মাহমুদ নোমান
গীতিময় এক সুগভীর টানে এগিয়ে নিয়ে যায়। নির্ভেজাল আকুতিভরা বোধবিজ্ঞানের সুরারোপিত ইশারার ভাষা। ভাবের তাপিত মাধ্যম সরাসরি ছড়িয়ে পড়ে সকালের আহ্লাদী রোদের মতোন। পাঠকের কাছে হয়ে ওঠে নিজেদের গল্পকাহিনি। রেজা নুর মূলত কবি। তবে একজন কবি ভাষার চালক হেতু সবদিকে যাওয়ার এখতিয়ার এমনকি সাবলীলভাবে নিজেকে এগিয়ে নিতে পারেন। কবি রেজা নুরের উপন্যাস ‘চেনা আগুন’ পাঠ পরবর্তী এই ভাবনা উদয় হলো।
ভাষা নিয়ে হয়তো টানাহেঁচড়া নেই। দেখিয়ে দেওয়ার বাতিক নেই। তবে সহজাত প্রকাশভঙ্গি পাঠককে আকৃষ্ট করে। কবিতায় রেজা নুরের যে বিবিধ কৌশলে চলন দেখে অভ্যস্ত অনুজরা; সেখানে গল্পে জীবনের যে স্বাভাবিক গতি, সেটাকে তুলে ধরেছেন। অতো জিজ্ঞাসা নেই, তবে আবেগের টান যথার্থ আছে। ‘চেনা আগুন’ উপন্যাসটিতে ত্রিমুখী প্রেম ও সংকট রূপান্তর করে দেখিয়েছেন। সিনেমাটিক কল্পনার কিছু মিশ্রণও ঘটেছে কোথাও। হঠাৎ রোদ বৃষ্টির ধাওয়া উপস্থিত হয়েছে।
রেজা নুরের ‘চেনা আগুন’ উপন্যাসটি মূলত অনার্স পড়ুয়া যুবকের মাস্টার্স শেষ করার সময়কালে প্রেমঘটিত নানান ঘটনার বয়ান; যুবকের নাম সোহান অর্থাৎ উপন্যাসের নায়ক। সোহান টিউশনি করে, সেখানে মুনিয়া নামের এসএসসি পরীক্ষার্থীর কাঁচাপাকা আবেগ অল্প আঁচে পরিবেশন করলেন লেখক। মুনিয়ার যৌবন লাভের সময়ের প্রলয় মঞ্চায়ন করেছেন। সোহান যখন ভাইয়ের বাসায় মাঝেমধ্যে যায়; সেখানে মৌমিতা নামের একজনের প্রেমে পড়ে। মুনিয়ার যেমন বন্য উচ্ছলতা; তেমনই ভাবি যূথীর একরকম প্রশ্রয়ে মৌমিতার প্রেম আরও বেগবান হতে থাকে।
একদিন তুমুল বৃষ্টিতে সোহানের বাসায় চলে আসে। লেখক সেই মুহূর্তে মিলনের ধারাবর্ণনা ঘনিষ্ঠ করে তোলেন। একসময় মনে হচ্ছে মৌমিতাই সোহানের জীবনে পুরোপুরি জড়িয়ে যাচ্ছে। মুনিয়া, মৌমিতা দুজনেই চায় সোহানকে পেতে। মৌমিতার সাথে অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটানোর পরে এমনকি মুনিয়ার সাথেও অন্তরঙ্গ হওয়ার মুহূর্ত তৈরি হবে হবে এমন অবস্থা! সোহান নিজেও বুঝতে পারে না সে আসলে কাকে চায়। উপন্যাসে একটা জটিল বাঁক তৈরি হয়।
সোহান যেন একটা নদী। দুটো গতিপথ যেন মুনিয়া ও মৌমিতা। এরমধ্যেই হাসি নামের সোহানের ভার্সিটির জুনিয়র মেয়েটি এসে আরেকটা পথে বাহিত করে। যেন ত্রিমোহনা হয়ে সোহান বয়ে যাচ্ছে। একদিন হাসি সোহানকে বাসায় নিয়ে যায়। হাসির মা মমতাজের আপ্যায়নে মুগ্ধ হয় সে। এরপরে আরেকদিন দাওয়াত দিয়েই নিয়ে যায় সোহানকে। সোহান যেই হাসির বাসায় ঢুকছে; তখনই হাসি শপিংয়ে যাওয়ার জন্য বেরিয়েছে। আসলে এটি একটি টোপ ছিল। যেন ঘরে মা মমতাজ সোহানকে হাসির সাথে কীরকম সম্পর্ক জিজ্ঞাসা করতে পারে। ব্যাপারটা ঠিকই হলো।
আরও পড়ুনবেদনার জায়নামাজ: জীবনের গভীর জিজ্ঞাসাদ্য মেটামরফোসিস: বাস্তবতার নির্মম প্রতিচ্ছবি
কথায় কথায় হাসির বাবা কোথায় সে প্রসঙ্গ উঠলো। হাসির মা মমতাজের প্রেম ছিল আরেকজনের সাথে। মা-বাবা জোর করে হাসির মাকে হাসির বাবার সাথে বিয়ে দেয়। মনের মিল না হওয়ায় হাসির বাবা দূরত্বে থাকেন। গ্রামের বাড়ি গেলে কয়েকমাস থেকে যায়। কথাপ্রসঙ্গে সোহান দেখতে সোহানের মায়ের সেই প্রেমিকের মতো, সেটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে। সময় থাকতে প্রেমকে আগলে রাখতে হয় সেটি বোঝাতে চায়। সোহান ও হাসির মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক থাকলে সেটিকে আজীবনের জন্য এক সুতোয় বাঁধার কথা বলে।
এই মুহূর্ত উপন্যাসটিকে অনন্য মাত্রা দিয়েছে। কিন্তু মাস্টার্স শেষ হওয়ার পরে হঠাৎ ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে যায় সোহান। একেবারে কাউকে বলেনি। অথচ গ্রামে আসার কয়েকদিনের মধ্যে হাসি এসে হাজির। উপন্যাসটি এখানে কিছুটা সিনেমায় দেখা ঘাসের ওপর খুনসুটিতে সমাপ্তি ঘটে। হয়তো আরও কিছু চাওয়া বাকি ছিল লেখকের কাছ থেকে। আরও ঘনঘটা, আরও ফাঁক, ফাঁকে ফাঁকে আরও মাল-মসলা; হতে পারে লেখক রেজা নুর সারল্যে আলাপে একটা রেখাপাত করেছেন।
অনেকে বলতে পারেন, এখানে আর কী কী দেখানো কিংবা ভাবার আছে? আমি বলি, জীবনের বাইরে গিয়ে তো সাহিত্য দেখার মাহাত্ম্য নেই। তবে ভাবনার কত ধারা আছে। হতে পারে, লেখক রেজা নুরের মস্তিস্কে ও মননে ‘চেনা আগুন’ ধিকিধিকি জ্বলছে, সেটির একটা মঞ্চায়ন করে দিতে পারলে মুক্তি। উপন্যাসটি মূলত প্রত্যেকের জীবনে ঘটে যাওয়া একটা অধ্যায় কিংবা মুক্তির রূপরেখা।
বই: চেনা আগুনলেখক: রেজা নুরপ্রকাশনী: রণন প্রকাশপ্রচ্ছদ: ধ্রুব এষমূল্য: ১৬০ টাকা।
এসইউ