চট্টগ্রাম বন্দরকে বিদেশী অপারেটরদের হাতে তুলে দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত সম্প্রতি গৃহীত হয়েছে, তা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভাগ্য এবং কৌশলগত ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ। ডেনমার্কভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান APM Terminals-কে লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল (LCT) এবং সুইজারল্যান্ডভিত্তিক Medlog SA-কে পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (PPP) মডেলের মাধ্যমে। বন্দর কর্তৃপক্ষ এই উদ্যোগকে দেশের লজিস্টিক খাতকে বিশ্বমানের দক্ষতা, আধুনিকায়ন এবং দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে নিয়ে যাওয়ার মূল চাবিকাঠি হিসেবে দাবি করছে। কিন্তু একজন সতর্ক বিশ্লেষক হিসেবে, এই তথ্যের গভীরে প্রবেশ করলে প্রতীয়মান হয় যে, এই চুক্তির আপাত সুবিধাগুলোর পেছনে লুকিয়ে আছে দীর্ঘমেয়াদী জাতীয় স্বার্থ, নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তার প্রশ্ন, যার বাস্তব মূল্যায়ন এখনও যথেষ্ট নয় এবং তা দেশের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
APM Terminals-এর পক্ষ থেকে প্রাথমিক বিনিয়োগ হিসেবে প্রায় ৮০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ৬,৭০০ কোটি টাকা) দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে একটি বিরাট সংখ্যা। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে এবং সরকারি অর্থের ব্যবহার ছাড়াই গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো উন্নয়ন ঘটাতে পিপিপি মডেলের এই দিকটি বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে খুবই আকর্ষণীয়। বন্দর কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, এর ফলে ২৪ ঘণ্টা কার্যক্রম, আধুনিক ক্রেন-ইউনিট ব্যবস্থাপনা, জাহাজ বার্থিং টাইম হ্রাস এবং সামগ্রিক লজিস্টিক খরচ কমানো সম্ভব হবে। উন্নত প্রযুক্তি, দক্ষ ব্যবস্থাপনা নীতি এবং বৈশ্বিক শিপিং লাইনগুলোর সঙ্গে সরাসরি সংযোগের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপারেটররা বাংলাদেশের পণ্যকে আন্তর্জাতিক বাজারে আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলতে পারে। এটি স্বল্পমেয়াদী অর্থনৈতিক দক্ষতা এবং তারল্য প্রবাহ নিশ্চিত করার একটি সুস্পষ্ট পথ।
কিন্তু এই সুবিধার আর্থিক ন্যায্যতা তখনই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়, যখন আমরা এই বিনিয়োগের প্রকৃত কৌশলগত ব্যয় দীর্ঘমেয়াদে বিচার করি। মাত্র $৮০০ মিলিয়ন এককালীন বিনিয়োগের বিনিময়ে যদি দেশের অর্থনীতির প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত একটি কৌশলগত সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ ৩০ বছরেরও বেশি সময়ের জন্য হস্তান্তর করা হয়, তবে প্রতি বছর দেশের রাজস্ব ক্ষতি, কৌশলগত নিয়ন্ত্রণচ্যুতি এবং লাভের একটি বড় অংশ বিদেশিদের হাতে চলে যাওয়ার আর্থিক হিসাবটি কি যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে? বন্দরের কৌশলগত মূল্য কেবল তার রাজস্ব আয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এর মূল্য নিরূপণ করতে হবে জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার দিক থেকেও, যা অর্থের মানদণ্ডে বিচার করা যায় না।
এই চুক্তির সঙ্গে জড়িত সবচেয়ে বড় এবং তাৎক্ষণিক উদ্বেগ হলো চুক্তির গোপনীয়তা এবং বিস্তারিত শর্তাবলী জনসমক্ষে প্রকাশ না করা। ৩০ বছর বা তার বেশি মেয়াদের এমন একটি চুক্তি, যা দেশের অর্থনীতির প্রবেশদ্বার নিয়ন্ত্রণ করবে, তার শর্তাবলী জনগণের কাছে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ হওয়া আবশ্যক। এই অস্বচ্ছতা দীর্ঘমেয়াদী নীতিগত অনমনীয়তা (Policy Lock-in) তৈরি করবে। যখন সরকার বদলাবে বা দেশে কোনো বড় রাজনৈতিক সংকট দেখা দেবে, তখন এই চুক্তিগুলো পুনরায় মূল্যায়ন বা বাতিলের প্রশ্ন উঠলে আইনি জটিলতা তৈরি হবে। চুক্তির শর্তাবলী অস্বচ্ছ থাকলে, নতুন সরকার বা নীতি নির্ধারকদের হাত বাঁধা থাকবে এবং বিদেশী অপারেটরের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে গেলে আন্তর্জাতিক আদালতে বিশাল অঙ্কের জরিমানা দিতে হতে পারে।
পাশাপাশি, রাজস্ব নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুল্ক ও ফি-র হারের নিয়ন্ত্রণ, বিশেষ করে বিদেশী মুদ্রায় অর্থ পরিশোধের ধারাগুলো নিয়ে স্বচ্ছতা না থাকলে, দেশের শুল্ক-রাজস্ব কাঠামো জটিল ও দুর্বল হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। দীর্ঘমেয়াদী চুক্তিতে বিদেশী অপারেটর প্রায়শই তাদের 'বিনিয়োগের ওপর গ্যারান্টিড রিটার্ন' চায়, যা দেশের আর্থিক খাতকে ঝুঁকিতে ফেলে। যদি অর্থনৈতিক মন্দা বা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমে যায়, তবুও সরকারকে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী অর্থ পরিশোধ করতে হতে পারে, যা জনগণের অর্থে ভর্তুকি দেওয়ার শামিল।
আন্তর্জাতিক অপারেটরশিপের দ্বিতীয় বড় ঝুঁকিটি হলো শ্রমিকদের ভবিষ্যৎ ও কর্মসংস্থান নিয়ে অনিশ্চয়তা। বাংলাদেশের বন্দরের ইতিহাসে দেখা গেছে, যখনই অটোমেশন বা বিদেশি অপারেটর এসেছে, তখনই শ্রমিক সংখ্যায় বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে এবং প্রায়শই অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। APM Terminals-এর মতো গ্লোবাল অপারেটররা তাদের প্রযুক্তি ও দক্ষতা ব্যবহার করে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে স্বয়ংক্রিয়তা বাড়াবে। এটি তাদের অপারেটিং কস্ট (Operating Cost) কমানোর মূল কৌশল। উন্নত প্রযুক্তির আগমন মানেই কম শ্রমিক এবং বেশি কাজ, যার ফলে স্থানীয় হাজার হাজার শ্রমিকের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। স্থানীয় শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা এবং জীবন-জীবিকা কীভাবে নিশ্চিত করা হবে, সেই বিষয়ে চুক্তিতে কী কী সুরক্ষা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, তা জানা জরুরি। শ্রমিক সুরক্ষা নিশ্চিত না হলে এই উন্নয়ন শেষ পর্যন্ত স্থানীয় সমাজে বড় ধরনের বৈষম্য ও অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
চট্টগ্রাম বন্দর কেবল বাণিজ্য নয়, এটি একটি কৌশলগত সমুদ্রিক গেটওয়ে হিসেবে বিবেচিত। এটি সামরিক লজিস্টিক, আঞ্চলিক ট্রানজিট রুট এবং নৌ-পথের নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। এই বন্দরে বিদেশি অপারেটরের অধিক নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও নৌ কৌশলগত স্বাধীনতার ওপর প্রশ্ন তুলে আনবে। এ অঞ্চলে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে, একটি প্রধান সমুদ্রবন্দরকে বিদেশী শিপিং জায়ান্টদের হাতে তুলে দেওয়া দেশের কৌশলগত অবস্থানকে দুর্বল করতে পারে। ইতিহাসে দেখা গেছে, বিভিন্ন দেশের বন্দরের উপর অতিরিক্ত বিদেশি নিয়ন্ত্রণ ভবিষ্যতে সেই দেশের রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছে।
এছাড়াও, চট্টগ্রাম বন্দর কেবল বাণিজ্য নয়, এটি একটি কৌশলগত সমুদ্রিক গেটওয়ে হিসেবে বিবেচিত। এটি সামরিক লজিস্টিক, আঞ্চলিক ট্রানজিট রুট এবং নৌ-পথের নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। এই বন্দরে বিদেশি অপারেটরের অধিক নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও নৌ কৌশলগত স্বাধীনতার ওপর প্রশ্ন তুলে আনবে। এ অঞ্চলে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে, একটি প্রধান সমুদ্রবন্দরকে বিদেশী শিপিং জায়ান্টদের হাতে তুলে দেওয়া দেশের কৌশলগত অবস্থানকে দুর্বল করতে পারে। ইতিহাসে দেখা গেছে, বিভিন্ন দেশের বন্দরের উপর অতিরিক্ত বিদেশি নিয়ন্ত্রণ ভবিষ্যতে সেই দেশের রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছে।
জাতীয় নিরাপত্তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তথ্য নিরাপত্তা। বন্দর ব্যবস্থাপনায় শুধু লোড-আনলোড নয়, রয়েছে অত্যন্ত সংবেদনশীল বন্দর-নেভিগেশন ডেটা, শিপ-কন্ট্রোল, কাস্টমস তথ্য এবং আন্তর্জাতিক লজিস্টিকস সংক্রান্ত তথ্য। যদি এসব ডেটার নিয়ন্ত্রণ বিদেশি অপারেটর বা গ্লোবাল কোম্পানির হাতে চলে যায়, তাহলে তথ্য নিরাপত্তা (Data Security) এবং এর সঙ্গে দেশের অর্থনীতির গোপনীয়তা ঝুঁকিতে পড়বে। বিদেশি কোম্পানিগুলোর হাতে দেশের বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চলে গেলে তা দেশের বাণিজ্যিক সুবিধা রক্ষার ক্ষেত্রেও বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে।
বাংলাদেশ এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে—একদিকে বিশ্বমানের দক্ষতা, প্রযুক্তি এবং বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগের হাতছানি, অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ, শ্রমিক সুরক্ষা, নীতিগত নমনীয়তা এবং জাতীয় নিরাপত্তার ঝুঁকি। আশাবাদীরা বলছেন, এই চুক্তির মাধ্যমে স্থানীয় কর্মীরা প্রশিক্ষণ এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পাবে। কিন্তু আশা আর বাস্তবতার মধ্যে একটি সঠিক ভারসাম্য রক্ষা করা আবশ্যক। গ্লোবাল অভিজ্ঞতা দরকার, কিন্তু যদি তা জাতীয় নিয়ন্ত্রণ এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত না করে আসে, তবে স্বল্পমেয়াদী উন্নয়ন হয়তো অর্জিত হবে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
এই জটিল পরিস্থিতিতে, সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হলো অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে বিনিয়োগ প্রয়োজন, কিন্তু তা যেন দেশের কৌশলগত স্বার্থকে বিপন্ন না করে। বন্দরের দক্ষতা বাড়ানো অপরিহার্য, তবে সেই দক্ষতা অর্জনের মূল্য যদি হয় দেশের সার্বভৌমত্বের একটি অংশের নিয়ন্ত্রণ, তবে তা হবে চরম ভুল। নীতিনির্ধারক, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী এবং সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই চুক্তিগুলোর শর্তাবলী অবিলম্বে জনসমক্ষে প্রকাশ করা এবং জাতীয় স্বার্থ রক্ষাকারী ধারাগুলো নিশ্চিত করা উচিত। চুক্তিটিকে কেবল একটি আর্থিক লেনদেন হিসেবে না দেখে, এটিকে একটি কৌশলগত জাতীয় সম্পদ ব্যবস্থাপনার দলিল হিসেবে দেখা উচিত। নিয়ন্ত্রণ, শ্রমিক সুরক্ষা এবং জাতীয় স্বার্থ – এই তিনটি বিষয় নিশ্চিত করেই কেবল বিদেশী অপারেটরদের সাথে কাজ করা উচিত। অন্যথায়, চট্টগ্রাম বন্দর দেশের জন্য গর্ব না হয়ে, জাতীয় প্রতিকূলতার এক স্থায়ী প্রতীক হয়ে উঠবে।
লেখক: “দ্য আর্ট অব পার্সোনাল ফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট, আমি কি এক কাপ কফিও খাবো না, দ্য সাকসেস ব্লুপ্রিন্ট ইত্যাদি বইয়ের লেখক, করপোরেট ট্রেইনার, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্র্যাটেজিস্ট। hossain.shaiful@gmail.com
এইচআর/এমএস