মতামত

জরিপের ফল ও জনপ্রত্যাশা

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাজে সন্তুষ্ট ৭০ শতাংশ মানুষ আর প্রধান উপদেষ্টার কাজে সন্তুষ্ট ৬৯ শতাংশ মানুষ। এ ছাড়া ভোট সুষ্ঠু হবে বলে বিশ্বাস করেন ৮০ শতাংশ মানুষ। আর আগামী জাতীয় নির্বাচনে ৩০ শতাংশ ভোটার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপিকে ভোট দেবেন। জামায়াতে ইসলামীকে ভোট দেবেন ২৬ শতাংশ ভোটার। অর্থাৎ দুই দলের মধ্যে ব্যবধান মাত্র ৪ শতাংশ। তবে জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে এগিয়ে আছে জামায়াতে ইসলামী। এ ছাড়া বর্তমানে দেশের ৫৩ শতাংশ মানুষ মনে করেন দেশ সঠিক পথে পরিচালিত হচ্ছে। আর ৪২ শতাংশ মনে করে ভুল পথে যাচ্ছে।

মার্কিন ফেডারেল সরকারের অর্থায়নে রিপাবলিকান পার্টি-ঘনিষ্ঠ অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) এক জরিপের ভিত্তিতে এসব তথ্য জানিয়েছে।

সম্প্রতি নিজেদের ওয়েবসাইটে এই জরিপের তথ্য প্রকাশ করেছে আইআরআই। ২০২৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় সিএপিআই পদ্ধতিতে সরাসরি উপস্থিত হয়ে। এই জরিপে রাঙামাটি বাদে ৬৩ জেলায় ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে ৪ হাজার ৯৮৫ জন অংশ নেন। তাদের মধ্যে পুরুষ ২ হাজার ৪১০ ও নারী ২ হাজার ৫৭৫ জন। জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয় গত ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত। জরিপকারীদের দাবি, এই জরিপের আস্থার পরিমাণ ৯৫ শতাংশ। তবে আরও নিশ্চয়তার ভিত্তিতে ১ দশমিক ৪ শতাংশ এদিক-সেদিক হতে পারে।

জরিপ অনুসারে, একই শর্তে, অর্থাৎ আগামী সপ্তাহে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) ভোট দেবেন ৬ শতাংশ ভোটার। জাতীয় পার্টিকে ভোট দেবেন ৫ শতাংশ ভোটার এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশকে ভোট দেবেন ৪ শতাংশ ভোটার। এবং অন্যান্য দলকে ভোট দেবেন ৮ শতাংশ ভোটার।

তবে জামায়াতে ইসলামী ভোট কম পেলেও জনপ্রিয়তার দিকে এগিয়ে রয়েছে বলে উঠে এসেছে জরিপে।

জরিপে বিভিন্ন প্রশ্নের মধ্যে একটি ছিল, দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে (৯টির নাম উল্লেখ করে) কোনটিকে আপনি পছন্দ ও অপছন্দ করেন। উত্তরে ৫৩ শতাংশ অংশগ্রহণকারী মতামত দিয়েছেন, তারা জামায়াতে ইসলামীকে পছন্দ করেন। আর ১৭ শতাংশ অংশগ্রহণকারী দলটিকে খুবই অপছন্দ করেন। বিএনপিকে মোট পছন্দকারী ৫১ শতাংশ। তাদের মধ্যে খুবই পছন্দ করেন ২৩ আর কিছুটা পছন্দকারী ২৮ শতাংশ। দলটিকে খুবই অপছন্দ করেন ২২ শতাংশ। অন্য দলগুলোর মধ্যে জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) খুবই পছন্দ করেন ৬ শতাংশ, কিছুটা পছন্দ করেন ৩২ শতাংশ। জরিপে সাধারণ অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে এই দলটিকে ভোট দিতে চান ৬ শতাংশ।

ভঙ্গুর অবস্থা থেকে দেশের অর্থনীতিকে সামাল দেওয়ার চ্যালেঞ্জ ছিল সরকারের সামনে। অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনা এবং বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার যে-সব পদক্ষেপ নিয়েছে তার প্রশংসা রয়েছে। তবে বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নয়ন না হওয়ায় দুর্বলতার কথাও সামনে আনছেন অর্থনীতিবিদরা।

আওয়ামী লীগকে খুবই পছন্দ করেন ১১ এবং খুবই অপছন্দ করেন ৪০ শতাংশ। এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশকে খুবই পছন্দ করেন ৫, জাতীয় পার্টির ৪ শতাংশ। অন্য দলগুলোর মধ্যে আমার বাংলাদেশ, গণসংহতি আন্দোলন ও গণঅধিকার পরিষদকে খুবই পছন্দকারী ১ শতাংশ করে। ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টি ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশকে বাছাই করেছেন যথাক্রমে ৫ ও ৪ শতাংশ অংশগ্রহণকারী।

জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মতামত অনুযায়ী, আগামী নির্বাচন স্বাধীন ও ন্যায্য হওয়ার ব্যাপারে খুবই আশাবাদী ৪৩ শতাংশ আর খুবই হতাশাবাদী ৫ শতাংশ। সমান যোগ্যতার নারী ও পুরুষদের মধ্যে কোন প্রার্থীকে বাছাই করবেন? এমন প্রশ্নে ৬২ শতাংশ পুরুষের পক্ষে। নারীর পক্ষে ১৬ শতাংশ। লিঙ্গীয় পরিচয় কোনো বিষয় নয়- এমনটা মনে করেন জরিপে অংশ নেওয়া ২০ শতাংশ ব্যক্তি।

দেশ সঠিক নাকি ভুল পথে : দেশের ৫৩ শতাংশ মনে করেন, দেশ সঠিক পথে পরিচালিত হচ্ছে। ৪২ শতাংশ মনে করেন ভুল পথে যাচ্ছে। ভুল পথে মনে করার ক্ষেত্রে ৩৮ শতাংশ পুরুষ, বিপরীতে ৪৬ শতাংশ নারী। আর সঠিক পথে মনে করার সংখ্যায় পুরুষ ৫৮ শতাংশ ও নারী ৪৮ শতাংশ। ভুল পথে মনে করাদের মধ্যে ৪৭ শতাংশ ৫৬ বছরের বেশি বয়সী। সঠিক পথে মনে করা সবচেয়ে বেশি বরিশালে (৬৪ শতাংশ) আর কম ময়মনসিংহে (৪১ শতাংশ)।

কোন দিক বিবেচনায় সঠিক পথে যাচ্ছে এমন প্রশ্নের উত্তরে সবচেয়ে বেশি ২০ শতাংশ মনে করেন অর্থনৈতিকভাবে। আইনশৃঙ্খলায় ১৭ শতাংশ। আর শেখ হাসিনার পদত্যাগকে দেশ সঠিক পথে পরিচালিত হওয়ার কারণ মনে করেন ৩ শতাংশ। পোশাক খাতের উন্নয়নকে কারণ হিসেবে দেখেন ১ শতাংশ অংশগ্রহণকারী।

ভুল পথে পরিচালিত হওয়ার পেছনে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিকে কারণ মনে করে ২২ শতাংশ। আইন-শৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থার অবনতিকে কারণ মনে করে ১৮ শতাংশ। অনির্বাচিত সরকারকে কারণ মনে করে ৫, মব জাস্টিস ও নারীর অনিরাপত্তাকে কারণ মনে করে যথাক্রমে ১ শতাংশ করে।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী ৪২ আর হতাশাবাদী ৩৮ শতাংশ। কিছুটা হতাশাবাদীর সংখ্যা ১১ শতাংশ। খুবই হতাশাবাদী ৬ শতাংশ। ভবিষ্যতে ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী ৫৬ শতাংশ। স্থির থাকবে বলে মনে করেন ২৬ শতাংশ।

অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ ও প্রধান উপদেষ্টা : এই জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৬৯ শতাংশ বলেছেন, ড. ইউনূস ভালো কাজ করছেন। আর ৭০ শতাংশ জানিয়েছেন, তারা অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্ট। জরিপে দেখা যায়, অন্তর্বর্তী সরকার খুব ভালো কাজ করছে বলে মনে করেন ২৬ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। কিছু ভালো কাজ করছে বলে মত ৪৪ শতাংশের। খুবই খারাপ কাজ করছে মনে করেন ১১ ও কিছুটা খারাপ কাজ করছে মনে করেন ১৫ শতাংশ।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস খুবই ভালো কাজ করছেন মনে করেন ২৬ শতাংশ। ৪৩ শতাংশ মনে করেন কিছুটা ভালো কাজ করছেন। ৯ শতাংশ মনে করে খুবই খারাপ কাজ করছেন।

প্রধান উপদেষ্টার কাজকে খুবই ভালো মনে করা ব্যক্তিদের মধ্যে ৩৩ শতাংশ উচ্চশিক্ষিত, ২৭ শতাংশ উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছেন। অর্থনৈতিকভাবে স্বাচ্ছন্দ্যে আছেন এমন মানুষের মধ্যে ৩৩ শতাংশ অধ্যাপক ইউনূসের কাজকে খুবই ভালো মনে করেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্ষমতা কোন ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো ও সবচেয়ে খারাপ? এমন প্রশ্নের উত্তরে সবচেয়ে বেশি মতামত পড়েছে সুপেয় পানির প্রাপ্যতায় (৫০ শতাংশ)। এ ছাড়া বিদ্যুতে ৪২ ও শিক্ষার উন্নয়নে ৩০ শতাংশ। আর সবচেয়ে খারাপ কার্যক্ষমতা হিসেবে ২৮ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা উল্লেখ করেছেন। বেকারত্ব দূরীকরণে সরকারের কার্যক্ষমতা দুর্বল বলে মনে করেন ২৩ শতাংশ।

বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থানের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সফলতা ব্যর্থতা নিয়ে নানা সমালোচনা রয়েছে। সরকারের সফলতা-ব্যর্থতার আলোচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে অর্থনীতি, বিচার সংস্কার এবং মব ভায়োলেন্সের মতো ইস্যুগুলো।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সবচেয়ে বড় সফলতা কী এই প্রশ্নে অর্থনীতিতে ব্যাংক, বাজার, রিজার্ভসহ সার্বিক পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য সরকার কৃতিত্ব পাচ্ছে।

তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির, মব ভায়োলেন্স, মৌলিক সংস্কার এমনকি বিচার প্রক্রিয়ার কিছু বিষয়ে সরকারের ভূমিকার নানা সমালোচনা করছেন পর্যবেক্ষক এবং বিশ্লেষকরা।

পাঁচই আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর আন্দোলনকারী সকল পক্ষের সমর্থনে অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে আটই আগস্টে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়।

অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারের সামনে সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচন অনুষ্ঠান এই তিনটি বড় দায়িত্ব ছিল।

বর্তমান সরকারের নানা সংস্কারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সংস্কার, সরকারি ক্রয় নীতিমালায় পরিবর্তন, এবং বিভিন্ন খাতভিত্তিক কমিটি গঠন (যেমন- বিদ্যুৎ ও জ্বালানি), যা নীতি ও অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বাস্তবায়ন হচ্ছে, যার লক্ষ্য স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা, যদিও কিছু সংস্কারের বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনা চলছে। এছাড়াও, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বিশেষ মর্যাদা বাতিলসহ গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাবনা রয়েছে, যা দেশের অর্থনীতি ও সুশাসনে প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে।

এছাড়া ভঙ্গুর অবস্থা থেকে দেশের অর্থনীতিকে সামাল দেওয়ার চ্যালেঞ্জ ছিল সরকারের সামনে। অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনা এবং বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার যে-সব পদক্ষেপ নিয়েছে তার প্রশংসা রয়েছে। তবে বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নয়ন না হওয়ায় দুর্বলতার কথাও সামনে আনছেন অর্থনীতিবিদরা।

সবকিছু ফেলে গণমানুষে এখন একটাই প্রত্যাশা একটি সুষ্ঠু নির্বাচন এবং নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার।

লেখক : সাংবাদিক।

এইচআর/জেআইএম