জাতীয়

রোদ পোহাচ্ছে ‘ডেইজি’, দেখতে দর্শনার্থীদের ভিড়

স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় শুক্র ও শনিবার জাতীয় চিড়িয়াখানায় দর্শনার্থীর ভিড় থাকে বেশি। বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখি দেখে আনন্দে মেতে ওঠে শিশু-কিশোররা। তবে গত শুক্রবার (৫ ডিসেম্বর) বিকেলে ঘটে ব্যতিক্রমী এক ঘটনা। হঠাৎই মূল খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসে সিংহী ‘ডেইজি’। তার উপস্থিতি টের পেয়ে পাশের খাঁচার হরিণগুলো দিগ্বিদিক ছুটতে শুরু করলেও তখনো বিষয়টি বুঝতে পারেননি দর্শনার্থীরা।

হরিণগুলোর হঠাৎ দিগ্বিদিক ছোটাছুটি দেখে সন্দেহ হয় খাঁচার দায়িত্বে থাকা ‘অ্যানিমেল কেয়ারটেকার’-এর। একটু ঘুরে দেখতেই তিনি দেখেন— হরিণের খাঁচার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে সিংহী ডেইজি। চাইলে এক লাফেই হরিণের খাঁচায় বা দর্শনার্থীদের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে সে। এ দৃশ্য দেখে কেয়ারটেকার দ্রুত চিৎকার করে দর্শনার্থীদের চিড়িয়াখানা ছাড়তে বলেন। মুহূর্তেই ১৮৬ একর আয়তনের এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। জীবন বাঁচাতে দৌড়ে বাইরে চলে যান দর্শনার্থীরা। পরে প্রায় দেড় ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে অচেতন করে ডেইজিকে খাঁচায় ফেরত নিতে সক্ষম হয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ।

এ ঘটনার পর গত ৬ ডিসেম্বর চিড়িয়াখানায় দর্শনার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কম ছিল। রোববার (৭ ডিসেম্বর) সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় চিড়িয়াখানা বন্ধ থাকে। তবে আজ সোমবার (৮ ডিসেম্বর) সকাল থেকেই স্বাভাবিকভাবে দর্শনার্থীদের উপস্থিতি দেখা গেছে। তাদের অনেকেই প্রবেশ করেই প্রথমে ছুটে যান ডেইজির খাঁচার সামনে। ডেইজি খাঁচার ভেতর ঘুরে (একাংশ উন্মুক্ত খাঁচা, আরেকাংশ ভবন) রোদ গায়ে লাগাচ্ছে।

দর্শনার্থীরা জানান, জাতীয় চিড়িয়াখানায় এমন ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। এখানে যারা আসেন, তাদের বেশিরভাগই শিশু-কিশোরদের সঙ্গে নিয়ে আসেন। নিরাপত্তায় এমন ঘাটতি থাকলে মানুষ চিড়িয়াখানার প্রতি অনীহা তৈরি করবে বলেও মন্তব্য করেন তারা। তাই ঘটনার পেছনে কারও গাফিলতি থাকলে তা তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান দর্শনার্থীরা।

চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ জানায়, সিংহী ডেইজির খাঁচা থেকে বের হয়ে যাওয়ার ঘটনায় এরই মধ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তবে প্রাথমিক তদন্তে অ্যানিমেল কেয়ারটেকারের গাফিলতি চিহ্নিত হয়েছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

কী ঘটেছিল শুক্রবারশুক্রবার (৫ ডিসেম্বর) বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে চিড়িয়াখানার লায়ন মাঠ এলাকায় থাকা একটি খাঁচা থেকে সিংহী ডেইজি বাইরে বের হয়ে যায়। তবে খাঁচার সামনে থাকা উঁচু বেষ্টনীর কারণে সে লোকালয়ে যেতে পারেনি।

চিড়িয়াখানা সূত্র জানায়, লায়ন মাঠ এলাকার খাঁচার কেচি গেট বা তালা খোলা থাকায় সিংহীটি বাইরে চলে আসে। যদিও যে স্থানে সে অবস্থান করছিল, সেখানে সাধারণ দর্শনার্থীরা প্রবেশ করেন না। পরে ‘ট্রানকুইলাইজার’ ইনজেকশন পুশ করে ডেইজিকে অচেতন করা হয়। এরপর সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে তাকে আবার খাঁচায় ফিরিয়ে নেওয়া হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে চিড়িয়াখানার এক কর্মকর্তা জানান, জাতীয় চিড়িয়াখানায় মোট পাঁচটি সিংহ ও সিংহী রয়েছে। যে খাঁচা থেকে ডেইজি বের হয়েছিল, সেখানে আরেকটি সিংহী ‘মুক্তা’ও থাকে। ডেইজির বয়স পাঁচ বছর। তার জন্য সপ্তাহে পাঁচ দিন ৭ কেজি করে গরুর মাংস বরাদ্দ থাকে, এক দিন দেওয়া হয় জীবন্ত মুরগি এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে আরেক দিন উপোস রাখা হয়। গত শনিবার থেকে অন্য দিনের মতোই ডেইজি খাওয়া-দাওয়া করছে।

সরেজমিনে সোমবার দুপুর ১২টার দিকে দেখা যায়, দর্শনার্থীরা চিড়িয়াখানায় প্রবেশ করছেন। প্রায় সবার সঙ্গেই রয়েছে শিশু-কিশোর। তারা চিড়িয়াখানার ভেতরে বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখি ঘুরে দেখছেন, অনেকে খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন। তবে সিংহীর খাঁচার সামনে গেলেই দর্শনার্থীদের মধ্যে একই প্রতিক্রিয়া— ‌‘এই তো সেই ডেইজি, যে খাঁচা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল।’

চার বছরের ছেলে মাহিন আহমেদকে নিয়ে চিড়িয়াখানা ঘুরতে গেছেন রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা আবু নাসের। তিনি বলেন, জাতীয় চিড়িয়াখানায় এমন নিরাপত্তা গাফিলতি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। ‘সেদিন যদি সিংহী কাউকে আক্রমণ করতো, পরিস্থিতি কী ভয়াবহ হতো ভাবতেই শিউরে উঠি। আল্লাহর রহমত যে সিংহী কাউকে ক্ষতি করেনি’— যোগ করেন তিনি।সিংহী ডেইজির খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে শুক্রবারের ঘটনার আলোচনা করছিলেন শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা আলী আহসান ও তার স্ত্রী রিনা বেগম। আলী আহসান বলেন, ‘সিংহী ডেইজি খাঁচা থেকে বের হয়ে গেছে— এ খবর মুহূর্তেই ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। তখন ভাবছিলাম, যারা তখন চিড়িয়াখানার ভেতর ছিলেন, তাদের অবস্থা কেমন হয়েছিল! অনুমান করা যায়, সবাই আতঙ্কে জীবন বাঁচাতে দৌড়ে বের হয়ে গেছেন। তিনি আরও বলেন, ‘চিড়িয়াখানায় ঘুরতে এসে যেন আর কাউকে এমন পরিস্থিতিতে না পড়তে হয়, তা কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে।’

জানতে চাইলে জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম তালুকদার জাগো নিউজকে বলেন, ওই দিন খাঁচা থেকে সিংহী বের হওয়ার ঘটনায় তদন্ত কমিটি কাজ করছে। আজ কমিটির রিপোর্ট দেওয়ার কথা। রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর নিশ্চিতভাবে জানা যাবে, সিংহী কীভাবে খাঁচা থেকে বের হয়েছিল। তবে প্রাথমিকভাবে জানা যায়, খাঁচার দায়িত্বে থাকা অ্যানিমেল কেয়ারটেকার ভুলবশত খাঁচার তালা দেননি এবং তালা না দেওয়ায় সিংহী বের হয়ে যায়। তিনি জানান, চিড়িয়াখানার প্রতিটি মাংসাশী প্রাণির জন্য দুটি খাঁচা থাকে। সিংহীর ক্ষেত্রেও দুটি খাঁচা রয়েছে এবং ওই সিংহী প্রথম খাঁচা থেকে বের হয়ে দ্বিতীয় খাঁচার ভেতরে অবস্থান করছিল।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে চিড়িয়াখানার পরিচালক আরও জানান, ওই দিন সিংহী খাঁচা থেকে বের হয়ে অ্যানিমেল কেয়ারটেকারের কাছে চলে যায়। ভয় পেয়ে তিনি খাঁচার ভেতরে থাকা উঁচু গ্রিলে ঝুলে যান। এমন পরিস্থিতিতে কাউকে ডাকার সুযোগ ছিল না। পাশেই থাকা হরিণের নিরাপত্তা প্রহরী হরিণগুলোর আচরণ লক্ষ্য করেন। হরিণের সাইকোলজিক্যাল অ্যালার্ট ব্যবস্থা অনুযায়ী, বিপদ দেখলেই এক হরিণ অন্য হরিণকে সতর্ক করে। অ্যালার্ট পেয়ে প্রাথমিকভাবে সবাই সরে যায়। পরে হরিণগুলো আবার দলবদ্ধভাবে ফিরে আসে এবং আশপাশে কোনো শত্রু আছে কিনা খুঁটিয়ে দেখে।

হরিণের এমন আচরণ খাঁচার নিরাপত্তা প্রহরীর নজরে পড়ে। প্রহরী লক্ষ্য করেন যে সিংহী ধীরে ধীরে খাঁচার বাইরে চলে আসছে। সিংহীর খাঁচা নিরাপত্তা প্রহরীর খাঁচার ওপরেই ঝুলে থাকায়, তিনি বসে থেকে সিংহীকে ডাকেন ‘আয়, আয়।’ ডাকে সিংহী দুইবার খাঁচার ভেতরে ঢুকে আবার বের হয়ে যায়, যার কারণে তাকে তখন লকআপ করা যায়নি।

চিড়িয়াখানার পরিচালক জানান, ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে সতর্কতার বিকল্প নেই। নিরাপত্তা প্রহরীদের আরও বেশি সতর্ক ও প্রশিক্ষিত করার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

এমএমএ/এমএএইচ/