আইন-আদালত

সরাসরি গুমের নির্দেশ দিতেন হাসিনা-তারিক সিদ্দিকী: চিফ প্রসিকিউটর

আওয়ামী লীগের আমলে ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গুমের ‘সরাসরি নির্দেশ’ দিতেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার প্রতিরক্ষা বিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকী। এমন মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।

গুমের ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় সেনা কর্মকর্তা ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত শেখ হাসিনাসহ ১৩ আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের আবেদন জানিয়ে শুনানির পর রোববার (৭ ডিসেম্বর) চিফ প্রসিকিউটর সাংবাদিকদের সঙ্গে এমন কথা বলেন।

আদালতে এদিন রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্রসিকিউটর মোহাম্মদ মিজানুল ইসলাম, প্রসিকিউটর আব্দুস সোবহান তরফদার, শহীদুল ইসলাম সরদার, সুলতান মাহমুদ, প্রসিকিউটর আব্দুস সাত্তার পালোয়ান ও প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ। অন্যাদিকে, আসামিপক্ষের শুনানিতে ছিলেন স্টেট ডিফেন্স হাসান ইমাম, উপস্থিত তিন আসামির পক্ষে আবেদন করেন আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু ও ব্যারিস্টার মাহিন এম. রহমান।

মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ এনে প্রসিকিউশন পক্ষে অভিযোগ গঠনের আবেদন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে শুনানিতে তিনি এ মন্তব্য করেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

বিগত সরকারের শাসনামলে সংঘটিত গুমসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে করা মামলায় শেখ হাসিনাসহ আসামিদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের ওপর পরবর্তী শুনানি মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) অনুষ্ঠিত হবে।

জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল (জেআইসি) বা আয়নাঘরে গুম-নির্যাতনের ঘটনায় করা মামলায় শেখ হাসিনা, তারেক সিদ্দিকী, পলাতক ডিজিএফআইয়ের সাবেক ৪ মহাপরিচালক ও গ্রেফতার তিন আসামি ও সেনা সদস্যসহ ১৩ জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। এদিন গ্রফিতার ৩ সেনা কর্মকর্তাকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। তারা হলেন হলেন-ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান সিদ্দিকী ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভির মাজাহার সিদ্দিকী।

এ মামলায় শেখ হাসিনাসহ পলাতক ১০ আসামি হলেন-শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষা বিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) লে. জেনারেল (অব) মোহাম্মদ আকবর হোসেন, সাবেক ডিজি মেজর জেনারেল (অব) সাইফুল আবেদিন, লে. জেনারেল (অব) মো. সাইফুল আলম, সাবেক ডিজি লে. জেনারেল তাবরেজ শামস চৌধুরী, সাবেক ডিজি মেজর জেনারেল (অব) হামিদুল হক, মেজর জেনারেল তৌহিদুল ইসলাম, মেজর জেনারেল কবির আহাম্মদ ও লে. কর্নেল (অব) মখসুরুল হক।

শুনানিতে তাজুল ইসলাম বলেন, গুমের সরাসরি নির্দেশ দিতেন শেখ হাসিনা। এ ছাড়াও গুমের নির্দেশ দিতেন শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষাবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক।

তিনি জেআইসি সেলে সরকারবিরোধী ঘরানার লোকদের তুলে নিয়ে গুম-নির্যাতনের ভয়াবহ বর্ণনা তুলে ধরেন। একইসঙ্গে ২০১৫ সালের ২২ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত গুম হওয়া ২৬ জনের বীভৎসতার কথাও সামনে আনেন। এসব ঘটনায় পাঁচটি অভিযোগ এনে এ মামলায় ১৩ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন বা বিচার শুরুর আবেদন করেন চিফ প্রসিকিউটর।

এদিকে, স্টেট ডিফেন্স ও গ্রেফতার তিন আসামির পক্ষে সময় চাইলে শুনানির জন্য ৯ ডিসেম্বর দিন ঠিক করেন ট্রাইব্যুনাল।

তদন্ত প্রতিবেদন এবং সাক্ষ্য প্রমানের ভিত্তিতে দেখা যায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সামরিক ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা আসামি মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ বিভিন্ন মাধ্যমে তার য়ন্ত্রণাধীন ডিজিইএর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমে ২০১৫ সালের ২২ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ৬ আগস্ট এর মধ্যে বিভিন্ন তারিখ ও সময়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) আব্দুল্লাহিল আযমী, ম. মারুফ জামান, হুম্মাম কাদের চৌধুরী, ইকবাল চৌধুরী, লে. কর্ণেল মো. হাসিনুর রহমান বীর প্রতীক (অব.), মাইকেল চাকমা, শেখ মো. সেলিম, শেখ মো. আবু সালেম (লিটন), নাজিম উদ্দীন, মো. কামরুল হাসান কাজল, মো. সোহেল রানা, মাওলানা আব্দুল হাকিম ফরিদী, মো. মোস্তাক্ষ্য মজুমদার, শেখ ইবতিসাম আহম্মেদ ওরফে সমি, আবু জার গিফারী, তাজুল ইসলাম সুমন, মো. নুরে আলম, সৈয়দ আকিদুল আলী, মো. আশরাফ আলী, মো. নুরুল ইসলাম নজরুল, মো. রাজিবুল ইসলাম, মো. ফয়েজ, মেড রেজওয়ান মাহমুদ অনিক, মো. খোরশেদ আলম পাটোয়ারী, সৈয়দ সাদাত আহম্মেদ এবং মো. বাবুল মিয়াসহ আরো অনেককে অপহরনপূর্বক গুম করে ডিজিএফআই এর অধীন জেআইসিতে আটকে রেখে নির্যাতন করে।

এদের মধ্যে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) আদুল্লাহিল আমান আযমী ও মাইকেল চাকমাকে ২৪ সালের ৫ আগষ্ট পরবর্তী সময় মুক্তি দেওয়া হয়।

ভিকটিমদের মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন তারিখে আটক করে ডিজিএফআই এর বন্দিশালা অয়নাঘর অর্থাৎ জেআইসিতে এবং ডিজিএফআই-এর অন্যান্য বন্দিশালায় গুম করে রাখা হয়।

ডিজিএফআই এর বন্দিশালা অর্থাৎ, আয়নাঘরে গুম করে রাখা ব্যাক্তিদের আটক, আটকের প্রক্রিয়া, গুম করে রাখার সময় তাদের ওপর চালানো নির্যাতনের ভয়াবহতা ও বীভৎসতা বুঝতে হলে আমাদের গুমের শিকার ব্যাক্তিদের আটক থেকে মুক্তি দেওয়ার এবং আটক রাখার স্থানের বর্ণনা জানা জরুরি।

তদন্ত প্রতিবেদনে আরও উঠে আসে, গুমের শিকার ব্যাক্তিদের বর্ণনা অনুযায়ী তাদের নিজ বাসা-বাড়ি, কর্মস্থল বা অন্য কোনো সুবিধাজনক স্থান (যা গুমের টিমের সদস্যরা নির্ধারণ করত) থেকে আটক করা হতো। আটক করার পরপরই অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের চোখ বেঁধে ফেলা হত। তারপর তাদের নিকটবর্তী স্থানে রাখা কোনো মাইক্রোবাস বা যানবাহনে জোর করে তুলে নিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে তাদের নির্ধারিত স্থানে নিয়ে সর্বশেষ গন্তব্যস্থল আয়নাঘরে নিয়ে আসা হতো।

শুনানির বিষয়ে চিফ প্রসিকিউটর জানান, সেখানে তাদের অস্বাস্থ্যকর অপরিচ্ছন্ন দেওয়াল, এবড়ো-থেবড়ো, স্যাঁতস্যাঁতে অতি সংকীর্ণ ঘরে রাখা হতো। এসব ঘরে ছিল না কোনো জানালা, ছিল শুধু এক বা একাধিক অ্যাডজাস্ট ফ্যান। ছিল না আলোর ব্যবস্থা। দিন না রাত তা বোঝারও কোনো উপায় ছিল না। দেওয়া হতো না পর্যাপ্ত খাবারও। যে অপর্যাপ্ত খাবার দেওয়া হতো তা ছিল অরুচিকর অধিকাংশ ক্ষেত্রে খাওয়ার অনুপোযোগী। ছিল না যথোপযুক্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থা। টয়লেটে নিয়ে যাওয়া-আসার পথে তাদের চোখ বেঁধে রাখা হতো। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাদের চোখ এবং হাত বেঁধে রাখা হতো। চালানো হতো শারিরীক ও মানসিক নির্ঘাতন। তাদের দেওয়া হতো না উপযুক্ত পরিধেয় পোশাক।

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, এক কথায় তাদের অত্যন্ত অমানবিক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বন্দি রাখা হতো। পরবর্তী পর্যায়ে তাদের কয়েকজনকে র‌্যাবের প্রধান কার্যালয়ে ক্লিনিক নামে পরিচিত বন্দিশালায়, কয়েক জনকে র‍্যাবের বিভিন্ন বন্দিশালায় হস্তান্তর করে তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মিথ্যা মামলা দায়ের করে জেল হাজতে পাঠানো হয়। আবার অনেককে চোখ বেঁধে বন্দিশালা থেকে বের করে নিয়ে নির্জন স্থানে ছেড়ে দেওয়া হয়।

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, এসব ব্যাক্তিদের আটক ও গুম করার সিদ্ধান্ত আসতো সরাসরি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে, তার সামরিক ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা আসামি মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহামেদ সিদ্দিকীর মাধ্যমে।

আসামি তারিক আহমেদ সিদ্দিকীর নির্দেশ কার্যকর করতেন ডিজিএফআই এর ডিজি এবং তার নিয়ন্ত্রনাধীন সিটিআইবি এর পরিচালকরা। যারা তাদের অধীন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করতেন।

আসামী লে. কর্নেল (অব.) মঞ্জুরুল হক অন্য আসামি তারিক আহমেদ সিদ্দিকীর সরাসরি নির্দেশে মাঠ পর্যায়ে গুমের ভিকটিমদের চিহ্নিত করতেন। তৎপর মাঠ পর্যায়ের অন্যান্য সহযোগীদের নিয়ে তাকে অর্থাৎ গুমের ভিকটিমকে অপহরণ করে নিয়ে জেআইসি-তে নিয়ে আসতেন।

এফএইচ/এএমএ/জেআইএম