সাহিত্য

পাওলো কোয়েলহোর গল্প: নিখোঁজ তুরঙ্গ

ভাষান্তর: মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী

অনেকদিন আগের কথা, চীন দেশের ছোট্ট একটি গ্রামে বাস করতেন দরিদ্র এক কৃষক। একমাত্র পুত্রসন্তানের সঙ্গে তিনি ছোট্ট একটি কুঁড়েঘরে বাস করতেন। বিষয় সম্পত্তি বলতে ওই কুঁড়েঘরটি এবং সামান্য পরিমাণ চাষের জমি ছাড়াও উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি তার পিতার কাছ থেকে একটি ঘোড়া পেয়েছিলেন। অকস্মাৎ একদিন সেই ঘোড়াটি কোথায় যেন পালিয়ে গেল। জমিতে লাঙল চালাবার জন্য কৃষকের কাছে আর কোনো প্রাণী রইল না। কৃষকের অধ্যাবসায় ও সততার জন্য প্রতিবেশীরা তাকে বরাবরই অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতো। এখন তারা সবাই মিলে তার বাড়িতে এসে ঘোড়া নিখোঁজের কারণে সমবেদনা জানাতে শুরু করলো। প্রতিবেশীদের আগমনে তিনি যথারীতি ধন্যবাদ জানানোর পর তাদের একটি প্রশ্ন শুধালেন: তোমরা কীভাবে জানলে যে, প্রকৃতপক্ষে যা ঘটেছে তা আমার জীবনে দুর্ভাগ্য বয়ে এনেছে?

ফিরে যেতে যেতে প্রতিবেশীদের মধ্য থেকে একজন পাশের লোকটির কানে কানে বলল, ‌‘সত্যিটাকে সে মোটেই মেনে নিতে পারছে না। ঘটনাটির দুঃখবোধ যতক্ষণ পর্যন্ত তাকে না স্পর্শ করছে; ততক্ষণ তাকে নিজ খেয়ালে ভাবতে ছেড়ে দাও।’অবশেষে প্রতিবেশীরা বেচারা কৃষকের বক্তব্যের সাথে সহমত পোষণ করার ভান করে যে যার বাড়ি চলে গেল।

সপ্তাহখানেক পর হারানো ঘোড়াটি একদিন আস্তাবলে ফিরে এলো। এবার কিন্তু সে একা নয়, সঙ্গিনী হিসেবে দারুণ একটি বুনো মাদি ঘোড়াকেও সাথে নিয়ে এসেছে। গ্রামবাসীর মধ্যে যারা কৃষকের বক্তব্যে হতাশ হয়েছিল; তারা এবার সেই বক্তব্যের তাৎপর্য বুঝতে পারল। এরপর তারা সবাই কৃষকের অমন সৌভাগ্যে অভিনন্দন জানাতে আবার তার কুটিরে জড়ো হলো।‘অভিনন্দন জানাতে এলাম, কারণ আগে তোমার মাত্র একটি ঘোড়া ছিল। আর এখন একজোড়া ঘোড়ার মালিক তুমি।’‘তোমাদের আগমন এবং আমার বিষয়ে তোমাদের উদ্বিগ্নতার জন্য আমি অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি, কিন্তু তোমরা কীভাবে নিশ্চিত হলে যে, যা ঘটেছে সেটা আমার জীবনে আশীর্বাদ বয়ে আনবে।’কৃষকের এরকম প্রশ্নে প্রতিবেশীরা থ হয়ে গেল। তারা ভাবতে লাগলো লোকটি নিশ্চিত উন্মাদ হয়ে যেতে বসেছে। ফিরে যেতে যেতে তারা মন্তব্য করল, ‘সে কী সত্যিই ঘটে যাওয়া ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে পারছে না?’

মাসখানেক পরের ঘটনা। একদিন কৃষকের ছেলেটি বুনো মাদি ঘোড়াটিকে পোষ মানাবার সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু প্রাণীটি অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে তাকে পিঠ থেকে ছুড়ে ফেলে দিলো। পড়ে গিয়ে ছেলেটির একটি পা ভেঙে গেল। এবার প্রতিবেশীরা আহত ছেলেটির জন্য উপহারসামগ্রীসহ কৃষকের কুটিরে আবার জড়ো হলো। গ্রামের মোড়ল কৃষকের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বললেন, ‘ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার জন্য আমার সবাই দুঃখিত।’কৃষক এবারও তাদের আগমন ও সমব্যাথিতার জন্য ধন্যবাদ জানাল। কিন্তু এবারও সে তাদের একটি প্রশ্ন করলো: যা ঘটে গেছে, তা যে আমার জন্য দুর্ভাগ্যজনক ছিল; এই বিষয়টি তোমরা কিভাবে জানলে?’

এ কথা শুনে সবাই অবাক হলো। কারণ, নিজ পুত্রের দুর্ঘটনার সংবাদকে সত্যিই তারা সন্দেহাতীতভাবে দুঃখজনক বলেই মানতো। কৃষকের বাড়ি থেকে ফিরে যাওয়ার পথে তারা একে অপরের সাথে বলাবলি করছিল, ‘কী কাণ্ড! সে বোধহয় সত্যি সত্যি উন্মাদ হয়ে গেছে। তার একমাত্র ছেলে আজীবনের জন্য খোঁড়া হয়ে যেতে পারে, তা জানা সত্ত্বেও সে এখনো ভাবছে বিষয়টি তার জন্য দুর্ভাগ্যজনক কি না?’

আরও পড়ুনকে এই লেখক লাসলো ক্রাসনাহরকাই জর্জ অরওয়েলের ‘বার্মিজ ডেইজ’ 

এরপর কয়েক মাস গেল। ওদিকে জাপান সম্রাট তখন চীন দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বসলেন। চীন সম্রাটের সৈন্যরা তখন সারাদেশ চষে বেড়াতে লাগল। প্রত্যেক গ্রাম থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিক হিসেবে যোগদানের তরে সুস্থ-সবল যুবকদের বাছাই করা শুরু হলো। সম্রাটের সৈন্যরা ছোট্ট গ্রামটিতে পৌঁছে সেখানকার যুবকদের সৈনিক হিসেবে নিযুক্ত করল। একমাত্র কৃষকের সেই পা-ভাঙা ছেলেটিই বাছাই থেকে রেহাই পেলো।

যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যুবকদের কেউই জীবিত ফিরে আসেনি। ওদিকে কৃষকের ছেলেটি ততদিনে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠেছে। তাদের মাদি ঘোড়াটি শাবক প্রসব করছে এবং সেগুলো চড়া দামে বাজারে বিক্রি হয়েছে। কৃষক এবার তার সব হিতৈষী প্রতিবেশীদের সমবেদনা জানানোর জন্য ঘরে ঘরে যাওয়া শুরু করলেন।

যখনই গ্রামের কেউ তার কাছে কোনো অনুযোগ করতো; তখন তিনি বলে উঠতেন, ‘তুমি কীভাবে জানো যে এটি তোমার দুর্ভাগ্য প্রসূত?’ আবার যখন কেউ খুব বেশি আনন্দ প্রকাশ করতো; তখন তিনি বলে উঠতেন, ‘তুমি কীভাবে বুঝলে যে, এটি তোমার জন্য আশীর্বাদ বয়ে নিয়ে এসেছে?’

তখন থেকে সেই গ্রামের অধিবাসীরা উপলব্ধি করতে শুরু করে যে, দৃশ্যমান জগতের বাইরেও জীবনের রয়েছে আলাদা রকমের এক অর্থবহ প্রকাশ।

মূল: দ্য লস্ট হর্স।

>> ব্রাজিলীয় ঔপন্যাসিক এবং গীতিকার পাওলো কোয়েলহো জন্মগ্রহণ করেন ব্রাজিলের রাজধানী রিও ডি জেনেইরোতে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ আগস্ট। তার সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাসের নাম ‘দ্য আলকেমিস্ট’। উপন্যাসটি আশিটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর লেখায় ভালোবাসা, আধ্যাত্মিকতা এবং দর্শনের প্রভাব মুখ্য। কোয়েলহো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বেশ কিছু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন এবং তাঁর আলকেমিস্ট উপন্যাসটি প্রকাশনা জগতের বিস্ময় হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

জন্মস্থান রিও ডি জেনেইরোতেই তিনি প্রাথমিক শিক্ষা এবং পরবর্তীতে আইন বিষয়ে শিক্ষা শুরু করেন। কিন্তু ১৯৭০ সালে তিনি ভ্রমণের উদ্দেশ্যে লেখাপড়া ছেড়ে দেন। ঘুরে বেড়ান মেক্সিকো, পেরু, বলিভিয়া এবং চিলিসহ ইউরোপ ও উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে। তারপরই শুরু করেন লেখালেখি। এখনো তিনি লিখে চলেছেন অবিরাম।

এসইউ