বাংলাদেশের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক নেতৃত্ব, আবেগপ্রবণ সমর্থন ও প্রতীকনির্ভর রাজনৈতিক সংস্কৃতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এই বাস্তবতায় বেগম খালেদা জিয়া শুধু একটি রাজনৈতিক দলের চেয়ারপার্সন নন; তিনি একটি সময়, একটি ধারা এবং একটি বৃহৎ রাজনৈতিক মানসিকতার প্রতিনিধিত্বকারী প্রতীক। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তাঁর গুরুতর অসুস্থতা এবং হাসপাতালকেন্দ্রিক জীবন বিএনপির পাশাপাশি গোটা দেশের রাজনীতিকে এনে দাঁড় করিয়েছে গভীর অনিশ্চয়তার মুখে।
এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রতিদিন নতুন তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে। কখনো বলা হচ্ছে তিনি স্থিতিশীল, আবার কখনো চিকিৎসকেরা আশঙ্কার কথা জানাচ্ছেন। ডায়াবেটিস, কিডনি, হৃদ্যন্ত্র ও ফুসফুসজনিত জটিলতা এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে সামান্য স্থিতিশীলতা থাকলেও যে-কোনো মুহূর্তে পরিস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। সাম্প্রতিক পরীক্ষায় কিছু অগ্রগতির ইঙ্গিত মিললেও চিকিৎসকেরা স্পষ্ট করে বলেছেন যে তিনি এখনও শঙ্কামুক্ত নন। ফলে তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে নেওয়ার আলোচনা এক ধরনের অনিশ্চিত দোলাচলে আটকে আছে।
লন্ডনে নেওয়ার বিষয়টি আজ আর শুধু চিকিৎসার সিদ্ধান্তে সীমাবদ্ধ নেই; এটি রূপ নিয়েছে রাজনৈতিক আলোচনার অংশে। কখনো শোনা যায় এয়ার অ্যাম্বুলেন্স আসছে, আবার কখনো তা পিছিয়ে যায়। কখনো বলা হয় কারিগরি জটিলতা, কখনো অর্থনৈতিক দিক, আবার কখনো নিরাপত্তার প্রশ্ন সামনে আসে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। অনেকেই বুঝতে পারছেন না, এটি শুধু চিকিৎসাগত বিলম্ব, নাকি এর পেছনে আছে বৃহত্তর রাজনৈতিক কোনো পরিকল্পনা।
এই সংকটের মধ্যেই নতুন করে সামনে এসেছে তারেক রহমানকে ঘিরে নানা প্রশ্ন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে তিনিই গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে দলের কৌশলগত নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন এবং দীর্ঘদিন ধরে লন্ডন থেকেই দল পরিচালনা করছেন। একসময় বলা হতো, ক্ষমতাসীন সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তিনি দেশে ফিরতে পারছেন না। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর সেই যুক্তি অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়ে। এরপর কয়েক দফা দেশে ফেরার সম্ভাব্য তারিখ ঘোষিত হলেও বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। সর্বশেষ তারেক রহমান নিজেই বলেছেন, তাঁর দেশে ফেরা একমাত্র তাঁর নিজের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে না। এই বক্তব্য রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে এবং ইঙ্গিত দিয়েছে যে দৃশ্যমান রাজনীতির বাইরে কিছু অদৃশ্য কাঠামো কাজ করছে।
এই প্রেক্ষাপটে গিয়ে দাঁড়িয়েছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি: বিএনপির ভবিষ্যৎ কী? খালেদা জিয়া অসুস্থতার কারণে কার্যত দলের নেতৃত্ব দিতে অক্ষম এবং তারেক রহমান দেশে ফিরতে পারছেন না। প্রশ্ন উঠেছে, এই শূন্যতায় বিএনপির হাল ধরবে কে? একটি কার্যকর গণতন্ত্রে বড় বিরোধী দলের শক্তিশালী উপস্থিতি অপরিহার্য। কিন্তু নেতৃত্বের এই শূন্যতা বিএনপির সাংগঠনিক ভিত্তিকে ক্রমাগত দুর্বল করে দিচ্ছে। মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা পরিষ্কার দিকনির্দেশনার অভাবে বিভ্রান্ত হচ্ছেন। কেন্দ্র থেকে স্পষ্ট রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা না এলে স্থানীয় পর্যায়ে মতানৈক্য, কোন্দল ও স্বার্থের সংঘাত বাড়তে থাকে, যা বিএনপিকেও ধীরে ধীরে গ্রাস করছে।
নির্বাচনী রাজনীতির দিক থেকেও এই পরিস্থিতি বিএনপির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। একটি কার্যকর নির্বাচনী কৌশলের জন্য প্রয়োজন দৃঢ় নেতৃত্ব, পরিষ্কার বার্তা ও দৃশ্যমান রাজনৈতিক মুখ। খালেদা জিয়া ছিলেন সেই মুখ, যিনি কেবল একটি দলের নেত্রী নন, বরং দেশের এক শ্রেণির মানুষের কাছে ভরসার জায়গা। তাঁর অসুস্থতাজনিত অনুপস্থিতিতে বিএনপি এক ধরনের শূন্যতায় ভুগছে। অন্যদিকে, তারেক রহমানের দীর্ঘদিনের বিদেশ অবস্থান তাঁর রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতাকে সীমিত পরিসরে আবদ্ধ করে রেখেছে। মাঠের রাজনীতিতে সরাসরি উপস্থিত না থাকলে জনগণের আবেগের সঙ্গে স্বাভাবিক সংযোগও দুর্বল হয়ে পড়ে।
তবে রাজনীতিতে শূন্যতা কখনো স্থায়ী হয় না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পুরোনো নেতৃত্ব দুর্বল হলে নতুন নেতৃত্বের উত্থানের সুযোগ তৈরি হয়। বিএনপির মধ্যেও এমন অনেক নেতা আছেন, যাঁরা সাংগঠনিকভাবে দক্ষ, মাঠে সক্রিয় এবং জনসংযোগে পারদর্শী। কিন্তু এখনো তাঁরা সামনে আসার রাজনৈতিক সুযোগ বা সাহস দেখাতে পারেননি। এর অন্যতম কারণ হলো বিএনপির ভেতরের দীর্ঘদিনের কেন্দ্রনির্ভর ও পরিবারভিত্তিক নেতৃত্বের সংস্কৃতি, যা নতুন নেতৃত্বের বিকাশকে স্বাভাবিকভাবে বাধাগ্রস্ত করে।
খালেদা জিয়ার অসুস্থতা বিএনপির জন্য একটি মানসিক আঘাত, তারেক রহমানের অনুপস্থিতি একটি কৌশলগত দুর্বলতা, আর জামায়াত থেকে দূরে সরে যাওয়া একটি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। এই তিনটি বাস্তবতা একত্রে বিএনপিকে একটি কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। দলটি কি কেবল অতীতের স্মৃতি ও ব্যক্তিনির্ভর রাজনীতিতেই আটকে থাকবে, নাকি সময়ের বাস্তবতায় নিজেদের নতুন করে গড়ে তুলবে? এই উত্তরের ওপরই নির্ভর করছে বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।
এখানেই আসে আদর্শিক ও কাঠামোগত সংস্কারের প্রশ্ন। বিএনপি কি এই সংকটকে একটি সুযোগে পরিণত করবে, নাকি এটিকে সাময়িক দুর্যোগ হিসেবে দেখবে? যদি দল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে, তাহলে তাদের যেতে হবে কাঠামোগত সংস্কারের পথে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কয়েকজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে যৌথ নেতৃত্বভিত্তিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। দলের ভেতরে গণতান্ত্রিক চর্চা জোরদার করতে হবে, যাতে নেতৃত্বের সংকট তৈরি হলে বিকল্প নেতৃত্ব স্বাভাবিকভাবে সামনে আসতে পারে।
বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যক্তি-নির্ভরতা এতটাই গভীরে প্রোথিত যে হঠাৎ করে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক রাজনীতিতে রূপান্তর সহজ নয়। বহু সমর্থকের কাছেই ‘বিএনপি মানেই খালেদা-তারেক’— এই ধারণা মানসিকভাবে গেঁথে আছে। তবুও ইতিহাসের নির্মম সত্য হলো, কোনো ব্যক্তি আজীবন রাজনীতির নেতৃত্ব দিতে পারেন না। রাজনৈতিক দল তখনই টিকে থাকে, যখন তা ব্যক্তি নয়, বরং আদর্শ, সংগঠন ও প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির ওপর দাঁড়ায়।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিএনপির সামনে মূলত তিনটি পথ উন্মুক্ত। প্রথমত, তারা অপেক্ষার রাজনীতি বেছে নিতে পারে, খালেদা জিয়া সুস্থ হবেন, তারেক রহমান ফিরবেন, সবকিছু আগের মতো চলবে। এটি সবচেয়ে সহজ কিন্তু একই সঙ্গে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পথ, কারণ সময় ও বাস্তবতা কোনোটাই সম্ভবত এর অনুকূলে নয়। দ্বিতীয়ত, তারা নীরবে একটি বিকল্প নেতৃত্বকাঠামো দাঁড় করাতে পারে, কিন্তু তা প্রকাশ্যে স্বীকার করবে না। এতে সাময়িক স্থিতিশীলতা এলেও দীর্ঘমেয়াদে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বাড়ার আশঙ্কা থাকবে। তৃতীয়ত, তারা সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারে, যেখানে নতুন নেতৃত্ব, নতুন সংগঠন, নতুন রাজনৈতিক ভাষ্য সামনে আনতে পারে। এটি কঠিন, কিন্তু সবচেয়ে টেকসই পথ। তবে বিএনপির সে পথে হাঁটার সম্ভাবনা ক্ষীণ!
এই অনিশ্চয়তাকে আরও গভীর করেছে বিএনপির দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি। একসময় বিএনপি-জামায়াত জোট ছিল রাজপথের শক্ত-বন্ধনে আবদ্ধে। বহু আন্দোলন, সমাবেশ ও রাজনৈতিক সংগ্রামে তারা একে অপরের ওপর নির্ভর করেছে। তারা ক্ষমতাও ভাগাভাগি করেছিল একসময়। কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে এই সম্পর্কের ভিত আলগা হয়েছে এবং বর্তমানে তা অনেকাংশে কৈরিতায় রূপ নিয়েছে। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের প্রকাশ্য সমালোচনা এবং তারেক রহমানের বক্তব্য স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে বিএনপি এখন আর আগের মতো জামায়াতনির্ভর কৌশলে এগোতে চায় না।
এই দূরত্ব বিএনপিকে দ্বিমুখী চাপে ফেলেছে। একদিকে নেতৃত্ব সংকট, অন্যদিকে জোট রাজনীতির ভাঙন। জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ায় একটি বড় সাংগঠনিক সহায়তা কাঠামো হারানোর ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। প্রশিক্ষিত কর্মীভিত্তি, মাঠপর্যায়ের নেটওয়ার্ক ও আন্দোলনের অভিজ্ঞতা, এসব ক্ষেত্রে জামায়াত অতীতে বিএনপিকে সহায়তা করেছে। এখন সেই সমর্থন না থাকলে বিএনপিকে নিজস্ব শক্তি নতুনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যা সহজ নয় এবং সময়সাপেক্ষ।
তবে এই পরিবর্তনের একটি ইতিবাচক দিকও রয়েছে। জামায়াত থেকে দূরে সরে এসে বিএনপি নতুন ভোটারগোষ্ঠীর কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্য করে তোলার সুযোগ পেয়েছে। এমন একটি বড় ভোটারগোষ্ঠী রয়েছে, যারা জামায়াতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজনীতিকে সন্দেহের চোখে দেখে। বিএনপি যদি সত্যিকার অর্থে নিজেদের মধ্যপন্থী জাতীয়তাবাদী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, তাহলে তারা একটি ব্যাপক ভিত্তির বিরোধী শক্তি হিসেবে পুনরুত্থান ঘটাতে পারে। কিন্তু সেই সম্ভাবনা কতটা বাস্তব হবে, তা নির্ভর করবে নেতৃত্বের দৃঢ়তা ও সাংগঠনিক সক্ষমতার ওপর।
সবশেষে বলা যায়, খালেদা জিয়ার অসুস্থতা বিএনপির জন্য একটি মানসিক আঘাত, তারেক রহমানের অনুপস্থিতি একটি কৌশলগত দুর্বলতা, আর জামায়াত থেকে দূরে সরে যাওয়া একটি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। এই তিনটি বাস্তবতা একত্রে বিএনপিকে একটি কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। দলটি কি কেবল অতীতের স্মৃতি ও ব্যক্তিনির্ভর রাজনীতিতেই আটকে থাকবে, নাকি সময়ের বাস্তবতায় নিজেদের নতুন করে গড়ে তুলবে? এই উত্তরের ওপরই নির্ভর করছে বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/জেআইএম