মারাত্মক লোকসানের মুখে পড়বেন চাষিরা।

চাষিরা বলছেন, বিঘাপ্রতি ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু বিঘাপ্রতি এক মণ ধান পাওয়ারও সম্ভাবনা নেই। অন্যদিকে কৃষি বিভাগ বলছে, এটি কোনো বড় ধরনের রোগ নয়। প্রয়োজনীয় বৃষ্টি ও ধান গাছের পুষ্টির অভাবে পাতা লালচে হচ্ছে। কৃষকদের ভুল পরিচর্যার কারণে পাতা সবুজ হতে একটু সময় লাগবে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে জেলার ৭ উপজেলায় ১ লাখ ৩৩ হাজার ১২৫ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষ হয়েছে। ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৪২ হাজার ৯৯৪ মেট্রিক টন।

কৃষকেরা বলছেন, ধান রোপণের প্রায় ২ মাস পর এ রোগ দেখা দেয়। কৃষি অফিস থেকে কোনো লোক এসে পরামর্শ বা খোঁজ নেয়নি। নিজেরাই দোকান থেকে কীটনাশক কিনে প্রয়োগ করছেন। তাতে কাজ হয়নি। ধানের গাছে ধান নেই। কী কারণে এমন হচ্ছে, জানা নেই। ধারদেনা করে আমন রোপণ করা হয়েছে। ধান উৎপাদন হলে বিক্রি করে ধারদেনা পরিশোধ করার আশা ছিল তাদের।

গাইবান্ধা সদর উপজেলার রিফাইতপুরের কোমল বলেন, ‘ধারদেনা করে ধান লাগাইছি। ধানে কী এক অচেনা রোগ ধরলো, তাক কেউই ধরতে পারছে না। এবার ধানের আবাদে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়া লাগবে।’

পলাশবাড়ী উপজেলার পূর্বকুমারগাড়ীর ছামছুলজামান মার্জু বলেন, ‘এবার প্রায় ৫ বিঘা জমিতে আমনের আবাদ করেছি। প্রায় ৫০ হাজার টাকা খরচ করে এসব জমি রোপণ করেছি। সব জমির ধান নষ্ট হয়েছে। ৫ বিঘা জমি থেকে এক ছটাক ধানও পাওয়ার আশা নেই। অনেক কীটনাশক দিয়েছি। কাজ হয়নি। আক্রান্ত ধানের গাছগুলো গরুও খায় না। চোখের সামনে ধানের জমিগুলো মরে নষ্ট হচ্ছে।’

আরও পড়ুনসাতক্ষীরায় চলতি আমন মৌসুমে ধান কাটা শুরুধানে ফুল ফোটার সময় কৃষকদের করণীয়

হালিমনগরের আব্দুল আজিজ বলেন, ‘আমার ৬৫ শতাংশ জমির ধানের পাতায় প্রথমে বাদামি দাগ হয়, পরে পুরো পাতা শুকিয়ে যায়। রোগটা কী, বুঝতে পারছি না। কৃষি অফিসে জানিয়েছি, তারা এসে দেখেছে কিন্তু এখনো কোনো কার্যকর ব্যবস্থা পাওয়া যায়নি। তুলামের বিলে প্রায় ৩ শতাধিক বিঘা জমি আছে। সব জমির ধানের একই অবস্থা। আমরা চাই, কৃষি অফিস থেকে লোকজন আসুক, কেন এমন হলো। আমরা সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ চাই।’

সাঘাটা উপজেলার ভরতখারী গ্রামের খুশি মিয়া বলেন, ‘নিজের জমি নাই। প্রায় ১ বিঘা ১৭ শতাংশ জমি বর্গা নিয়ে ধান চাষ করেছি। প্রায় ২০ দিন আগে হঠাৎ জমিতে রোগ দেখা দেয়। পরে বালাইনাশক ব্যবহার করি। তবুও গাছ বাঁচাতে পারছি না।’

গোবিন্দগঞ্জের কোচাশহর গ্রামের কৃষক উজ্জল মিয়া বলেন, ‘আমরা সারাবছর কষ্ট করে চাষ করি কিন্তু এমন রোগে ধান নষ্ট হলে সংসার চালানোই কঠিন হয়ে যাবে। সরকার যেন দ্রুত ব্যবস্থা নেয়।’

বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আবহাওয়ার অস্বাভাবিকতা, অতিরিক্ত বৃষ্টি ও তাপমাত্রার ওঠানামা ধানের নতুন রোগ ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ। দ্রুত রোগ নির্ণয় ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা না নিলে শুধু গাইবান্ধাই নয়, আশপাশের জেলাগুলোর আমন ধান উৎপাদনেও বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের গাইবান্ধা কার্যালয়ের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক মো. রোস্তম আলী বলেন, ‘মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তারা বিভিন্ন এলাকা থেকে আক্রান্ত ধানের নমুনা সংগ্রহ করেছেন। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ধানের গাছগুলো ব্যাকটেরিয়াল লিফ ব্লাইট রোগে আক্রান্ত।’

তিনি বলেন, ‘জমিগুলো জলাবদ্ধতায় নিমজ্জিত, ধান চাষাবাদের অনুপযোগী। রোপা আমনের চারায় পুষ্টিকর উপাদান ব্যবহার না হওয়ায় বৃদ্ধিতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে শীষ বা পাতা রোগাক্রান্ত হচ্ছে। এ রোগ নিয়ে আমাদের মাঠকর্মীরা নিয়মিত কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।’

আনোয়ার আল শামীম/এসইউ/জেআইএম