খাদ্যদূষণ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এই সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় কার্যক্রম বাস্তবায়ন সংক্রান্ত প্রস্তাবনা আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে লিখিত আকারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
রোববার (৭ ডিসেম্বর) দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় খাদ্যে বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি ও এর প্রেক্ষাপটে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি মোকাবিলায় কার্যক্রম গ্রহণ এবং খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধের লক্ষ্যে তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে তিনি এই নির্দেশনা দেন।
বৈঠকে খাদ্যবাহিত রোগ, দূষণ সম্পর্কিত ঝুঁকি এবং এ সংকট মোকাবিলায় করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, খাদ্যে বিভিন্ন দূষণের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমরা জানি; এটাকে কীভাবে মোকাবিলা করা যায়, সেই ব্যবস্থা আমাদের নিতে হবে। আমাদের সন্তান, বাবা-মা, আপনজন সবাই এর ভুক্তভোগী। নিজেদের স্বার্থেই আমাদের সবাইকে একসঙ্গে এই সংকট মোকাবিলায় কাজ করতে হবে। বাস্তবায়নের দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নেবো কোনটি এখনই শুরু করা জরুরি। এ বিষয়ে জরুরি উদ্যোগগুলো আমরা তাৎক্ষণিকভাবে নেবো।
এসময় সংশ্লিষ্ট প্রত্যেককে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে খাদ্যদূষণ সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় কার্যক্রম বাস্তবায়ন সংক্রান্ত প্রস্তাবনা লিখিত আকারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
বৈঠকে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কিছু তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়। তারা জানান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী বছরে খাদ্যবাহিত রোগে প্রতি বছর ১০ জনের মধ্যে এক জন শিশু বছরে অন্তত একবার অসুস্থ হয়। খাদ্যবাহিত রোগে আক্রান্ত ৩ শতাংশের ১ শতাংশ শিশু মৃত্যুবরণ করে। খাদ্যবাহিত রোগে প্রতি বছর বিশ্বে ৬০ কোটি এবং বাংলাদেশে ৩ কোটি শিশু আক্রান্ত হয়।
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ জানায়, খাবারে চার ধরনের দূষক থাকতে পারে। ভারী ধাতু, কীটনাশক-জীবনাশক এর অবশিষ্টাংশ, তেজস্ক্রিয়তা ও জৈবদূষক। গত অর্থবছর ১ হাজার ৭১৩টি এবং এ বছর এ পর্যন্ত ৮১৪টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এতে অতিরিক্ত মাত্রায় পাওয়া গেছে সিসা/সিসা ক্রোমেট। মোট ১৮০ নমুনার মধ্যে ২২টিতে সিসা শনাক্ত হয়েছে।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ইউএমইএ সুইডেন এর যৌথ গবেষণায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পানির ৮৭টি ও মাছের ২৩টি নমুনা সংগ্রহ করে ৩০০ ধরনের ওষুধ, ২০০ ধরনের কীটনাশক, ১৬ ধরনের পিএফএএস শনাক্ত করা হয়।
ইউনিসেফের এক জরিপে জানা গেছে, বাংলাদেশে সাড়ে ৩ কোটি শিশু সীসার সংক্রমণে আক্রান্ত। এ তথ্য তুলে ধরে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জাকারিয়া বলেন, সিসা মানবদেহে প্রবেশ করে মস্তিষ্ক, যকৃৎ, কিডনি, হাড় এবং দাঁতে জমা হয়। শিশুদের হাড় নরম হওয়ায় সিসা সরাসরি মস্তিষ্কে চলে যায়। ফলে শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
এছাড়া, গবেষণায় ৫ শতাংশ গর্ভবতী নারীদের মধ্যেও সীসার সংক্রমণ পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি। সীসার সংক্রমণ কমিয়ে আনতে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনায় ১০ বছরের কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী সায়েদুর রহমান জানান, বাংলাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ল্যাব আছে। শিক্ষার্থীদের এ ধরনের পরীক্ষা করার ক্যাপাসিটিও রয়েছে। খাদ্যে সিসার পরিমাণ নিয়ে একটি সমন্বিত গবেষণা করে খুব দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
বৈঠকে খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা হাঁস-মুরগি, দুগ্ধজাত খাদ্য ও মাছের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশকারী ক্ষতিকারক পদার্থ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন। তারা জানান, হাঁস-মুরগির খামারগুলোতে অনিয়ন্ত্রিত ওষুধ প্রয়োগ হয়। মুরগিকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হলে তা ৭ থেকে ২৮ দিন পর্যন্ত থেকে যায়। ২৮ দিন পার হওয়ার আগেই মুরগিকে বাজারজাত করা হলে সেই মুরগির মাংসের মাধ্যমে মানবদেহে অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক ঢুকতে পারে।
তারা জানান, বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতে এসব বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন হলেও কিছু চোরাগোপ্তা কোম্পানি কর্তৃপক্ষের নজরদারি এড়িয়ে গোপনে অনিয়ন্ত্রিতভাবে পোল্ট্রি ফার্ম পরিচালনা করছে।
পোল্ট্রি ফার্মগুলোকে নজরদারিতে আনা এবং কৃষিতে অবৈধ কীটনাশকের ব্যবহার রোধে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং আরও কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে সে বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।
খাদ্য উপদেষ্টা বলেন, পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য নিশ্চিত করতে গিয়ে কখনো কখনো যা খাচ্ছি তা নিরাপদ কি না সে দিকটি উপেক্ষা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরিতে গণমাধ্যমগুলো ভূমিকা রাখতে পারে। খাদ্য নিরাপত্তা একটি জরুরি বিষয়। পাঠ্যপুস্তকে এ বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রয়োজন বলেও জানান তিনি।
বৈঠকে কৃষি ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব সিরাজ উদ্দিন মিয়া, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) এর মহাপরিচালক এস এম ফেরদৌস আলম, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফারুক আহম্মেদ, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের (বিএফএসএ) চেয়ারম্যান জাকারিয়া ও পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মো. মজিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
এমইউ/ইএ/এমএস