সাহিত্যতত্ত্বের উদ্ভব ও বিকাশের গতিপথ খুঁজতে গেলে আমরা দেখব যুগে যুগে নানা ধারা-বৈশিষ্ট্য বা তত্ত্বের সৃজন ঘটেছে। ‘অধ্যয়নযোগ্য কোনও বিষয়ের ধারণাগত ভিত্তিই হলো তত্ত্ব।’ খানিকটা গভীরে খুঁজতে গেলে দেখব, ‘সাহিত্যতত্ত্ব হলো সাহিত্য হিসেবে আমরা যা পড়ি তার ধারণাগত দিক।’
আর ‘সাহিত্যতত্ত্বের ব্যবহারিক দিক হলো সাহিত্য সমালোচনা।’গ্রিকযুগের প্লেটো কিংবা এরিস্টটলের সাহিত্যতত্ত্ব, মাইমেসিস থিওরি, ইটালির হোরেস কিংবা লঙ্গিনাসের সাবলাইম তত্ত্ব, পরবর্তীকালে ধারাবাহিকভাবে চলে এসেছে নিওক্লাসিসিজম, রোমান্টিসিজম, নিউ ক্রিটিসিজম, ফরমালিজম বা আঙ্গিকবাদ, বাখতিনিজম, রিডারস রেসপন্স থিওরি, স্ট্রাকচারালিজম বা কাঠামোবাদ, পোস্ট স্ট্রাকচারালিজম ও বিনির্মাণবাদ, মার্কসীয় সাহিত্যতত্ত্ব, মনোসমীক্ষণবাদী সাহিত্যতত্ত্ব, নারীবাদী সাহিত্যসমালোচনা সর্বোপরি আধুনিকতাবাদ ও উত্তর আধুনিকতাবাদ। অর্থাৎ দেখা যায় ভাবনাতত্ত্ব, যুক্তিবাদ, রিয়ালিজম, সুররিয়ালিজম, ম্যাজিক রিয়ালিজম, সেন্টিমেন্টালিজম কিংবা রোমান্টিক যুগের কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে কোথাও সাহিত্যের সংজ্ঞা স্থায়ীভাবে আসন গ্রহণ করে থাকেনি। তবে একেকটা মতবাদ একেক দিকে আলো ছড়িয়েছে। সাহিত্যতত্ত্ববিদেরা এসব মতবাদ জানেন, আগ্রহী লেখকেরাও এসবের ভেতর থেকে নিজের দৃষ্টিভঙ্গিকে উন্নত করতে পারেন, করেনও। সাধারণ পাঠকের কি এগুলো জানা উচিত, বা জানার প্রয়োজন আছে?
প্রয়োজন থাকুক কিংবা না থাকুক, উল্লিখিত মতবাদ থেকে অন্তত দুটি বিষয়ে প্রাসঙ্গিক কারণে আলোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে। প্রথমে তুলে ধরছি নিওক্ল্যাসিসিজম বিষয়ে―শব্দটির অর্থ হলো, ‘ক্ল্যাসিকসের ভিত্তিতে দাঁড় করানো সাহিত্যভাবনা।’
মূলত গ্রিক ও রোমান কথাকারদের সাহিত্যভাবনা বা সাহিত্যতত্ত্ব নিয়ে গড়ে উঠেছে নিওক্ল্যাসিসিজম বা নব্যধ্রুপদীবাদ। ওই কালটাকে সাহিত্যবিষয়ক ফতোয়ার কালও বলা যেতে পারে। এ সময় কোনটা সাহিত্য বলে বিবেচিত হবে তা মূলত নির্ভর করত গ্রিক ও রোমান ক্ল্যাসিক পণ্ডিতদের গ্রহণ ও বর্জনের ওপর। ওই সময়টি সাহিত্য-শাসনের যুগ হলেও ক্ল্যাসিকসের অন্ধ অনুকরণ সাহিত্যে কল্পনার জায়গা ব্যাপকভাবে সংকুচিত করে ফেলে নিওক্ল্যাসিকাল যুগ। ফলে বিপুল শক্তিধর তাত্ত্বিকদের এই চর্চার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণার মধ্য দিয়ে জন্ম হলো ‘রোমান্টিসিজম’ নামের নতুন সাহিত্যভাবনা বা সাহিত্যতত্ত্ব। শব্দটির উদ্ভব হয়েছে রোম (Rome) থেকে। রোমের লাতিন থেকে উদ্ভব হয়েছে ইউরোপের অনেক ভাষা―যেমন পর্তুগিজ, স্প্যানিশ, ফরাসি, ইতালিয়ান ইত্যাদি। সব কটি ভাষাকে এক নামে রোমান্স (Romance) ভাষা বলা হয়।
‘রোমান্স’ শব্দটি ইতালির রাজধানী রোম বলয় থেকে বেরিয়ে একটি সাহিত্যধারার মুকুট পরে নেয়। এই ধারায় অবিশ্বাস্য বীরের গল্প থাকত, সতী নারীর প্রেমের বিষয় থাকত, জিন-পরি জগতের চরিত্ররাও হাজির হতো। আজগুবি, কল্পিত, যুক্তিহীন বানানো কাহিনি থাকত। সাহিত্যে এ সময়কালটা মধ্যযুগীয়, রেনেসাঁস-এর আগের। এসব আখ্যান পাঠককে আনন্দ দিত, আজগুবি আর কল্পনাজাত বলে কেউ এগুলো ছুড়ে ফেলে দেয়নি, মিথ্যা বা যুক্তিহীনতার দায়ে অভিযুক্তও করেনি। কিন্তু নিওক্ল্যাসিকাল যুগে যা কিছু কল্পনায় সৃজন করা হয়েছে, লালন করা হয়েছে তাকেই মূর্খতা উপাধি দিয়ে বর্জন শুরু হয়েছিল। অপরদিকে ক্ল্যাসিকাল যুগের যুক্তিবুদ্ধিচর্চাকে সাহিত্য ও সমাজ দুইয়ের জন্য আবশ্যিক করে তুলেছিল। প্লেটো-অ্যারিস্টটলের মাইমেসিস থিওরিকে খানিকটা চ্যালেঞ্জ করল। মাইমেসিস থিওরিতে অ্যারিস্টটল যেমন বলেছেন, ‘সাহিত্য হলো জীবন ও জগতের অনুকৃতি (imitation)’― তাঁদের এই ক্ল্যাসিকাল এবং নিওক্ল্যাসিকাল মতাদর্শকে আমূল পাল্টে দিয়ে রোমান্টিকরাই কল্পনায় সৃজনক্ষমতা অবলম্বন করে সর্বপ্রথম দেখিয়ে দিল যে, সাহিত্যের কাজ অনুকরণ নয়; সৃজনও।
মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এখানে উল্লেখ করার প্রয়োজন এই যে, কল্পনাশক্তি এবং সৃষ্টিশীল ক্ষমতা মানুষের মেধার উপাদান, অঙ্গ। মেধার অন্যান্য অনুষদের মধ্যে আছে মেমোরি, অর্থপূর্ণ উপলব্ধি এবং যুক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা, সমস্যার সমাধান এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। একজন সৃজনশীল লেখক এসব অনুষদ ব্যবহার করে সৃজন করতে পারেন যাপিত সমাজে জীবনঘনিষ্ঠ আখ্যান, অমর সাহিত্যভান্ডার।
রবীন্দ্রনাথ কিংবা লঙ্গিনাসের যুগের কথা স্মরণ করে বলতে চাই, সাহিত্যে মানবমনের প্রতিধ্বনি ঘটে, হোক সেটা কল্পিত, হোক বাস্তব প্রেক্ষাপট থেকে নির্মিত, হোক ঐতিহাসিক ঘটনা বা জীবনভিত্তিক কিংবা ভৌতিক-হরর।কল্পনাশক্তি প্রসঙ্গে রোমান্টিসিজমের যুগের তাত্ত্বিক কোলরিজ তাঁর বায়োগ্রাফিয়া লিটারেরিয়া গ্রন্থে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি বলার চেষ্টা করেছেন, কল্পনার উদ্ভব-প্রক্রিয়ার প্রাথমিক ধাপে রয়েছে ‘স্মৃতি’। বর্তমান অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলেমিশে একরকম নতুন নকশা তৈরি করে স্মৃতির ভাণ্ডারে রক্ষিত তথ্য-উপাত্ত। কোলরিজ এই স্তরের নাম দিয়েছেন ‘ফ্যান্সি’ বা কল্পনা। তিনি আরও বলেছেন, এই কল্পনা পৃথিবীর সব মানুষেরই আছে। তাহলে কবির কল্পনা কী? তাঁর মতে, ‘কবির কল্পনা হলো কল্পনার দ্বিতীয় স্তর, বিকশিত স্তর। এ স্তরে মনে জমে থাকা অন্য সকল বস্তু ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে বর্তমান অভিজ্ঞতাকে জারিত করে, দ্রবীভূত করে লীন করে দেয় এবং এসবের মাধ্যমে সৃষ্টি করে নতুন এক রূপ যা স্মৃতির বস্তু নয়, কিংবা বর্তমান অভিজ্ঞতাও নয়।’
‘রোমান্স’ শব্দটি ইতালির রাজধানী রোম বলয় থেকে বেরিয়ে একটি সাহিত্যধারার মুকুট পরে নেয়। এই ধারায় অবিশ্বাস্য বীরের গল্প থাকত, সতী নারীর প্রেমের বিষয় থাকত, জিন-পরি জগতের চরিত্ররাও হাজির হতো। আজগুবি, কল্পিত, যুক্তিহীন বানানো কাহিনি থাকত। সাহিত্যে এ সময়কালটা মধ্যযুগীয়, রেনেসাঁস-এর আগের। এসব আখ্যান পাঠককে আনন্দ দিত, আজগুবি আর কল্পনাজাত বলে কেউ এগুলো ছুড়ে ফে লে দেয়নি, মিথ্যা বা যুক্তিহীনতার দায়ে অভিযুক্তও করেনি। কিন্তু নিওক্ল্যাসিকাল যুগে যা কিছু কল্পনায় সৃজন করা হয়েছে, লালন করা হয়েছে তাকেই মূর্খতা উপাধি দিয়ে বর্জন শুরু হয়েছিল।
এটাই কি কল্পনাশক্তি? সাহিত্যজগতে প্রচলিত ক্রিয়েটিভ ইমাজিনেশনের সঙ্গে মিলছে কি? পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের সহযোগিতা ছাড়াই ব্রেনে বা মনে আচমকা যে আইডিয়া বা ভাবনাতরঙ্গের উদয় ঘটে সেটাই কল্পনা, সৃজনশীল কল্পনাশক্তি―এমনটাই প্রচলিত আছে বর্তমান সাহিত্যজগতে। ঐতিহাসিক সূত্রের সঙ্গে মিলুক কিংবা না মিলুক আমরা লক্ষ্য করেছি ইংরেজ রোমান্টিকেরা অনুকরণের পরিবর্তে সৃজনে নামলেন। ‘যাপিত জীবনের দুঃখ-জ¦রা, যন্ত্রণা, ক্লান্তি থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রত্যেকে একটি আদর্শজগৎ নির্মাণের চেষ্টায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন অপরিমেয় কল্পনাশক্তি ব্যবহার করে।’ তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কিটস, শেলি, কোলরিজ প্রমুখ দুনিয়ার শীর্ষ রোমান্টিক কবিগণ। তাঁরাও ‘আমিময়’ হয়ে যাবার দোষে কটাক্ষের শিকার হলেন। তাঁদের মধ্যে বাস্তবতা থেকে পলায়নপর মনোবৃত্তির উদয় ঘটেছে―এমন সমালোচনার মধ্য দিয়ে জন্ম হলো নিউ ক্রিটিসিজম।
এ প্রসঙ্গে জেনে রাখা ভালো, ইংরেজিতে ক্রিয়েটিভ শব্দটি বেশ প্রচলিত। ক্রিয়েট থেকে এসেছে ক্রিয়েটিভ। ক্রিয়েট ক্রিয়াপদটার মানে হচ্ছে সৃষ্টি করা, মৌলিক কিছু সৃষ্টি করা, মৌলিক সত্যের উন্মোচন করা, মৌলিক পথ নির্মাণ করে সামনের জটিল পথ সহজ করা। সৃষ্টিশীলতার সঙ্গে আরও কয়েকটি শব্দের যোগসূত্র রয়েছে। শব্দগুলো হচ্ছে প্রতিভা, মেধা, বুদ্ধি। প্রতিভাবানেরাই সাধারণত হয়ে থাকেন মেধাবী, বুদ্ধিদীপ্ত। প্রতিভার মূল উপাদান হচ্ছে স্মৃতিশক্তি, কল্পনাশক্তি, সৃজনশীলতা, অর্থপূর্ণ উপলব্ধি ও ধারণা বিশ্লেষণের নৈপুণ্য, যুক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা ও দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার যোগ্যতা। প্রতিভার এসব উপাদানও সাহিত্য সৃজনে প্রভাব রাখে―প্রমাণিত হয়েছে। প্রশ্ন হলো কোন সাহিত্য-মতবাদে এসব বিষয় আলোচিত হয়েছে, বিশ্লেষিত হয়েছে? ধাপে ধাপে আমরা উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব।
এসব বিতর্ক এবং উপরে উল্লিখিত মতবাদগুলোর সংজ্ঞা এবং বিস্তৃত ব্যাখ্যা এড়িয়ে ছোট পরিসরে এই গ্রন্থের ভূমিকায় আমরা রবীন্দ্রনাথের কথার দিকে মনোযোগ দিতে পারি। তাঁর অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ কথার একটির সারমর্ম হলো, ‘জীবনের সহিত যা সম্পর্কিত তা-ই সাহিত্য!’ এখানে ‘সহিত’ শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ। কেবল জীবনচিত্র কিংবা জীবনকাহিনিই কি সাহিত্য? উপন্যাসে অবশ্যই জীবনচিত্র থাকবে আর জীবনের মধ্যে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে মন আর বিজ্ঞান, সমাজ-সংস্কৃতি, ধর্ম। তাহলে দেখা যাচ্ছে জীবনের সঙ্গে জড়িত মন-বিজ্ঞান, দৃশ্যমান সমাজ এবং না-দেখার বাইরেও আছে আরও কিছু। সেই আরও কিছুটা কী? সৃজনশীলতা, সৃষ্টিশীল কল্পনা কিংবা ক্রিয়েটিভ ইমাজিনেশন নয়? রোমান্টিক যুগের কবিদের মত হলো কবিতার প্রকৃত স্রষ্টা কবিকল্পনা―এটি ফ্যান্টাসি নয়, কল্পনাশক্তি। তাঁদের মতে কবিকল্পনা আসলে সৃজনশীল প্রক্রিয়া বা সৃজনশীল কল্পনা আর রবীন্দ্রনাথ কল্পনাকে আরও বিশাল শক্তিধর মনোক্রিয়া হিসেবে দেখেছেন। রোমান্টিক যুগের মতাদর্শের কয়েকটি ক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করে তিনি বলেছেন, ‘প্রতিটি মানুষের রয়েছে কল্পনাশক্তি।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘যে শক্তির দ্বারা বিশ্বের সঙ্গে আমাদের মিলন কেবল ইন্দ্রিয়ের মিলন না হয়ে মনের হয়ে ওঠে সেই শক্তি হচ্ছে কল্পনাশক্তি।’ অর্থাৎ স্মৃতি, অভিজ্ঞতা নির্ভরতা কিংবা কেবল অলৌকিক কবিকল্পনা ইত্যাদি বিতর্কের যে কোনও আঙ্গিক বিশ্লেষণ করে বলা যায়, এই কল্পনা হচ্ছে মনেরই শক্তি, মনেরই অঙ্গ, উপাদান। মনেরই বিপুল শক্তির উদ্গিরণ।এখানেও আলোচিত গ্রিক সাহিত্যতত্ত্ববিদদের মাইমেসিস থিওরি কিংবা জীবনজগতের অনুকরণবাদ এই তথ্যের আলোকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। আমরা দেখছি উপন্যাসের পাতায় পাতায় উঠে আসে যাপিত জীবনের কাহিনি। সেই সঙ্গে আনন্দ-বেদনা- ভালোবাসা, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, রাগ-ক্রোধ, ঈর্ষা-হিংসা কিংবা প্রতিহিংসার মতো আবেগ।
মানবমনের অন্তর্জগৎ ও চারপাশের মধ্যে রয়েছে বিজ্ঞানের সামঞ্জস্যপূর্ণ যোগাযোগ, যোগসূত্র। এর ভেতরেই প্রচ্ছন্নভাবে লুকিয়ে আছে মনোবৈজ্ঞানিক উপাদান এবং সাহিত্যে প্রকাশিত মানবমনের প্রতিটি ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াই মনোবৈজ্ঞানিক সূত্রের অন্তর্ভুক্ত। এখানে বলে রাখা ভালো, প্রাসঙ্গিকও― আলোচনায় তুলে ধরা এবং আলোচনার বাইরের সব সাহিত্যমতবাদের ভেতরেই মনস্তাত্ত্বিক সূত্র কিংবা তত্ত্বের প্রতিধ্বনি রয়েছে―নিউরোসায়েন্স, বিহেভিয়ারাল, কগনিটিভ বা কনশাস স্ট্রিম অফ থটস, সাইকোডায়নামিক কিংবা হিউনিস্টিক মতবাদ―প্রতিটি মনস্তাত্ত্বিক থিওরিই সাহিত্যমতবাদের প্রাণের ভেতরের প্রাণ হিসেবে উৎসারিত হয় যা বিশ্লেষণ করেছেন আমাদের রবীন্দ্রনাথ, লঙ্গিনাস এবং অ্যারিস্টটলও। সাহিত্যতত্ত্বের নানামুখী আলোচনা- সমালোচনার রেশ টেনে ধরে একই সঙ্গে আমরা নজর দিতে পারি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিখ্যাত একটি উক্তির দিকে―‘সাহিত্যের কোনও শর্ত নেই।’
বর্তমান সময়েও সাহিত্য বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একজন পণ্ডিত হলেন জ্যাঁক দেরিদা। তিনি ছিলেন দর্শনের অধ্যাপক। গুরুত্বপূর্ণ আরেকজন ব্যক্তিত্ব হলেন জ্যাক লাকাঁ। তিনি ছিলেন মনোচিকিৎসক। আর স্ট্রাকচারালিজমের জনক ক্লদ লেভি স্ট্রস ছিলেন নৃবিজ্ঞানের পণ্ডিত। সাহিত্যতত্ত্ব বিষয়ে তাঁরা অবশ্যপাঠ্য নাম। তিনজনই সাহিত্যে দর্শন, মনোবিজ্ঞান ও স্ট্রাকচারালিজমের কথা তুলে ধরেছেন।তাহলে সাহিত্যতত্ত্বের উৎপত্তিস্থল কোথায়?
সমাজ-জীবন-মন, এককথায় মনোসামাজিক মূল্যবোধ, সোশ্যাল কগনিশন, কাঠামোবদ্ধ সামাজিক দর্শন নয়? এমন হাইপোথিসিস দাঁড় করানো যায় না?
এ কারণেই লঙ্গিনাসের মূল কথাকে সামান্য বদলে বলা যায়, সাহিত্য রচনার উৎকর্ষ হচ্ছে মানবমনের প্রতিধ্বনি, শৈল্পিক স্বর। কথাটা মনস্তাত্ত্বিকভাবেও যৌক্তিক―উপন্যাসে ব্যবহৃত আবেগ, চিন্তা, প্রত্যক্ষণ, মোটিভেশন, সামাজিক অভিজ্ঞান বা সোশ্যাল লার্নিংয়ের কারণে বদলে যেতে পারে প্রত্যক্ষণ প্রক্রিয়া, বদলে যেতে পারে চারপাশ প্রত্যক্ষ করার ধরন, চিন্তনে ঢুকে যেতে পারে ত্রুটি, নানামুখী আবেগের প্রকাশ কিংবা বিস্ফোরণ ঘটে যেতে পারে চরিত্র থেকে চরিত্রের মনোজগতে। এভাবে উপন্যাসের মধ্যে ঘনীভূত হতে পারে মনস্তাত্ত্বিক উপাদান, জটিল জীবন, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, আলাদা ভাষিক ইঙ্গিতময় সংকেত, সাহিত্যশিল্প। আর তা ঘটে থাকে লেখকের মেধার গুণে, কেবল অনুকরণে নয়। এখানে উল্লেখ করা আবারও প্রাসঙ্গিক যে মেধা মনেরই অঙ্গ।
এই সাহিত্যশিল্প ‘কনশাস স্ট্রিম অব থটস’, মনস্তাত্ত্বিক মতবাদ কগনিটিভ থিওরি ও ফ্রয়েডের সাইকোডাইনামিক থিওরিকেও প্রতিধ্বনিত করে, চেতন-অবচেতন কিংবা নির্জ্ঞান মন বিশ্লেষণ করে। সমাজ-সংস্কৃতিকেও। তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকটও সাহিত্যের মনোজাগতিক অনুষদ হিসেবে সমকালীন বিশ্বসাহিত্যকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
দুই.উপরের আলোচনা থেকে আমরা বেশ বুঝতে পারছি সাহিত্যে যুগে যুগে নানা তত্ত্ব বা ধারা কিংবা বৈশিষ্ট্য এসেছে। নির্মম সমালোচনার পরও কোনও ধারা উচ্ছেদ হয়ে যায়নি। কিন্তু যুগের ধারায় কোনও নির্মাণশৈলীকে হেয় বা তুচ্ছ করা হয়নি, তবে প্রত্যেকের সময়কালে নতুন ধারা সৃজনকারীদের কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। অথচ আপন বৈশিষ্ট্য নিয়ে নদীর মতো প্রবাহমান আছে সাহিত্য। উপন্যাস মূলত সময়ের মনস্তত্ত্ব। সমাজ যেমন বদলায় উপন্যাসও তেমনি রূপান্তরিত হয়। তাই সমকালীন সাহিত্যের পণ্ডিতগণ সাহিত্য-আসরে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বা শেষকথা হিসেবে ঘোষণা করতে পারেন না যে বর্তমানে সাহিত্যে শুধুমাত্র তিনটি ধারা রয়েছে: সিরিয়াস, জনপ্রিয় ও বিকল্প ধারা। এ ধরনের বক্তব্য সাধারণত ব্যক্তিগত মত বা সরলীকৃত শ্রেণিবিভাগ হতে পারে, তাত্ত্বিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ‘ধারা’ নয়।
‘সাহিত্যে শুধু তিনটি ধারা রয়েছে’―এই কথাকে ‘টানেল ভিশন’ বা সীমাবদ্ধ ব্যক্তিগত বক্তব্য হিসেবেও ধরে নেওয়া যায়। ব্যক্তির মতকে উড়িয়েও দেওয়া যায় না, আবার চূড়ান্ত রায় হিসেবে গ্রহণ করাও যায় না। প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যতত্ত্ব অনুযায়ী সাহিত্যধারার বিভাজন আরও বহুস্তর ও বিবর্তনশীল―যেমন ঘরানা, রীতি, স্টাইল, যুগ, মতাদর্শ, উত্তর- ঔপনিবেশিক বা আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি, এমনকি পাঠকের রিসেপশনের ওপরও নির্ভর করে।
আরেকটু স্পষ্ট করে বলা যায়, ‘সিরিয়াস বনাম জনপ্রিয়’-এই সরল শ্রেণিকরণ অবশ্যই সমীচীন নয়―এটা আসলে reception-based বিভাজন। কিন্তু সাহিত্যে ‘বিকল্পধারা’র বিষয়টা গ্রহণযোগ্য। গতানুগতিক সৃজন থেকে সরে গিয়ে যুগে যুগে লেখকগণ বিকল্পধারা তৈরির চেষ্টা করেছেন। এই উদ্যোগকে সমালোচকগণ মাঝে মাঝে বলে থাকেন experimental or avant-garde। কিন্তু ‘সাহিত্যের শুধু তিনটি ধারা রয়েছে’―এমন তত্ত্ব কোনও স্বীকৃত সাহিত্য সমালোচনায় প্রতিষ্ঠিত নয়।
তিন.সাহিত্যতত্ত্বে ‘ধারা’ কীভাবে প্রতিষ্ঠা পায়?ব্যক্তিগত মতামতের ভিত্তিতে সহজ বিভাজনের মাধ্যমে ধারা প্রতিষ্ঠা পেতে পারে, যেমনটা উপরে তুলে ধরা হয়েছে। এই বক্তব্যকে অসম্মানিত করছি না, যুক্তির খাতিরে শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, আরও আছে তাত্ত্বিক বা স্বীকৃত বিভাজন; রীতি বা সাহিত্যশৈলী (Form, Style); যুগ বা আন্দোলন যেমন Romanticism, Modernism; মতাদর্শিক ধারা যেমন Marxist, Feminist, সাইকোডাইনামিক কিংবা মনস্তত্ত্ব; ন্যারেটিভ স্ট্র্যাটেজি; পোস্টমডার্ন, উত্তরাধুনিক বিষয়গুলোও সাহিত্যের ধারা নির্ণয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
‘সাহিত্যের ধারা শুধু লেখকের গুরুত্ব বা জনপ্রিয়তার ওপর নির্ভর করে না, বরং তা নির্ধারিত হয় ভাষা, বর্ণনাশৈলী, তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট, এমনকি পাঠকের ব্যাখ্যার মধ্য দিয়েও। আগেই বলা হয়েছে সাহিত্য অনেক বেশি প্রবহমান। তাত্ত্বিকভাবে সাহিত্যধারা অনেক বিস্তৃত ও বহুমাত্রিক। একে তিন ভাগে সীমাবদ্ধ করলে ঐতিহাসিক কাল থেকে চলমান সাহিত্যতত্ত্বের সামগ্রিকতা ধরা পড়ে না।
সাহিত্য ধারার school of thought বোঝাতে হলে রোমান্টিক, রিয়ালিস্টিক, এক্সিস্টেনশিয়াল, সুররিয়ালিস্টিক, ম্যাজিক রিয়ালিজম, পোস্টমডার্ন... এসব বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে। এই যুগেও এসব ছাড়া সাহিত্য ভাবা যায় না।আবারও বলছি, ‘সাহিত্যে কেবল তিনটি ধারাই রয়েছে’, বক্তব্যটা এককভাবে ব্যক্তিগত শ্রেণিকরণ (categorization) মাত্র, সামগ্রিকভাবে গ্রহণযোগ্য তাত্ত্বিক শ্রেণিবিভাগ নয়। আলোচনায় এটা ব্যক্তিগত মত হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে, শেষকথা বা চূড়ান্ত রায় হিসেবে নয়।
চার.নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে জমজমাট সাহিত্য-আসরে দেশের দুজন খ্যাতিমান লেখকের সাহিত্যকে শ্রেণিবিভাগ করেছেন এসময়ের একজন সাহিত্যিক। সেই মতামতকে অশ্রদ্ধা না করে বলছি, হুমায়ূন আহমেদ ও ইমদাদুল হক মিলনকে কেবল ‘জনপ্রিয় ধারার লেখক’ হিসেবে সরলিকরণ করা হলে সাহিত্যতাত্ত্বিকভাবে তা অসম্পূর্ণ। সাহিত্যিকের গুরুত্ব কেবল পাঠকসংখ্যা দিয়ে মাপা যায় না। হুমায়ূন আহমেদ যেমন জনপ্রিয় ছিলেন, তেমনি বাংলা উপন্যাসে মনস্তত্ত্ব, ভাষার সহজীকরণ এবং আধুনিক চরিত্র নির্মাণে তিনি দারুণ অবদান রেখেছেন। তাঁকে কেবল জনপ্রিয়তা দিয়ে বিচার করলে তাঁর সাহিত্য-প্রতিভা ও ধারা সংকুচিত হয়ে যাবে। ‘জনপ্রিয়’ আর ‘গুরুত্বপূর্ণ’―দুইটি শব্দ একে অপরের বিপরীত নয়। বরং অনেক সময় জনপ্রিয় লেখকরাই সাহিত্যে নবতর প্রবণতা তৈরি করেন। হুমায়ূন আহমেদ জনপ্রিয় ছিলেন, কিন্তু সেই জনপ্রিয়তাই বাংলা কথাসাহিত্যে নতুন এক পাঠক সমাজ গড়ে দেয়, যা নিজেই একটি সাহিত্যিক ধারা। তাই তাঁকে ‘জনপ্রিয়’ বলে দাগিয়ে দেওয়া ঠিক না―বরং বলা যেতে পারে তিনি ‘জনপ্রিয়তা অর্জনকারী গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক’। একই কথা ইমদাদুল হক মিলনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।”
সাহিত্যতত্ত্বে ‘popular’ শব্দটি অনেক সময় sociological category হিসেবেও ব্যবহৃত হয়, কিন্তু সাহিত্যিকের তাত্ত্বিক অবস্থান নির্ধারণে প্রয়োগ করা হয় না। উদাহরণ হিসেবে টলস্টয়, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, এমনকি ও.হেনরিও বহু সময় জনপ্রিয় ছিলেন―কিন্তু তাঁরা মূলত canonical with high literature-এর অংশীদার। ‘জনপ্রিয়’ হওয়া আর শুধু ‘জনপ্রিয় সাহিত্যিক’ হওয়াও এক নয়। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন ‘পাঠক-নির্মাতা’ লেখক। তাঁর মতো করে বাংলা ভাষা সহজ করে কেউ লেখেননি। তাঁকে শুধু জনপ্রিয় বললে সাহিত্যই আপত্তি করবে।’‘Literature is not great because it is popular; it becomes popular because something in it is great.’ যুক্তরাজ্যের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক ও সাহিত্যসমালোচক Terry Eagleton-এর সাহিত্য ভাবনাও গুরুত্বপূর্ণ, এই আলোচনায় তুলে ধরা প্রাসঙ্গিক।
পাঁচ.প্রযুক্তির উৎকর্ষতার কারণে মুহূর্তিক বিনোদনের নানা উপকরণ এখন হাতের মুঠোয়। ফলে সাহিত্য পাঠের প্রতি মনোযোগী হতে পারছি না আমরা অনেকেই। সাহিত্যের পাঠকও কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সাহিত্যশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে সাহিত্যিকদের সচেতন হতে হবে, পাঠক তৈরির দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। কেবল মহান সাহিত্য সৃষ্টি করে আত্মতৃপ্তিতে ভুগে সাহিত্যের জমিনে অহংকারী হয়ে উঠলে দায়ভার শেষ হয়ে যায় না। আসুন নতুন নতুন পাঠক সৃষ্টি এবং বইমুখী প্রজন্ম গড়ে তুলতে আন্দোলন গড়ে তুলি। আসুন দুই/তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সি শিশুদেরও কল্পনার রথে চড়ে তাদের মনোজগৎ ছুঁয়ে সাহিত্য নির্মাণ করি, কিংবা ৬ থেকে ১২ বছরের শিশুদের জন্য নির্মাণ করি কল্পনা এবং বুদ্ধির মিশেলে ভিন্নতর সাহিত্যধারা। আসুন তাদের কৌতূহলী মন জাগিয়ে তুলি। কৈশোরের মনোজগতের গতিপ্রকৃতি বুঝেও যদি সাহিত্য রচনা করা যায়, রচিত যে হচ্ছে না, তা নয়। হচ্ছে, তা পাঠ করলে নেটের নেশামুক্ত থাকতে সৃজনশীল পথ পেয়ে যাবে তারা। নেশায় ডুবে যাওয়ার পথে বাধা হিসেবে কাজ করবে পাঠ-প্রিয়তা। এসব শিশুসাহিত্য বড়রা পড়েও মজা পেয়ে থাকে। বয়সভিত্তিক লিখলেও তা সামগ্রিক বয়সকেও প্রভাবিত করে, আলোড়িত করে। আসলে আমাদের সবার মধ্যেই বাস করে মৌলিক এক শিশু যে ধীরে ধীরে জেগে ওঠে এবং দৃশ্যমান জগতে সফল হয়, নিজস্ব মেধার উজ্জ্বলতা থেকে আলো পেয়ে নায়ক হয়ে বেঁচে থাকে।
কৃতজ্ঞতা : সহায়ক গ্রন্থ সমূহ১. মুহম্মদ মুহসিন, সাহিত্যতত্ত্ব : একটি সংক্ষিপ্ত পরিক্রমা; ঐতিহ্য, প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২. বদিউর রহমান, পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব: সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, হোরেস, লঙ্গিনাস; ঐতিহ্য, ডিসেম্বর ২০২৩৩. হীরেন চট্টোপাধ্যায়, সাহিত্যতত্ত্ব: প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্য; দে’জ পাবলিশিং, দ্বিতীয় সংস্করণ : আগস্ট ২০১৬৪. Paul Harrison, Philip Cowen, Tom Burns, Mina Fazel, Shorter Oxford Textbook of Psychiatry; Oxford university press 17 edition 2018৫ .Andrew B. Crieder et al, Psychology; Herper 1993 Collins college publishers ৬. Denis Green Berger & Padesky CA; Mind Over Mood; the Guilford, inc. New York 1995
লেখক : কথাসাহিত্যিক, বাংলা একাডেমি ফেলো ।
এইচআর/এমএস