আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তারা বলেছেন, গুম-খুনের অবসান, রাষ্ট্রীয় জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা, ছাত্ররাজনীতির সুশাসন ও নতুন মানবাধিকার কাঠামো ছাড়া ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে উঠতে পারে না।
বুধবার (১০ ডিসেম্বর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আর সি মজুমদার অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত এ সভায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিনিধি, গুমের ভুক্তভোগী ও ছাত্রনেতারা বক্তব্য দেন।
ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক এস এম ফরহাদ বলেন, মানবাধিকার দিবস এলেই সভা-সেমিনার হয়, কিন্তু মানুষের জীবন রক্ষার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা এখনো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশে বহু মানুষ বছরের পর বছর নিখোঁজ। ফরহাদের মতে, ৭১-এর স্বপ্ন পূরণ হয়নি। গত ১৫ বছর ছিল মানবাধিকার সংকটের গভীরতম সময় এবং ২০২৪-এর পরও তা পুরোপুরি কাটেনি।
জাতীয় গুম কমিশনের সদস্য নূর খান লিটন বলেন, অতীতে ছাত্ররাজনীতির নির্যাতনে ছাত্র নিহত হয়েছেন। র্যাবের হাতে তুলে নেওয়ার পর মোকাদ্দেস-মোকাদ্দেমসহ অনেকেই নিখোঁজ হয়েছেন। বহু পরিবার ভয়ে মুখ খুলতে পারেনি। গুমের ঘটনা ভুলে গেলে চলবে না। কমিশন প্রতিটি ঘটনার সত্য উদ্ঘাটনে কাজ করছে। গণতন্ত্র বজায় রাখতে সহনশীলতা ও ভিন্নমতের প্রতি সম্মান অপরিহার্য বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বেগম রোকেয়া পদকপ্রাপ্ত মানবাধিকারকর্মী ড. নাবিলা ইদ্রীস গুমের ভুক্তভোগীদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, অনেককে শিক্ষার ক্ষমতা নষ্ট করার উদ্দেশ্যে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয়েছে, যা তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। টর্চার ও গেস্টরুম সংস্কৃতি নির্মূলের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, প্রতিটি নির্যাতনের ঘটনাই নথিবদ্ধ করতে হবে।
গুমের শিকার ব্যারিস্টার আহমেদ বিন মীর কাশেম (আরমান) বলেন, শত শত পরিবার জানে না তাদের প্রিয়জন বেঁচে আছে না কি মৃত। রাষ্ট্র তাদের কোনো উত্তর দিতে পারেনি। গুম একটি জাতীয় ক্ষত, যার নিরাময়ের প্রথম শর্ত কঠোর জবাবদিহি। উন্নয়ন প্রকল্পে হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও গুমের ভুক্তভোগী পরিবারের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্র কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনারের দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মিশনপ্রধান হুমা খান বলেন, মানবাধিকার কোনো জটিল ধারণা নয়, এটি মানুষের জন্মগত অধিকার। ধর্ম-বর্ণ, লিঙ্গ, শ্রেণি- কোনো কিছুই মানুষের অধিকারকে সীমাবদ্ধ করতে পারে না। মানবাধিকারকে পাশ্চাত্যের ধারণা বলা ভুল। মানবাধিকারের নীতি বহু শতাব্দী ধরে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ ও সংস্কৃতিতে বিদ্যমান।
বাংলাদেশের পুলিশ ও প্রশাসনের ঔপনিবেশিক মানসিকতা পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান জনগণের সেবক, শাসক নয়। তরুণ প্রজন্মই এ পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিতে পারে বলে তিনি মত দেন।
ডাকসু ভিপি সাদিক কায়েম অভিযোগ করেন, গত ১৬ বছর দেশে ফ্যাসিবাদী শাসন চলেছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ছাত্রলীগের মাধ্যমে ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে’ পরিণত করা হয়েছিল। ইসলাম চর্চা বা নামাজ পড়ার কারণে বহু শিক্ষার্থীকে শিবির সন্দেহে নির্যাতন করা হয়েছে।
সাদিক বলেন, যারা মানবাধিকারকর্মীর পরিচয়ে গুম-খুনকে বৈধতা দিয়েছেন তারা জাতির শত্রু। তাদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। তিনি সতর্ক করেন, নতুন বাংলাদেশেও কিছু গোষ্ঠী পুরোনো দমননীতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। তার দাবি, নতুন বাংলাদেশ হবে অধিকার ও ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্র, যেখানে গুম, খুন, নির্যাতন বা টর্চারের কোনো স্থান থাকবে না।
এফএআর/একিউএফ