যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের বাণিজ্য কর্মকর্তারা বুধবার (১০ ডিসেম্বর) থেকে নতুন করে দুই দিনের আলোচনায় বসছেন। যদিও দুই দেশের মধ্যে বহুদিন ধরে কাঙ্ক্ষিত বাণিজ্য চুক্তি হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় এখনো কাটেনি। আবার এমন এ বৈঠক শুরু হলো, যখন রাশিয়ার তেল কেনা কেন্দ্র করে ওয়াশিংটন নয়াদিল্লির ওপর ব্যাপক শুল্ক আরোপ করেছে।
চলতি বছরের আগস্টে যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় অধিকাংশ পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক বসায়। এর পেছনে ওয়াশিংটন যুক্তি দেখায় যে রাশিয়া থেকে স্বল্প মূল্যে অপরিশোধিত তেল আমদানির মাধ্যমে ভারত কার্যত ইউক্রেন যুদ্ধে অর্থায়ন করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ডেপুটি ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ রিক সুইৎজার এই আলোচনার জন্য ভারতে এসেছেন। এর এক সপ্তাহ আগে ভারত সফর করেন রশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এদিকে, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সুইৎজারের এই সফরকে ‘পরিচিতিমূলক সফর’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
উল্লেখযোগ্য হলো- ডোনাল্ড ট্রাম্প এপ্রিল মাসে অধিকাংশ বাণিজ্য অংশীদারের ওপর নতুন শুল্ক ঘোষণা করার পর, ভারতই প্রথম দেশগুলোর একটি যারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনা শুরু করেছিল। কিন্তু এখনো বিশ্বের বড় অর্থনীতিগুলোর মধ্যে ভারতই কয়েকটির একটি, যাদের সঙ্গে ওয়াশিংটনের কোনো চুক্তি হয়নি। বিষয়টি ভারতের কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বাজারে ঝুঁকি তৈরি করছে।
কী ঝুঁকি তৈরি হয়েছে?
বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল বড় অর্থনীতি হিসেবে ভারত ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পণ্যবাণিজ্যে ৪৫.৮ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ৫৮০ কোটি ডলারের ঘাটতি রেকর্ড করেছে।
স্মার্টফোন ও জেনেরিক ওষুধের মতো বড় রপ্তানি খাতগুলো ট্রাম্পের শুল্ক থেকে অব্যাহতি পেয়েছে। কিন্তু শ্রমনির্ভর বহু শিল্প সেই সুবিধা পায়নি, যা ভারতের জন্য বড় ধাক্কা, কারণ দেশটি এরই মধ্যে লাখ লাখ তরুণ স্নাতকের পর ভালো বেতনের চাকরি পেতে সংগ্রাম করছে। এই অস্থিরতা মোদীর ভারতকে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত করার উচ্চাকাঙ্ক্ষাতেও চাপ সৃষ্টি করছে।
চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ভারতের রপ্তানি প্রায় ১২ শতাংশ কমে গেছে। এর প্রধান কারণ যুক্তরাষ্ট্রমুখী পণ্য পাঠানো কমে যাওয়া।
গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ (জিটিআরআই) বলছে, মে থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ভারতের রত্ন ও গয়না, টেক্সটাইল ও সামুদ্রিক খাবারের মতো শ্রমনির্ভর খাতের রপ্তানি ৩৭ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।
বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও আস্থা হারিয়েছেন। ফলে এ বছর ভারতীয় শেয়ারবাজার থেকে তারা ১৬ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলারেরও বেশি মূলধন তুলে নিয়েছেন। এতে ডলারের বিপরীতে রুপির মানে রেকর্ড পতন হয়েছে।
এদিকে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০২৬-২৭ সালের ভারতের প্রবৃদ্ধি পূর্বাভাস ৬ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬ দশমিক ২ শতাংশ করেছে। সংস্থাটি ধরে নিয়েছে যে ভারতের ওপর ট্রাম্পের ৫০ শতাংশ শুল্ক দীর্ঘায়িত হতে পারে।
ফলে চলতি অর্থবছরে ভারতের রপ্তানি ৮৬.৫ বিলিয়ন বা ৮ হাজার ৬৫০ কোটি ডলার থেকে কমে ৪৯.৬ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ৯৬০ কোটি ডলারে নেমে যেতে পারে। এতে প্রবৃদ্ধি থেকে ৮০ বেসিস পয়েন্ট পর্যন্ত কমে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, বলছে জিটিআরআই।
রাশিয়ার তেলের ভূমিকা
ইউক্রেনে রাশিয়ার ‘সামরিক অভিযানে ‘ পর মস্কো যখন তীব্র নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে, তখন ভারতই সস্তায় রুশ অপরিশোধিত তেল কেনার সুযোগ নেয়। কিন্তু ট্রাম্প বাণিজ্যনীতিকে ভূ-রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করায় আগস্টে হঠাৎই যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কে টানাপড়েন দেখা দেয়। আরোপিত মোট শুল্কের প্রায় অর্ধেকই রুশ তেল কেনার বিরুদ্ধে ওয়াশিংটনের শাস্তিমূলক পদক্ষেপের ফল।
ট্রাম্প বারবার দাবি করেছেন, ভারত এরই মধ্যে রাশিয়ার তেল কেনা অনেকখানি কমিয়ে দিয়েছে, নাহলে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে এই তলে আমদানি বন্ধ করবে। তবে নয়াদিল্লি ট্রাম্পের এই দাবি নিয়ে কিছুই নিশ্চিত করেনি বা অস্বীকারও করেনি।
অন্যদিকে, নয়াদিল্লিতে সফরের সময় পুতিন বলেছেন, তিনি ‘জ্বালানির সরবরাহ অব্যাহত রাখবেন।’ মোদী অবশ্য তেল প্রবাহ নিয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করেননি।
এদিকে, ভারতের শীর্ষ ক্রেতা রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ নভেম্বরেই জানায়, তারা রপ্তানিমুখী তেল শোধনাগারের জন্য রুশ তেল আমদানি বন্ধ করেছে। ছোট শোধনাগারগুলোর এইচপিসিএল-মিত্তল এনার্জিও জানিয়েছে, তারাও রাশিয়ার তেল কেনা পুরোপুরি বন্ধ করেছে। ট্রেড ইন্টেলিজেন্স প্ল্যাটফর্ম কেপলারের বিশ্লেষকদের ধারণা, ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে ভারতের রুশ তেল আমদানি ‘উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে।’
অন্যান্য ইস্যু, কৃষিপণ্য ও পারস্পরিক শুল্ক
কৃষিপণ্য নিয়েও আলোচনায় জট তৈরি হয়েছে। চাল ও গমের মতো প্রধান খাদ্যদ্রব্যের ওপর শুল্ক কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে ভারত অনীহা দেখিয়েছে। কারণ ভারতের কৃষকরা রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত প্রভাবশালী।
ভারতীয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এএফপিকে জানিয়েছেন, এসব ইস্যু ‘বেশিরভাগই সমাধান হয়েছে।’ যদিও সোমবার (৮ ডিসেম্বর) ট্রাম্প জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের চাল আমদানিতে শুল্ক আরোপ করা হতে পারে।
চুক্তি আলোচনার আরেকটি বিষয় হলো ট্রাম্পের ‘পারস্পরিক শুল্ক’ নীতি। যদিও কর্মকর্তারা বলছেন, দুটি ক্ষেত্রই আলাদা, কিন্তু একটি অন্যটিকে প্রভাবিত করবে। ভারতের বাণিজ্য সচিব রাজেশ আগরওয়াল গত সপ্তাহে এক শিল্প ইভেন্টে বলেন, এগুলো দুটি পৃথক ও সমান্তরাল আলোচনা; তবে একটির অগ্রগতি অন্যটির অগ্রগতিকে থামিয়ে দিতে পারে।
অচলাবস্থা কাটবে কি?
আপাত দৃষ্টিতে আগস্টের পর যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের সম্পর্ক কিছুটা উন্নত হয়েছে। কয়েকটি ছোট চুক্তিও এগোচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে নভেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের অনুমোদন পাওয়া প্রায় ৯৩ মিলিয়ন বা ৯ কোটি ৩০ লাখ ডলারের দুটি অস্ত্র বিক্রয় চুক্তি ও ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সমঝোতা, যার আওতায় দিল্লি তার মোট তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) আমদানির প্রায় ১০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে নেবে।
আগের মার্কিন বাণিজ্য চুক্তিগুলোর মতো এবারও জ্বালানি প্রতিশ্রুতি কেন্দ্রীয় ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এলপিজি সরবরাহ চুক্তিটি ওয়াশিংটনকে বোঝাতে পারে যে ভারত ধীরে ধীরে রুশ জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমাচ্ছে।
সূত্র: এএফপি
এসএএইচ