বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ খাতের যাত্রা অনেক দীর্ঘ এবং বিস্তৃত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। এই খাতের যাত্রা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ইতিহাসের মতোই পরিবর্তনশীল ও চ্যালেঞ্জপূর্ণ। স্বাধীনতার পর পুরো খাতটি ছিল সরকারি মালিকানাধীন বিটিটিবি’র কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণের ওপর নির্ভরশীল। অবকাঠামোগত পশ্চাৎপদতা, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা এবং বিনিয়োগ-বান্ধব বাজার কাঠামোর অভাবে টেলিযোগাযোগ তখন ছিল জাতীয় অগ্রগতির অন্তরায়। তখন টেলিফোন ছিল এক ধরনের বিলাসপণ্য, এবং একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের অধীন একটি ব্যয়বহুল ও সীমিত সেবা, যেখানে বিটিটিবি’র অধীনে টেলিফোন পাওয়া ছিল বছরের পর বছর অপেক্ষার বিষয়। সেই সময়ের অবকাঠামো, প্রযুক্তি ও বাজারচিন্তা সবই ছিল সীমিত, এবং রাষ্ট্রীয় মনোপলির কারণে নতুন উদ্ভাবন বা বিনিয়োগ আকর্ষণের সুযোগও ছিল না। নব্বইয়ের দশকে বেসরকারি খাতের প্রথম মোবাইল কোম্পানি কার্যক্রম শুরু করার মাধ্যমে বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ খাত নতুন রূপ পেতে থাকে। প্রযুক্তি-উদ্ভাবন ও বাজারমুখী নীতির ফলে অল্প কয়েক দশকের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বড় মোবাইল বাজারে পরিণত হয়। এর ফলে টেলিযোগাযোগের অবকাঠামো বিস্তার ত্বরান্বিত হয়, এবং গ্রাহকসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পুরো খাতটি দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে আধুনিক যুগে প্রবেশ করায়। এক সময় যেখানে হাতে গোনা কয়েক হাজার টেলিফোন সংযোগ ছিল, সেখানে এখন সংযোগের সংখ্যা কোটি পেরিয়ে গেছে। ইন্টারনেট সেবা বিস্তৃত হয়ে মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু বৈশ্বিক প্রযুক্তি অগ্রগতি—বিশেষ করে সাইবার নিরাপত্তা, জাতীয় ডাটা সার্বভৌমত্ব, ৫জি–৬জি ট্রানজিশন, ক্লাউড অবকাঠামো, আইওটি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগ—টেলিযোগাযোগ শাসনব্যবস্থাকে আরও আধুনিক, আরও শক্তিশালী ও আরও পূর্বানুমানযোগ্য কাঠামোর দাবি করে। সেই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ আইন ২০২৫ প্রণয়ন করা হয়, যা দেশের টেলিকম শাসনব্যবস্থাকে একটি নতুন মাত্রা দিয়েছে, তবে এই রূপান্তর নিয়ে প্রশ্ন ও উদ্বেগও তৈরি হয়েছে।
এই পরিবর্তনের কেন্দ্রে ছিল বিটিআরসি, যাকে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাজার নিয়ন্ত্রণ, লাইসেন্সিং, ট্যারিফ মূল্যায়ন, প্রতিযোগিতা নিশ্চিতকরণ, স্পেকট্রাম ব্যবস্থাপনা এবং সেবা মান নির্ধারণের দায়িত্ব দেয়া হয়। কমিশন সরকারের নীতি নির্দেশনা এবং বাজার বাস্তবতার মাঝে একটি মধ্যবর্তী ও যুক্তিনির্ভর অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করেছে বহু বছর। যদিও বহুবার এর স্বাধীনতা নিয়ে বিতর্ক উঠেছে, তথাপি সামগ্রিকভাবে বিটিআরসি একটি প্রযুক্তি-কেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কার্যকর ছিল।
দেশের অভ্যন্তরে ডিজিটাল সেবা বিস্তৃত হওয়ার পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বা বিটিআরসি। নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা মূলত নীতিমালা বাস্তবায়ন, ট্যারিফ নিয়ন্ত্রণ, বাজার প্রতিযোগিতা পর্যবেক্ষণ, লাইসেন্স প্রদান, সেবা মান নিশ্চিত করা এবং স্পেকট্রাম ব্যবস্থাপনা। এসব ক্ষেত্রেই বিটিআরসি দীর্ঘ সময় ধরে সরকারের নীতি নির্দেশনার বাইরে একটি নিরপেক্ষ, স্বাধীন এবং প্রযুক্তি-ভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে এসেছে। যদিও পুরোপুরি স্বাধীনতার দাবি ওঠে মাঝে মধ্যেই, তবুও সামগ্রিকভাবে কমিশন ছিল সরকারের নীতি ও বাজারের বাস্তবতার মধ্যে একটি সমন্বয়ের জায়গা।
সময়ের পরিবর্তন এবং প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশের কারণে নতুন আইন প্রণয়নের প্রয়োজন দেখা দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৫ সালে নতুন টেলিযোগাযোগ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ শাসনব্যবস্থাকে মৌলিকভাবে পরিবর্তন করছে। এই আইনকে কেন্দ্র করে খাতে নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনা ও পর্যালোচনা চলছে। একটি মধ্যম আয়ের দেশের টেলিযোগাযোগ আইন হিসেবে এটি কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা, স্বচ্ছতা এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করবে কি না—সে প্রশ্নও উত্থাপিত হয়েছে।
নতুন আইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হলো “জাতীয় গুরুত্বের লাইসেন্স” ধারণা, যার অধীনে কোন কোন লাইসেন্স এই ক্যাটাগরিতে পড়বে, তা নির্ধারণ করবে সরকার এবং সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে বিটিআরসি। সরকার চাইলে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করে এসব লাইসেন্সের সংখ্যা নির্ধারণ করবে এবং বিটিআরসিকে সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লাইসেন্স প্রদান বা স্থগিত করতে হবে। লাইসেন্স প্রদানে সরকারের এই সরাসরি নিয়ন্ত্রণ মূলত নিয়ন্ত্রকের প্রথাগত স্বাধীনতাকে সীমিত করে। উন্নত ও উদীয়মান টেলিযোগাযোগ বাজারগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, সেখানে সরকার নীতি নির্ধারণ করে, কিন্তু লাইসেন্সিং ও বাজার মূল্যায়ন করে স্বাধীন সংস্থা। ভারতের ট্রাই, মালয়েশিয়ার এমসিএমসি, সিঙ্গাপুরের আইএমডিএ এবং যুক্তরাজ্যের অফকম—সব জায়গায়ই লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন, বাজার মূল্যায়ন ও প্রতিযোগিতা পর্যবেক্ষণ নিয়ন্ত্রক সংস্থার একচ্ছত্র দায়িত্ব। ফলে সরকারের নীতিমালার রাজনৈতিক চাপ নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রযুক্তিগত ও ব্যবসাবান্ধব সিদ্ধান্তগুলোকে প্রভাবিত করতে পারে না।
বৈশ্বিক অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, সিঙ্গাপুরের Infocom Media Development Authority (IMDA), দক্ষিণ কোরিয়ার Korea Communication Commission (KCC), থাইল্যান্ডের National Broadcasting and Telecommunications Commission (NBTC) কিংবা ভিয়েতনামের Ministry of Information and Communications (MIC)—সব জায়গাতেই বাজার-সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্তের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয় যাতে রাজনৈতিক প্রভাবহীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। সিঙ্গাপুরে লাইসেন্সিং সম্পূর্ণ বাজার বিশ্লেষণ, প্রতিযোগিতা অবস্থা এবং প্রযুক্তিগত মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে হয়; সরকারের ভূমিকা থাকে শুধু নীতি-নির্ধারণে। দক্ষিণ কোরিয়ায় লাইসেন্সিং ক্ষমতা নিয়ন্ত্রকের হাতে থাকা সত্ত্বেও নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে সরকার নীতি ঘোষণা করে, কিন্তু বাজার সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করে না। বাংলাদেশে এই কাঠামোটি উল্টো দিকে যাচ্ছে, যেখানে বাজার সিদ্ধান্তে সরকারের সরাসরি উপস্থিতি স্পষ্টতই বাড়ছে।
ট্যারিফ নির্ধারণের ক্ষেত্রেও নতুন আইনে দ্বৈত কাঠামো সৃষ্টি হয়েছে। অপারেটররা এখন মন্ত্রণালয়ে সরাসরি ট্যারিফ প্রস্তাব দিতে পারবে এবং মন্ত্রণালয় চাইলে সিদ্ধান্ত গ্রহণেও ভূমিকা রাখতে পারবে। অথচ প্রতিযোগিতামূলক বাজার অর্থনীতিতে ট্যারিফ মূল্যায়ন একটি অত্যন্ত প্রযুক্তিগত ও স্বাধীন সিদ্ধান্ত। ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ট্যারিফ নির্ধারণ করা হয় ব্যয় কাঠামো, প্রযুক্তিগত দক্ষতা, বাজার প্রতিযোগিতা এবং সাশ্রয়ী মূল্যের আন্তর্জাতিক তুলনার মাধ্যমে। সিঙ্গাপুরে অপারেটররা ট্যারিফ প্রস্তাব করে, কিন্তু নিয়ন্ত্রকই স্বাধীনভাবে মূল্যায়ন করে দেখে তা বাজার প্রতিযোগিতাকে প্রভাবিত করবে কি না। বাংলাদেশে ট্যারিফ সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক স্তরে চলে গেলে প্রতিযোগিতা-বান্ধব পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং অপারেটরদের স্বাধীন ব্যবসায়িক পরিকল্পনা অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে।
আরেকটি মৌলিক পরিবর্তন হলো বিটিআরসির প্রশাসনিক স্বাধীনতা হ্রাস। নিয়ন্ত্রকের কর্মী নিয়োগ, বদলি, ক্ষমতা প্রদান—সবকিছুর ওপর মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে নিয়ন্ত্রক সংস্থার স্বাধীনতা শুধু আইনগত বা আর্থিক স্বাধীনতা নয়; এটি প্রতিযোগিতামূলক বাজারের মৌলিক শর্ত। থাইল্যান্ডের NBTC তাদের নিজস্ব বাজেট পরিচালনা করে, নিজেদের কর্মী নিয়োগ দেয় এবং সরকার সরাসরি কোন প্রশাসনিক প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। সিঙ্গাপুরে IMDA–র পরিচালনায় সরকারের প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ, যাতে বাজার সিদ্ধান্ত সবসময় প্রযুক্তিগত ভিত্তিতে হয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় KCC–র স্বাধীনতা এতটাই সুদৃঢ় যে দেশটি টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তিতে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষে উঠতে পেরেছে। বাংলাদেশে নতুন আইন প্রশাসনিক ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ের হাতে সরিয়ে নিয়ন্ত্রককে কার্যত বাস্তবায়নকারী সংস্থায় পরিণত করছে, যা আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার ঠিক বিপরীত।
লাইসেন্স নবায়ন, বাতিলকরণ ও স্পেকট্রাম ব্যবস্থাপনায় সরকারের ভূমিকা আরও বৃদ্ধি পাওয়ায় বাজারে পূর্বানুমানযোগ্যতা কমে যাবে। স্পেকট্রাম একটি দেশের সবচেয়ে মূল্যবান পাবলিক রিসোর্সগুলোর একটি, যা সুষ্ঠু মূল্যায়ন ছাড়া বাজারের ক্ষতি করতে পারে। থাইল্যান্ডের 4G–5G স্পেকট্রাম নিলাম নিয়ন্ত্রক সংস্থা স্বাধীনভাবে পরিচালনা করেছে এবং সেজন্য তারা বিপুল বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। সিঙ্গাপুরে স্পেকট্রাম বরাদ্দ কঠোর প্রযুক্তিগত মূল্যায়ন ও দীর্ঘমেয়াদি বাজার বিশ্লেষণের ভিত্তিতে হয়। ভিয়েতনাম সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্পেকট্রাম নীতিকে আরও স্বাধীন করেছে যাতে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সাথে সঙ্গতি থাকে। বাংলাদেশে নতুন কাঠামো রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতার ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে, যা অপারেটরদের অনিশ্চয়তায় ফেলবে এবং নতুন বিনিয়োগ কমিয়ে দিতে পারে।
বাংলাদেশের মতো মধ্যম আয়ের একটি দেশের টেলিযোগাযোগ বাজারে এসব পরিবর্তনের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে বড় ধরনের অর্থনৈতিক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। পুরোপুরি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ-নির্ভর বাজার কাঠামো বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করবে। স্পেকট্রাম নিলাম তখন আর বাজার-প্রতিযোগিতা বা প্রযুক্তিগত সক্ষমতার ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হবে না; বরং সিদ্ধান্তসমূহ কতটা রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য—তার ওপর নির্ভর করতে পারে। ফলে বড় অপারেটররা রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে, আর নতুন অপারেটর বা ছোট উদ্যোক্তারা বাজারে প্রবেশ করতে নিরুৎসাহিত হবে।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তুলনায় বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রক স্বাধীনতা তুলনামূলকভাবে কম। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইনে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও নিয়ন্ত্রকরা অধিকতর স্বাধীন। অন্যদিকে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা শক্তিশালী ও বাজার-বান্ধব। নতুন আইনে ইতিবাচক দিকও রয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা, সাইবার ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো সুরক্ষা এবং রাষ্ট্রীয় সমন্বয় আরও শক্তিশালী হয়েছে। সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়াতেও নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট ক্ষমতা সরকারের হাতে থাকে, তবে তা স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত এবং বাজার সিদ্ধান্ত থেকে পৃথক থাকে। বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ হলো নিরাপত্তার নামে বাজারে অতিরিক্ত প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ যেন না হয়।
টেলিকম অ্যাক্ট ২০২৫–কে সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে প্রয়োজন হবে স্বচ্ছতা, জনপরামর্শ, ক্ষমতার সুস্পষ্ট বণ্টন এবং নিয়ন্ত্রকের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার। সরকারের নীতিগত ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না; জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণও অপরিহার্য। কিন্তু বাজার পরিচালনার দায়িত্ব প্রযুক্তিগত সক্ষম প্রতিষ্ঠান বিটিআরসির হাতে রাখতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাব থেকে বাজার সিদ্ধান্ত মুক্ত না হলে দেশের ডিজিটাল অর্থনীতি কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে না।
তবুও আইনটিতে ইতিবাচক কিছু উপাদান রয়েছে। যেমন জাতীয় নিরাপত্তা, সাইবার ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো সুরক্ষা এবং রাষ্ট্রীয় সমন্বয় বাড়ানোর বিষয়গুলো নতুন আইনে আরও শক্তিশালী হয়েছে। সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়ায়ও নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট কিছু বিশেষ ক্ষমতা সরকারের হাতে থাকে, তবে সেগুলো সবসময় স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত, এবং বাজার সিদ্ধান্ত থেকে পৃথক। বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ হলো এই দুই ধরনের ক্ষমতার সীমানা পরিষ্কার রাখা—নিরাপত্তার নামে বাজার সিদ্ধান্তে অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ যেন না হয়।
নতুন আইনের সমালোচনার মূল জায়গা এখানেই। বাজার, উদ্ভাবন এবং প্রতিযোগিতার ভিত্তি যেসব দেশে শক্তিশালী, তারা সবাই—থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম—স্বাধীন নিয়ন্ত্রক কাঠামোকে শক্তিশালী করেছে, রাজনৈতিক প্রভাব কমিয়েছে এবং প্রযুক্তিগত সিদ্ধান্তগুলোকে বিশেষজ্ঞদের হাতে রেখেছে। আর বাংলাদেশ নতুন আইনে সেই স্বাধীনতার জায়গাটি সংকুচিত করেছে। ভবিষ্যতের ৫জি–৬জি, ইন্টারনেট অব থিংস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডাটা সেন্টার ইন্ডাস্ট্রি, সাইবার ইন্সট্রুমেন্টেশন, স্যাটেলাইট ব্রডব্যান্ড—এসব খাতে প্রবৃদ্ধি তখনই সম্ভব যখন বাজারে স্বচ্ছতা থাকবে, নিয়ন্ত্রক স্বাধীন থাকবে এবং বিনিয়োগকারী নিশ্চিত থাকবে যে প্রশাসনিক পরিবর্তনে নিয়মের ব্যাখ্যা বদলে যাবে না।
বাংলাদেশ যদি সিঙ্গাপুরের মতো দক্ষিণ এশিয়ার প্রযুক্তিকেন্দ্র হতে চায়, তবে বর্তমান আইনকে বাজারমুখী, স্বাধীন এবং প্রযুক্তিগত সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল কাঠামোতে পরিণত করতেই হবে। ভিয়েতনাম দ্রুত এগোচ্ছে কারণ তাদের নীতিগত স্থিতিশীলতা এবং নিয়ন্ত্রক স্বাধীনতা বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াচ্ছে। থাইল্যান্ড শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক কাঠামো এবং প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি করে ৫জি রোল-আউটে আঞ্চলিক নেতৃত্ব দেখিয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া প্রযুক্তিতে বিশ্বসেরা কারণ তারা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং প্রযুক্তিগত সিদ্ধান্তের মধ্যে সুস্পষ্ট বিভাজন রেখেছে। বাংলাদেশকেও সেই পথেই এগোতে হবে।
টেলিকম অ্যাক্ট ২০২৫–কে সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে প্রয়োজন হবে স্বচ্ছতা, জনপরামর্শ, ক্ষমতার সুস্পষ্ট বণ্টন এবং নিয়ন্ত্রকের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার। সরকারের নীতিগত ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না; জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণও অপরিহার্য। কিন্তু বাজার পরিচালনার দায়িত্ব প্রযুক্তিগত সক্ষম প্রতিষ্ঠান বিটিআরসির হাতে রাখতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাব থেকে বাজার সিদ্ধান্ত মুক্ত না হলে দেশের ডিজিটাল অর্থনীতি কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে না।
বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশের পথে অগ্রসর হচ্ছে, যার জন্য একটি স্বাধীন, শক্তিশালী এবং বিনিয়োগবান্ধব টেলিযোগাযোগ শাসন কাঠামো অপরিহার্য। নতুন আইনে ইতিবাচক পরিবর্তন থাকলেও বাজার-স্বাধীনতা ও নিয়ন্ত্রক–ক্ষমতা সীমিত হওয়ার ঝুঁকি টেলিযোগাযোগ খাতকে দীর্ঘমেয়াদে দুর্বল করতে পারে। সঠিক সময়েই আইনটি আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী পরিমার্জন করা গেলে, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার শক্তিশালী ডিজিটাল অর্থনীতিতে পরিণত হতে পারে; অন্যথায় টেলিযোগাযোগ খাত তার সম্ভাবনার অনেকটাই হারাতে পারে। আর এজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, স্বচ্ছ সংস্কার মানসিকতা এবং প্রযুক্তিগতভাবে শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক কাঠামো—যা বাংলাদেশকে আগামী দশকের ডিজিটাল প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার পাশাপাশি স্মার্ট প্রতিযোগিতা রুপান্তর করতে সহায়তা করবে।
লেখকঃ অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্টMizan12bd@yahoo.com
এইচআর/এমএস