লাইফস্টাইল

সাধারণ মানসিক চাপ কখন রোগে পরিণত হয়

মানসিক চাপ আমরা সবাই অনুভব করি। পড়াশোনা, চাকরি, পরিবার, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, সম্পর্কের টান — যে কোনো কিছুই হঠাৎ মাথার ওপর পাহাড়ের মতো বসে যেতে পারে। তবে সব চাপই রোগ নয়।

যখন মানসিক চাপ শরীর-মনকে স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে শুরু করে, তখন সেটাই হয়ে যায় স্ট্রেস ডিজঅর্ডার। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে এটাকে মানসিক স্বাস্থ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার একটি হিসেবে দেখা হয়।

আজকের জীবনযাত্রায় এই ডিজঅর্ডারের ঝুঁকি বাড়ছে, কিন্তু ঠিক কোন পর্যায়ে এটি রোগ হিসেবে ধরা পড়ে, আর কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়? সহজ ভাষায় জেনে নিন-

স্ট্রেস ডিজঅর্ডার কী?

স্বাভাবিক স্ট্রেস বা মানসিক চাপ একটি স্বল্প সময়ের মানসিক প্রতিক্রিয়া — যা আমাদের সতর্ক রাখে। কিন্তু স্ট্রেস ডিজঅর্ডার হলো এমন একটি অবস্থা, যেখানে দীর্ঘ সময় ধরে চাপ কমে না, বরং শরীর ও মন দুটোতেই স্থায়ী পরিবর্তন আনে।

মনোবিজ্ঞান অনুযায়ী, সাধারণত তিন ধরনের স্ট্রেস ডিজঅর্ডার দেখা যায়—

১. অ্যাকিউট স্ট্রেস ডিজঅর্ডার

২. ক্রনিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার

৩. ট্রমা-সম্পর্কিত উদ্বেগ বা পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার

চিকিৎসকের মূল্যায়ন ছাড়া নির্দিষ্ট করে বলা যায় না, তবে সাধারণ মানসিক চাপ কতক্ষণ স্থায়ী হচ্ছে এবং তার শারীরিক-মানসিক প্রভাব কতটা গুরুতর — এই দুই বিষয় নির্ধারণ করে এটি রোগে রূপ নিচ্ছে কি না।

যেসব উপসর্গ স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের দিকে নির্দেশ করে

জার্নাল অব ক্লিনিকাল সাইকিয়াট্রি-তে প্রকাশিত একটি গবেষণা বলছে, দীর্ঘস্থায়ী স্ট্রেস শরীরের কর্টিসল স্তরকে ব্যাহত করে। এর ফলে দেখা দিতে পারে—

>> মাথা ঘোরা, মাথা ব্যথা>> ঘুমের ব্যাঘাত বা দুঃস্বপ্ন>> বিরক্তি, আকস্মিক রাগ>> মনোযোগ কমে যাওয়া>> হঠাৎ হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া>> হঠাৎ ক্ষুধা কমে যাওয়া বা অতিরিক্ত খাওয়া>> একা থাকতে ইচ্ছে করা>> দৈনন্দিন কাজে আগ্রহ হারানো

যদি এসব উপসর্গ একটানা কয়েক সপ্তাহ থাকে এবং দৈনন্দিন কার্যক্রমে বাঁধা সৃষ্টি করে, তবে সেটি সাধারণ চাপ নয়, বরং স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের লক্ষণ হতে পারে।

কেন হয় স্ট্রেস ডিজঅর্ডার?

আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞান জানায়, দীর্ঘমেয়াদি চাপ মস্তিষ্কের তিনটি অংশে প্রভাব ফেলে। অ্যামিগডালা, যা ভয় ও স্ট্রেস প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে; হিপোক্যাম্পাস, যা স্মৃতি ও শেখার অংশ এবং প্রিফ্রন্টাল করটেক্স, যা সিদ্ধান্ত নেওয়া, যুক্তি, আত্মনিয়ন্ত্রণ কন্ট্রোল করে।

চাপ বেশি হলে অ্যামিগডালা অতিরিক্ত সক্রিয় হয়ে পড়ে, আবার প্রিফ্রন্টাল করটেক্স দুর্বল হয়। ফলে ভাবনাচিন্তা অস্পষ্ট হয়, ভয় বাড়ে, আবেগ নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে যায়।

এ ছাড়া অমেরিকান সাইকোলজিকাল অ্যাসোসিয়েশন-এর গবেষণা দেখায় - অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম, টক্সিক কর্মক্ষেত্র, ঘুমের ঘাটতি, সম্পর্কের টানাপোড়েন, আর্থিক অনিশ্চয়তা - এসবই স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের ঝুঁকি বাড়ায়।

স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি

দীর্ঘদিন ধরে স্ট্রেস ডিজঅর্ডার এর চিকিৎসা না হলে কিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন —

>> উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগ>> পাকস্থলীর সমস্যা ও আইবিএস>> স্মৃতিভ্রংশ বা মনোযোগ কমে যাওয়া>> বিষণ্নতা ও অ্যাংজাইটি>> বার্নআউট>> রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া>> তাই উপসর্গ দেখা দিলেই অভ্যাস পরিবর্তন জরুরি।

কীভাবে স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের ঝুঁকি কমাবেন?

১. নিয়মিত ঘুম ঠিক রাখা: নেচার-এর গবেষণা বলছে, পর্যাপ্ত ঘুম স্ট্রেস-হরমোন নিয়ন্ত্রণ করে।

২. স্ক্রিন টাইম কমানো: সোশ্যাল মিডিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহার মস্তিষ্কের উত্তেজনা বাড়ায়।

৩. ব্রেথিং এক্সারসাইজ ও মেডিটেশন: ৫–১০ মিনিট গভীর শ্বাস নেওয়া স্নায়ুতন্ত্রকে শান্ত করে।

৪. হালকা ব্যায়াম: অ্যারোবিক ব্যায়াম শরীরে গুড হরমোন - এন্ডরফিন বাড়ায়।

৫. রুটিন ঠিক রাখা: কাজ, বিশ্রাম, ঘুম—সবকিছুর সময় নির্দিষ্ট রাখলে চাপ কমে।

৬. প্রয়োজন হলে কাউন্সেলিং: প্রয়োজনে সাইকোলজিস্ট বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সহায়তা সবচেয়ে কার্যকর।

কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন?

মানসিক চাপ তো জীবনে থাকবেই – এমনটা ভেবে লক্ষণ উপেক্ষা করবেন না। কারণ, চাপ কখন স্বাভাবিক থেকে রোগে পরিণত হবে তা অনেক সময় বুঝে ওঠা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই এই লক্ষণগুলো দেখলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন-

>> চাপের কারণে কাজে যেতে কষ্ট হলে

>> ঘুম না আসলে বা বারবার দুঃস্বপ্ন দেখলে

>> রাগ, কান্না বা ভয় নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে গেলে

>> শারীরিক অসুস্থতা বাড়লে

>> আত্মক্ষতির চিন্তা আসলে

এসব সমস্যা দেখা দিলে তৎক্ষণাৎ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।

স্ট্রেস আমাদের জীবনের অংশ — কিন্তু তা যেন রোগে পরিণত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। শরীরের প্রতিক্রিয়া, আচরণের পরিবর্তন, আবেগের ওঠানামা — সবকিছুর প্রতি নজর দিন। কারণ সময়মতো ব্যবস্থা নিলে স্ট্রেস ডিজঅর্ডার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, জীবন আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।

সূত্র: জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রি (২০২৪), আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন – এপিএ (২০২৩), নেচার মেডিসিন (২০২২), আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব পেডিয়াট্রিক্স – এএপি (২০২৪)

এএমপি/এমএস