মোহাম্মদ আবদুল্লাহ মজুমদার
বাংলাদেশের অন্যতম পার্বত্য জেলা বান্দরবানের পূর্বপ্রান্তে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী দুর্গম পাহাড়ি এলাকার একটি দৃশ্য। এলাকাটি থানচি উপজেলার বঙ্কুপাড়া। গাড়ির জানালার একপাশ দিয়ে ঢুকে অন্যপাশ দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে মেঘ। সাপের মতো আকৃতির সড়ক বেয়ে গাড়ি উঠছে ওপরের দিকে। ৩ হাজার ফুটের বেশি উঁচুতে। যেখানে মেঘের শীতল পরশ বুলিয়ে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখা যায় মেঘ। চারপাশে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। যেগুলোর চূড়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা সাদা মেঘ। একবার সেখানে গেলে ফিরে আসতে বারণ করে মন।
সেখানে গাড়িতে যেতে থানচি উপজেলা শহর থেকে সময় লাগে প্রায় ৩ ঘণ্টা। যেখানে দেশের বড় বড় পাহাড়গুলো অবস্থিত। দুর্গম এই এলাকায় সড়কের একপাশে মিয়ানমার, অন্যপাশে বাংলাদেশ। দেখতে প্রায় একই রকম। ভারতের মিজোরাম প্রদেশের পার্শ্ববর্তী রাঙ্গামাটি জেলার জুরাছড়ি উপজেলার সাইচল এলাকাও। রাঙ্গামাটির রাজস্থলী উপজেলা সদর থেকে সীমান্ত সংযোগ সড়ক দিয়ে ফারুয়া হয়ে গাড়িযোগে এ এলাকায় পৌঁছতে লাগবে প্রায় ৩ ঘণ্টা। যাওয়ার সময় পাহাড়ের চূড়ায় সবুজের বিন্দু ও উপত্যাকায় ঠাসা সবুজ আবহ যে কারোরই মন কেড়ে নেবে।
সাইচল এলাকায় একসময় কোনো সড়ক ছিল না। চিকিৎসা কিংবা কোনো কাজে জেলা শহর যেতে হলে পায়ে হেঁটে যেতে হতো সেখানকার বাসিন্দাদের। অসুস্থ হলে কাঁধে করে নিয়ে যেতে হতো। এখন সড়ক নির্মাণ হওয়ায় মানুষের আসা-যাওয়া বেড়েছে। দুর্গম পাহাড়ে যারা বাস করতেন; তারা এখন সড়কের কাছাকাছি চলে এসেছেন। এখনো সেখানে গড়ে ওঠেনি কোনো পর্যটনকেন্দ্র।
এলাকাটি প্রাকৃতিকভাবেই পর্যটনকেন্দ্র হয়ে আছে। সেখানে নতুন করে অবকাঠামো তৈরি না করলেই প্রকৃতির জন্য আশীর্বাদ। শুধু পর্যটকদের নিরাপত্তা, বাসস্থান ও খাবারের ব্যবস্থা হলেই দেশ-বিদেশের পর্যটকেরা ছুটে যাবেন সেখানে। সরকার চাইলে উদ্যোগ নিতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এ রকম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তুলে আয় করছে বৈদেশিক মুদ্রা।
আরও পড়ুনশীতে ঘুরে আসুন পৃত্থিমপাশা জমিদারবাড়ি পর্যটনের বিকাশে দেশীয় চলচ্চিত্রের ভূমিকা
সেখান থেকে রাঙ্গামাটি সদরে আসা-যাওয়ায় প্রায় ৫-৬ দিন লাগতো। এখন সীমান্ত সংযোগ সড়ক ব্যবহার করে কয়েক ঘণ্টায় আসা-যাওয়া করা যায়। এলাকার দৃশ্যগুলো ছবির মতো সুন্দর। সড়ক যেহেতু হয়ে গেছে। এখন প্রশাসন পরিকল্পনা করে কাজ করতে পারে। যথাযথ উদ্যোগ নিয়ে পর্যটন সুবিধা গড়ে তুললে সড়কটি শুধু যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকবে না। আন্তর্জাতিক পর্যটকের আনাগোনায় এটি বাংলাদেশের সক্ষমতা ও সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে উঠবে।
একজন পর্যটক ফেনী হয়ে রামগড়, তারপর সেখান থেকে শুরু করে ৩ পার্বত্য জেলার সীমান্তবর্তী সড়ক দিয়ে ঘুমধুম পৌঁছাবেন। সেখান থেকে পরে মেরিন ড্রাইভ সড়ক দিয়ে কক্সবাজার পৌঁছতে পারবেন অতি সহজেই। সীমান্ত পর্যটনের ধারণা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হলেও বাংলাদেশ বা আশপাশের জন্য খুবই নতুন। এর জন্য দায়ী দক্ষিণ এশিয়ার উত্তপ্ত পররাষ্ট্রনীতি। সীমান্ত পর্যটন বলতে বোঝায়, দুটি দেশের সীমানার কাছাকাছি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বা ঐতিহাসিক স্থানগুলো ঘুরে দেখা।
কক্সবাজারের নাফ নদী, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া, মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল, কুমিল্লা ও ফেনীর বিভিন্ন স্থানের মতো স্থানগুলো বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় সীমান্ত পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে উঠে আসছে। যা নিরাপদ ও পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠলে আন্তর্জাতিক পর্যটনে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। এটি শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ নয় বরং দুই দেশের মিলনস্থল বা সীমান্তের ভিন্ন জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতিকে কাছ থেকে দেখারও সুযোগ করে দেওয়া যায় সীমান্ত পর্যটনের মাধ্যমে।
নদী, পাহাড়, চা-বাগান এবং ভিন্ন ভিন্ন ভূ-প্রকৃতির কারণে বাংলাদেশের সীমান্ত পর্যটন খুবই সমৃদ্ধ। সীমান্ত এলাকার স্থানীয় নৃ-গোষ্ঠীর জীবনযাত্রা ও ঐতিহ্য পর্যটকদের আকর্ষণ করে এটি। নিরাপত্তা ও সীমান্তে মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে পরিকল্পিত পর্যটন স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙা করতে সহায়তা করে।
লেখক: পর্যটন বিশ্লেষক।
এসইউ