খেলাধুলা

‘বিকেএসপি লিজেন্ডস’ নিয়ে দুটি কথা

‘খেলাপাগল’ শব্দটা শুনতে কানে লাগে। বাংলাদেশের মানুষ খেলাপ্রেমী; কিন্তু আমাদের দেশে এখনো খেলাধুলার তেমন কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্র নেই। সবেধন নীলমনি ‘বিকেএসপি।’ দেশের ক্রীড়াঙ্গনের সুতিকাগার ও ক্রীড়াবীদ তৈরীর একমাত্র সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান।

বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘বিকেএসপি’ তাদের ৩৯ বছরের গৌরবময় ইতিহাসের ৫০ সেরা ক্রীড়াবীদের তালিকা প্রকাশ করেছে। বিকেএসপি মনে করেছে, ওই ৫০ ক্রীড়াবীদ নিজেদের মেধা, কঠোর পরিশ্রম ও সাফল্যের মাধ্যমে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে অবদান রেখেছেন এবং সেকারণেই ওই ৫০ জন কিংবদন্তী ক্রীড়াবীদকে আনুষ্ঠানিক সম্মাননাও জানানো হয়েছে।

খুব ভাল কথা। বিকেএসপি কর্তৃপক্ষকে আন্তরিক ধন্যবাদ। একটা প্রশংসনীয় উদ্যোগ।

সরকারের অর্থায়নে দেশের একমাত্র ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান বিকেএসপির অর্জন, প্রাপ্তি ও কৃতিত্ব নিয়ে একটি মিশ্র অনুভুতি আছে সব সময়ই। অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে বিকেএসপি ‘অন্ধের যষ্ঠি।’ এদেশে গত তিন যুগের অনেক নামী, সফল ও আন্তর্জাতিক মানের ক্রীড়াবীদ উঠে এসেছেন সাভারের জিরানী এলাকার এই ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান থেকে। আবার উল্টো কথাও আছে। এমন কথাও শোনা যায়, ‘বিকেএসপি নিয়েছে অনেক। দিয়েছে কম।’

প্রশংসা কিংবা সমালোচনা যাই থাকুক না কেন, বড় সত্য হলো গত তিন যুগের বেশি সময় (৩৯ বছর) ধরে দেশের ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, অ্যাথলেটিক্স, শ্যুটিং, সাঁতার ও আর্চারিতে বিকেএসপি থেকে অনেক মেধাবি ও সফল ক্রীড়াবীদ বেরিয়ে এসেছেন। যারা দেশ ও বিদেশের মাটিতে দেশকে অনেক সোনালী সাফল্যও উপহার দিয়েছেন।

এর মধ্যে কমনওয়েলথ শ্যুটিংয়ে গোল্ড মেডেলিস্ট আসিফ হোসেন দেশের শ্যুটিং ইতিহাসের সব সময়ের অন্যদম সেরা ট্যালেন্ট। দেশের গন্ডি পেরিয়ে কমনওয়েলথ গেমস শ্যুটিংয়ে স্বর্ণ বিজয়ী আসিফ শুধু বিকেএসপির গর্ব নয়, দেশেরও সূর্য সন্তান। একইভাবে আরও কিছু নাম উঠে আসবে, যারা বিকেএসপি থেকে দেশকে সোনালী সাফল্য উপহার দিয়েছেন।

এর মধ্যে ৯৩’র ঢাকা সাফ গেমস এর দ্রুততম মানব বিমল চন্দ্র তরফদার, বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট অধিনায়ক নাঈমুর রহমান দুর্জয়, দেশের হকি ইতিহাসের সব সময়ের অন্যতম সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার মামুনুর রশিদ, দক্ষিণ এশীয় সাঁতারে একাধিক সোনালী সাফল্য বয়ে আনা কারার মিজান, আর্চারির দিয়া সিদ্দিকী, আব্দুর রহমান আলিফ ও মোঃ সাগর ইসলাম প্রমুখসহ বেশ কয়েকজন সত্যিকার জীবন্ত কিংবদন্তি ক্রীড়াবীদ আছেন।

ধারণা করছি হয়ত বিকেএসপি কর্তৃপক্ষ ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, শ্যুটিং, সাঁতার, আর্চারি থেকে ৫০ জনের জীবন্ত কিংবদন্তির তালিকা করতে গিয়ে কারো কারো নাম দিয়ে থাকতে পারেন। তবে মনে হয় ওই তালিকাটি ৫০ জনে সীমাবদ্ধ না রেখে ডিসিপ্লিন অনুযায়ী দিলে আরও কিছু ক্রীড়াবীদ কিংবদন্তির তালিকায় জায়গা পেতেন।

যাদের কয়েকজনের না থাকাটা রীতিমত বিস্ময়কর। আমি ব্যক্তিগতভাবে অবাক হয়েছি। এর মধ্যে হকিতে মাহফুজ আলম নিক্সনের নাম না থাকাটা বিস্ময়কর। বিকেএসপির ছাত্র হকি খেলোয়াড়দের মধ্যে মামুনুর রশিদ মামুনের পর নিক্সন সন্দেহাতীতভাবে সেরা ডিফেন্ডার। দেশের হকি ইতিহাসেরও অন্যতম সেরা সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার হিসেবে পরিগণিত নিক্সন।

ঢাকা মোহামেডান ও জাতীয় দলের হয়ে সুনামের সাথে প্রায় ৮-১০ বছর টানা খেলেছেন বিকেএসপির ছাত্র নিক্সন। বিকেএসপির ৩৯ বছরের ইতিহাসে হকির লিজেন্ডদের তালিকায় নিক্সন নেই! এটা মেনে নেয়াও কঠিন। এছাড়া সেন্টার হাফ হায়দার আলমের না থাকাটাও বিস্ময়কর ঠেকেছে।

একইভাবে লেফট উইঙ্গার রমিজ, রাইট আউট রাজু, যিনি এখন বিকেএসপিতে কোচিং করান, সেন্টার ফরোয়ার্ড হাবুল ও ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার বিপ্লবও দেশের হকির বড় নাম। তারাও বিবেচনায় আসতে পারতেন।

এর বাইরে বিকেএসপির আলোকে আরও একজন ফুটবলারের নাম থাকতে পারতো। তিনি যে দেশজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তা নয়। তবে বিকেএসপির ফুটবলের প্রথম ব্যাচে যে ক’জন ঢাকা লিগে নাম কুড়িয়েছেন, তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। নাম বখতিয়ার। বিকেএসপি ফুটবলারদের মধ্যে দেশের মানুষ প্রথম বখতিয়ারের নামই শুনেছিল। মিডিয়ায় বখতিয়ারের নামই প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর এসেছে মাসুদ রানার নাম।

এছাড়া অকাল প্রয়াত লেফট উইং ব্যাক মাসুমও দেশের ফুটবলে অল্প কয়েক বছর বেশ দাপটের সাথে খেলে দারুণ সুনাম অর্জন করেছিলেন। মাসুমও থাকতে পারতেন তালিকায়।

ক্রিকেটে আল শাহরিয়ার রোকনের নাম না থাকাটা অস্বাভাবিক ঠেকেছে। বিকেএসপি থেকে যে ক’জন ক্রিকেটার উঠে এসে জাতীয় দলে খেলেছেন, তাদের মধ্যে আল শাহরিয়ার রোকনের আগে আর কারো নাম থাকার কথা নয়। তার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাফল্য ও ইতিহাস, পরিসংখ্যান কি? সেটা বিবেচ্য নয়। তবে মেধা ও প্রতিভাকে মানদণ্ড ধরলে রোকনকেই এ যাবৎকালের বিকেএসপিয়ানদের মধ্যে সবচেয়ে ট্যালেন্টেড ব্যাটার ভাবা হয়।

বিকেএসপির ক্রিকেট লিজেন্ডদের মধ্যে আল শাহরিয়ার রোকন হবেন অটো চয়েজ; কিন্তু তার নামটি বিবেচনায় আসেনি। এছাড়া ১৯৯৯ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলা সিমিং অলরাউন্ডার নিয়ামুর রশিদ রাহুল, নাসির হোসেন এবং মফিজুর রহমান মুন্নাকেও বিবেচনায় আনা যেত।

তারপরও বিকেএসপি কর্তৃপক্ষ প্রশংসা পেতেই পারেন। তাদের বিবেচনাও যথেষ্ঠ প্রশংসাযোগ্য। তারা কোন অখ্যাত ও বিতর্কিত কাউকে মনোনীত করেননি। তবে ওপরে আমি যাদের নাম বললাম তাদের বিবেচনায় আনা যেত।

এআরবি/আইএইচএস