আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। এটি কেবল জাতীয় জীবনে শোক পালনের দিন নয়, বরং এক গভীর আত্মজিজ্ঞাসা ও নবশপথ গ্রহণের মুহূর্ত। বিজয়ের সূর্যোদয়ের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে যে মেধাবী সন্তানদের আমরা হারিয়েছি, তাদের স্মরণ করার অর্থ শুধু অশ্রুপাত নয়। এই দিবস পালনের সার্থকতা নিহিত রয়েছে সেই আদর্শগুলো বাস্তবায়নের দৃঢ় প্রতিজ্ঞায়, যার জন্য তারা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। একই সাথে যে অন্ধকার শক্তি একটি জাতির মেধা ও আত্মা ধ্বংস করতে চেয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে সদা জাগ্রত থাকার সংকল্প গ্রহণের দিন আজ।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের সেই নির্মম হত্যাকাণ্ডকে বুঝতে হলে এর পেছনের উদ্দেশ্য অনুধাবন করা অপরিহার্য। এটি কোনো আকস্মিক নৃশংসতা ছিল না; ছিল একটি জাতিকে জন্মের আগেই বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়ার সুগভীর চক্রান্ত। বিজয়ের ঊষালগ্নে যখন পরাজয় অত্যাসন্ন, তখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর—রাজাকার, আলবদর ও আলশামস—এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বেছে বেছে ধরে নিয়ে আসে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। এই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের মূল লক্ষ্য ছিল সদ্য স্বাধীন হতে যাওয়া বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ মেধাশূন্য করে দেওয়া।
লক্ষ্যবস্তু ছিলেন তারা, যারা একটি নতুন দেশের পথ দেখাতে পারতেন। তাদের মধ্যে ছিলেন প্রথিতযশা সাহিত্যিক, নির্ভীক সাংবাদিক, মানবদরদী চিকিৎসক এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের বরেণ্য ব্যক্তি। তারা কেবল ব্যক্তি ছিলেন না, ছিলেন একেকটি প্রতিষ্ঠান—একটি স্বপ্নের বাংলাদেশের পথপ্রদর্শক। এই পরিকল্পিত শূন্যতা সৃষ্টির প্রচেষ্টা এটাই প্রমাণ করে যে, শহীদ বুদ্ধিজীবীরা যে জ্ঞানভিত্তিক, সমৃদ্ধ ও সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন, সেটিই ছিল হানাদার ও তাদের দোসরদের মূল আতঙ্কের কারণ।
বিজয়ের ঊষালগ্নে পরাজয় অত্যাসন্ন জেনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের হত্যায় মেতে ওঠে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে বেছে বেছে ধরে নিয়ে আসা হয় সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিকিৎসকসহ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের।
এরপর নির্মম পৈশাচিকতায় তাদের হত্যা করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল জাতিকে মেধাশূন্য করা। স্বাধীনতা পেয়েও বাঙালি জাতি যেন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সেই নীলনকশা বাস্তবায়ন করাই ছিল বুদ্ধিজীবী হত্যার হীন উদ্দেশ্য। এই দিবসে জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে সেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের, যারা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন।
একাত্তরের ডিসেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে বুদ্ধিজীবীদের ধরে এনে হত্যা করা হয় জগন্নাথ হল, রায়েরবাজারের নদীতীর ও মিরপুরের কয়েকটি স্থানে। ডা. ফজলে রাব্বী, আবদুল আলীম চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, সেলিনা পারভীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সন্তোষ ভট্টাচার্য, সিরাজুল হক, চিকিৎসক গোলাম মুর্তোজা, আজহারুল হক, হুমায়ুন কবীর, মনসুর আলীসহ অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয় এ সময়।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, স্বাধীনতা অর্জনের মতোই তা রক্ষা করা এবং এর আদর্শ বাঁচিয়ে রাখাও এক নিরন্তর সংগ্রাম। এই দিনে আমাদের শুধু শোক প্রকাশ করলে চলবে না, বরং নতুন করে শপথ নিতে হবে। এই শপথ হোক দ্বিমুখী: প্রথমত, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জীবনের সর্বস্তরে ধারণ করার; দ্বিতীয়ত, শহীদদের স্বপ্নের সেই আত্মমর্যাদাশীল বাংলাদেশ বিনির্মাণে আত্মনিয়োগ করার।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে এবং যুদ্ধ চলাকালে হত্যা করা হয় জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, গোবিন্দ চন্দ্র দেবসহ আরও অনেক বুদ্ধিজীবীকে। মুনীর চৌধুরী, আলতাফ মাহমুদ ও শহীদুল্লা কায়সারও একইভাবে হত্যার শিকার হন। এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের সর্বপ্রথম শিকার হয়েছিলেন অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা।
স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় একটি জাতীয় কমিটির মাধ্যমে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করার উদ্যোগ নিলেও তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
তাছাড়া শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী হত্যার স্মৃতিচারণ থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে। বাংলাপিডিয়ার হিসাব মতে, মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে সারাদেশে ১ হাজার ১১১ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৪৯ জন ছিল ঢাকায়। কিন্তু ঢাকার বাইরের জেলাগুলোর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সেভাবে স্মরণ করা হয় না।
বাংলাপিডিয়ার হিসাব মতে, কুমিল্লায় মারা গেছে ৮৬ জন, যশোরে ৯১, রংপুরে ৭২, দিনাজপুরে ৬১, পাবনায় ৫৩, ময়মনসিংহে ৭৫, ফরিদপুরে ৪৩, চট্টগ্রামে ৬২, খুলনায় ৬৫, বরিশালে ৭৫ এবং রাজশাহীতে ৫৪ জনসহ সব মিলিয়ে বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা ১ হাজার ১১১ জন। গবেষকদের মতে, এ তালিকাও অসম্পূর্ণ। ইতিহাসের স্বার্থেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়ন ও তাদের স্মৃতি সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরি।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ কেবল তাদের হত্যাকাণ্ডের বিভীষিকায় সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়; বরং তাদের স্বপ্নের ইতিবাচক ও গঠনমূলক রূপরেখা অনুধাবন করা অপরিহার্য। এই স্বপ্নই আমাদের জাতির নৈতিক দিকনির্দেশনা। তাদের স্বপ্ন ছিল এক অখণ্ড রূপকল্প: এমন এক বাংলাদেশ যা হবে শোষণ ও বঞ্চনাহীন, যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের মর্যাদা হবে সুরক্ষিত; এমন এক দেশ যা হবে ক্ষুধামুক্ত, যেখানে মৌলিক চাহিদাগুলো হবে সহজলভ্য; এবং এমন এক জাতি যা কেবল অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ নয়, বরং এক উদার ও সংস্কৃতিবান সত্তা নিয়ে বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।
এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করাই হতে পারে তাদের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রেষ্ঠ সম্মান। কেবল তখনই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জানানো সার্থক হবে, যখন আমরা তাদের স্বপ্নের বাংলাদেশকে বাস্তবে রূপ দিতে সক্ষম হবো। এই স্বপ্ন ধারণ করা এবং একে বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাওয়াই আমাদের প্রধান জাতীয় কর্তব্য।
ইতিহাসের এই নির্মম অধ্যায় আমাদের বর্তমানের জন্যও এক জরুরি সতর্কবার্তা বহন করে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ১৯৭১ সালে যে অপশক্তি পরাজিত হয়েছিল, তাদের অস্তিত্ব পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায়নি। সেই পরাজিত শক্তি ও তাদের ভাবাদর্শ আজও নানা রূপে আমাদের সমাজে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করে এবং সুযোগ পেলেই দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের অন্যতম শিক্ষা হলো, মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি যাতে আর কখনোই মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, সে বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা। যে কোনো ধরনের দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ থাকা এখন সময়ের দাবি। যারা ঐতিহাসিক বিকৃতি ও বিভাজনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করতে চায় এবং দেশকে পেছনের দিকে টেনে নিতে চায়, তাদের বিষয়ে বিন্দুমাত্র শৈথিল্য প্রদর্শনের সুযোগ নেই। এই সতর্কতা ও প্রতিরোধই শহীদদের রক্তের ঋণ শোধ করার অন্যতম উপায়।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, স্বাধীনতা অর্জনের মতোই তা রক্ষা করা এবং এর আদর্শ বাঁচিয়ে রাখাও এক নিরন্তর সংগ্রাম। এই দিনে আমাদের শুধু শোক প্রকাশ করলে চলবে না, বরং নতুন করে শপথ নিতে হবে। এই শপথ হোক দ্বিমুখী: প্রথমত, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জীবনের সর্বস্তরে ধারণ করার; দ্বিতীয়ত, শহীদদের স্বপ্নের সেই আত্মমর্যাদাশীল বাংলাদেশ বিনির্মাণে আত্মনিয়োগ করার।
তাদের দেখানো পথই আমাদের পাথেয়। সেই আলোকবর্তিকা সমুন্নত রাখার দায়িত্ব আজ আমাদের সবার। এই দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই আমরা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি আমাদের সত্যিকারের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিবেদন করতে পারি।
একটি সমাজ বা রাষ্ট্রে এই নক্ষত্রসম মানুষরাই জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যান। এ কারণে তারা লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শোষণ, বৈষম্যসহ নানা নিপীড়নের প্রতিবাদ আসে বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকেই। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে যা পরবর্তীসময়ে স্বাধিকার আন্দোলনে রূপ নেয়।
রাজনৈতিক আন্দোলনে গতি আনে সাংস্কৃতিক আন্দোলন। বুদ্ধিজীবীরা এমন একটি সংস্কৃতি নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন, যা পরাধীনতার অন্ধকার থেকে দেশকে নিয়ে যাবে আলোর ভুবনে। সেই আলোর পথে হাঁটতেই বাঙালি জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বাধিকার আন্দোলনে। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনে লাল সবুজের পতাকা।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট। ডেপুটি এডিটর, জাগো নিউজ। drharun.press@gmail.com
এইচআর/এমএফএ/জেআইএম