লিভার এমন এক অঙ্গ, যা নীরবে কাজ করে আমাদের শরীরকে টক্সিনমুক্ত রাখে। এই অঙ্গ খাবার হজমে সাহায্য করে, শক্তি সঞ্চয় করে, এমনকি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকেও সহায়তা করে। কিন্তু এই অঙ্গটি যখন দীর্ঘদিন ধরে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে, তখন ধীরে ধীরে জমতে থাকে দাগ—যাকে বিজ্ঞানীরা বলেন সিরোসিস।
সমস্যা হলো, বাংলাদেশে লিভারের রোগকে অনেক সময় অবহেলা করা হয়, ফলে দেরিতে ধরা পড়ে এবং প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে।
লিভার সিরোসিস কী?
লিভারের কোষে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি হলে সেখানে দাগ বা স্কার টিস্যু তৈরি হয়। এই দাগ ক্রমে জমতে জমতে স্বাভাবিক টিস্যুকে প্রতিস্থাপন করে ফেলে। লিভার তখন আর আগের মতো কাজ করতে পারে না — এটাই সিরোসিস। এটি ধীরে ধীরে এগোয়, তাই অনেকে বুঝতেই পারেন না যে তাদের লিভার ঝুঁকিতে।
এটি কেন হয়?
লিভার সিরোসিসের অনেক কারণ আছে। সবচেয়ে কমন কারণগুলেঅ জেনে নিন—
১. হেপাটাইটিস বি ও সি: বিশেষ করে হেপাটাইটিস বি আমাদের দেশে অনেক বেশি
২. অতিরিক্ত অ্যালকোহল: দীর্ঘদিন মদ্যপান লিভার কোষ ভেঙে দেয়
৩. ফ্যাটি লিভার: ওজন বৃদ্ধি, ডায়াবেটিস ও অস্বাস্থ্যকর খাবার থেকে ফ্যাটি লিভারের শুরু
৪. বংশগত রোগ
৫. ওষুধ বা টক্সিনের প্রভাব
৬. অটোইমিউন লিভার ডিজিজ
কখন এটি প্রাণঘাতী হতে পারে?
সিরোসিস শুধু একটি রোগ নয় — এটি লিভারের ‘ফাইনাল স্টেজ’। এই অবস্থায় যে জটিলতাগুলো দেখা দিতে পারে সেগুলোই জীবনকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়। যেমন -
>> লিভার ফেইলিউর: এ সময় লিভার কাজ বন্ধ করে দেয়।
>> ইসোফেজিয়াল ব্লিডিং: খাদ্যনালিতে রক্তক্ষরণ হলে তা হঠাৎ প্রাণঘাতী হতে পারে।
>> অ্যাসাইটিস: পেটে পানি জমে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে।
>> লিভার ক্যানসার: দীর্ঘমেয়াদি সিরোসিসে ক্যানসারের ঝুঁকি অনেক বেশি।
>> ব্রেইন ফাংশন কমে যাওয়া বা হেপাটিক এনসেফালোপ্যাথি: বিভ্রান্তি, অচেতনতা, এমনকি রোগী কোমা পর্যন্ত চলে যেতে পারে।
এসব কারণেই সিরোসিসকে বিশেষজ্ঞরা সাইলেন্ট কিলার বলেন। কারণ লিভার অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত খুব বেশি লক্ষণ দেখা দেয় না। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রায়ই কোনো লক্ষণ না থাকলেও পরে দেখা দিতে পারে—
>> ক্ষুধামন্দা, বমিভাব
>> সবসময় ক্লান্তি
>> পেট ফুলে থাকা
>> পা ফুলে যাওয়া
>> ত্বক ও চোখ হলুদ হওয়া বা জন্ডিস
>> চুলকানি
>> নাক-মুখ দিয়ে সহজে রক্ত পড়া
>> ওজন কমে যাওয়া
এগুলো দেখা দিলে দেরি না করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যাওয়া জরুরি।
কীভাবে সচেতন হওয়া যায়?
তবে আশার বিষয় হলো এই রোগ প্রতিরোধ সম্ভব। শুধু প্রয়োজন কিছু অভ্যাস বদলানো এবং নিয়মিত স্ক্রিনিং।
হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিন নিন। এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধ। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন, ডায়াবেটিস থাকলে নিয়ন্ত্রণ করুন। ফ্যাটি খাবার ও প্রক্রিয়াজাত খাবার কমান। অ্যালকোহল সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে চলুন।
সেই সঙ্গে প্রতি বছর রক্ত পরীক্ষা করুন। অযথা ওষুধ খাবেন না। অনেক ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ব্যথানাশক, হারবাল বা কবিরাজি ওষুধে লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ঝুঁকি থাকলে গ্যাস্ট্রোলজিস্টের নিয়মিত ফলোআপ নিন।
লিভার সিরোসিস হঠাৎ আসে না। এটি বছরের পর বছর ধরে লিভারকে দুর্বল করে। তাই এই রোগ প্রতিরোধের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র হলো সচেতনতা, সময়মতো স্ক্রিনিং এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তন। আধুনিক চিকিৎসায় সিরোসিসের জটিলতা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব, কিন্তু দেরিতে ধরা পড়লে ঝুঁকি অনেক বেশি।
সূত্র: ডব্লিউএইচও গ্লোবাল হেপাটাইটিস রিপোর্ট ২০২৪; আমেরিকান লিভার ফাউন্ডেশন সিরোসিস ওভারভিউ ২০২৪; মায়ো ক্লিনিক লিভার সিরোসিস রিভিউ; হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল লিভার ডিজিজ রিভিউ ২০২৪; ইউসিএসএফ লিভার ডিজিজ প্রগ্রেশন স্টাডি ২০২৩
এএমপি/এমএস