গুমের মামলায় শেখ হাসিনার পক্ষে লড়তে গিয়েও আবার পিছু হটার ব্যাখ্যা দিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না। এসময় তাকে সতর্ক করে ট্রাইব্যুনাল বলেন, আইন অনুযায়ী কথা বলবেন। রাজনীতির মঞ্চে যা কিছু বলা যায়, কিন্তু আইনজীবী হিসেবে তা বলতে পারেন না।
শুনানিতে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম জ্যেষ্ঠ এ আইনজীবীর উদ্দেশে বলেন, ‘মাইন্ড ইয়োর ল্যাঙ্গুয়েজ, যা খুশি তা বলা যাবে না।’
আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে টাস্কফোর্স ফর ইন্টারোগেশন সেলে (টিএফআই সেল) গুম করে রাখার ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় বুধবার (৩ ডিসেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল–১ এ অভিযোগ গঠনের শুনানিতে এমন মুহূর্তের অবতারণা হয়।
বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন শফিউল আলম মাহমুদ ও মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সেনা কর্মকর্তাসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগে এ মামলা করা হয়। শেখ হাসিনার পক্ষে গত ২৩ নভেম্বর জেড আই খান পান্নাকে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী (স্টেট ডিফেন্স) হিসেবে নিয়োগ দেন ট্রাইব্যুনাল। তখন তিনি আওয়ামী লীগ সভাপতির পক্ষে দাঁড়াতে আগ্রহী ছিলেন।
কিন্তু পরে তিনি সিদ্ধান্ত বদলে ফেসবুকে লাইভে এসে বলেন, যে ট্রাইব্যুনালের প্রতি শেখ হাসিনার আস্থা নেই, সেখানে আমারও আস্থা নেই। এরপর তিনি মামলা থেকে সরে যাওয়ার বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারের কার্যালয় বরাবর চিঠি পাঠিয়ে জানান, তিনি রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী হিসেবে লড়তে আগ্রহী নন।
আজ মামলায় অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানির দিন জেড আই খান পান্না উপস্থিত না থাকায় ট্রাইব্যুনাল বলেন, শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী হতে তিনি একসময় আগ্রহী ছিলেন, এখন কেন আগ্রহী নন? এটা গ্রহণযোগ্য নয়। ট্রাইব্যুনালের সামনে তাকে ব্যাখ্যা করতে হবে।
তখন আদালতে উপস্থিত চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, জেড আই খান পান্নার মক্কেল শেখ হাসিনা ট্রাইব্যুনালের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন। যে কারণে তিনিও আগ্রহী নন। এটা আদালত অবমাননার শামিল।
তখন ট্রাইব্যুনাল বলেন, জেড আই খান পান্নাকে ফোন করে এখনই আসতে বলুন অথবা লোক পাঠান। এরপর ট্রাইব্যুনাল বলেন, জেড আই খান পান্নার চেম্বারে ডেপুটি রেজিস্ট্রারকে পাঠান। চেম্বারে গিয়ে বলে আসুক ওনাকে ট্রাইব্যুনালে আসতে।
তলবের ১৮-২০ মিনিট পর হুইলচেয়ারে করে ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত হন জেড আই খান পান্না। তখন ট্রাইব্যুনাল তার শারীরিক অবস্থার কথা জানতে চাইলে জেড আই খান পান্না বলেন, তিনি সুস্থ নন। শারীরিক অবস্থা ভালো না থাকায় তিনি শেখ হাসিনার পক্ষে লড়তে চান না। ব্যক্তিগত ও শারীরিক কারণেই তিনি থাকতে চান না।
সরে দাঁড়ানোর আরও কারণ ব্যাখ্যা করে জেড আই খান পান্না বলেন, শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রীয় খরচে নিযুক্ত আইনজীবী হওয়ায় তার (হাসিনার ও আওয়ামী লীগ অনুসারী) অনুসারীরা তাকে আক্রমণ করছেন। প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকেও আক্রমণ করা হচ্ছে। এ অবস্থায় তিনি ‘স্যান্ডউইচ’ হয়ে গেছেন।
এ পর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, আসামি আসবে না, আপনারাও আসবেন না, যাদের নিয়োগ দেওয়া হবে, তাদের নিয়ে কথা বলা হবে।
এ পর্যায়ে জেড আই খান পান্না ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তারপর ট্রাইব্যুনাল গুমের দুটি মামলায় জেড আই খান পান্নার পরিবর্তে আমির হোসেনকে শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী নিয়োগ দেন।
আমির হোসেন ট্রাইব্যুনালে এর আগেও জুলাই হত্যাকাণ্ডের মামলায় শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী ছিলেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের সেই মামলায় ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেন।
আজ শুনানিতে জেড আই খান পান্নার আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, তার আসামি ট্রাইব্যুনালের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয় বলে তিনি (পান্না) মামলা লড়বেন না, এটা আদালত অবমাননার শামিল। আবার তিনি বিএনপি নেতা ফজলুর রহমানের হয়ে এই ট্রাইব্যুনালে লড়তে চান। তিনি ট্রাইব্যুনালকে যা-তা মনে করেন।
তখন ট্রাইব্যুনাল বলেন, জেড আই খান পান্না বলতে পারেন না যে তার ‘ক্লায়েন্ট’ (শেখ হাসিনা) যা মানেন না, তিনি সেখানে যাবেন না। তিনি ট্রাইব্যুনালের চেয়ে ক্লায়েন্টকে (শেখ হাসিনা) বড় মনে করেন কি না?
ট্রাইব্যুনাল আরও বলেন, জেড আই খান পান্না অসুস্থ হলে সেটা বিবেচনায় নেওয়া হবে। বিচারক ও রায়কে সমালোচনা করা যাবে। কিন্তু আদালত মানবেন না, আইন মানবেন না, এটা আশা করা যায় না। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে ‘আপার হেন্ড’ (ঊর্ধ্বে অবস্থান) দিয়েছে সংবিধান।
এ পর্যায়ে জেড আই খান পান্না কিছু একটা বলতে যান। তখন পান্নার উদ্দেশে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল বলে ওঠেন, ‘মাইন্ড ইয়োর ল্যাঙ্গুয়েজ, যা খুশি তা বলা যাবে না।’
জেড আই খান পান্না তখন বলেন, যা খুশি তা তো তিনি বলেননি।
এ পর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, আইন অনুযায়ী কথা বলবেন। রাজনীতির মঞ্চে যা কিছু বলা যায়, কিন্তু আইনজীবী হিসেবে তা বলতে পারেন না।
তখন ট্রাইব্যুনাল কাকে এ মামলায় স্টেট ডিফেন্স হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যায় সে বিষয়ে জেড আই খান পান্নার মতামত চান। তিনি কোনো মতামত না দিলে ট্রাইব্যুনাল আমির হোসেনের কাছে জানতে চান—স্টেট ডিফেন্স হতে তার কোনো আপত্তি আছে কি না। জবাবে আমির হোসেন বলেন—ট্রাইব্যুনাল ফিট মনে করলে নিয়োগে তার নিজের কোনো আপত্তি নেই।
এরপর গুমের মামলায় অভিযোগে গঠন বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের শুনানি শেষে আসামিপক্ষের শুনানির জন্য আগামী ১৪ ডিসেম্বর দিন ঠিক করেন আদালত।
এফএইচ/এমকেআর/এমএস