জাতিগত হত্যা, ধর্ষণ, ৪৩ লাখ বাস্তুচ্যুত আর ভয়াবহ খাদ্য সংকটে জর্জরিত আফ্রিকার দেশ সুদান। দীর্ঘ দিনের গৃহযুদ্ধে সুদানজুড়ে অন্তত দেড় লাখ মানুষ নিহত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সুদানে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকটের ঘোষণা দিয়েছে জাতিসংঘ। অথচ এ দেশের বিভিন্ন খনিতে রয়েছে শত শত টন সোনা। এছাড়া তেলসমৃদ্ধ সুদানের গৃহযুদ্ধে ভূমিকা রাখছে কালোবাজারে বিক্রি করা এসব সম্পদের অর্থ। সোনা থাকলেও অব্যবস্থাপনা আর ক্ষমতার দ্বন্দ্বে দেশটিতে অন্তত ২৫ লাখ মানুষ অনাহারে দিন কাটাচ্ছে।
সুদান গৃহযুদ্ধের ইতিহাস
১৯৫৬ সালের আগ পর্যন্ত যুক্তরাজ্য ও মিশরের অধীনে শাসিত হয়ে আসছিল সুদান। মিশরের সহযোগিতায় ১৯৫৬ সালের ১ জানুয়ারি স্বাধীনতা লাভ করে দেশটি। এরপর দীর্ঘ সময় দক্ষিণ সুদান ও বর্তমান সুদানের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলমান ছিল, যা মূলত জাতিগত ও ধর্মীয় দ্বন্দ্ব। ১৯৮৩ সালে প্রেসিডেন্ট জাফর নুমায়ের ইসলামিক শরিয়াহ আইন প্রবর্তন করলে দক্ষিণ সুদানের সঙ্গে তীব্র গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এমন পরিস্থিতিতে সুদানের সামরিক বাহিনী ও ইসলামি রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা পরিকল্পিত একটি অভ্যুত্থান ঘটানো হয়। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৯৮৯ সালের ৩০ জুন সুদানের ক্ষমতায় আসেন ওমর আল-বশির। তখন সুদানের আর্মি ইন্টেলিজেন্সের একজন উচ্চপদস্থ অফিসার ছিলেন বশির। তিনি অভ্যুত্থানটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
কিন্তু ২০১৯ সালে ভাগ্যের নির্মম পরিণতি মেনে নিতে হয় বশিরকে। তার বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে সুদানে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। এর ধারাবাহিকতায় সেনাবাহিনী আরেকটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের পতন ঘটায়। তবে সাধারণ মানুষ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে বিক্ষোভ অব্যাহত রাখে। বিক্ষোভের মুখে সেনাবাহিনী ও বেসামরিক প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে সরকার প্রতিষ্ঠা হয় কিন্তু ২০২১ সালের অক্টোবরে আরেকটি অভ্যুত্থানে ওই সরকারও ক্ষমতাচ্যুত হয়।
ওই অভ্যুত্থানের পেছনে মূলত যে দুজন ব্যক্তি ছিলেন তারা হলেন- জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং জেনারেল মোহামেদ হামদান দাগালো। জেনারেল আল-বুরহান সুদানের সশস্ত্র বাহিনী (সেনাবাহিনী) অংশের প্রধান এবং সে কারণে তিনিই দেশটির প্রেসিডেন্ট। আর হামাদান দাগালোর্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস বা আরএসএফের কমান্ডার। কুখ্যাত প্যারা-মিলিটারি ফোর্স (আরএসএফ) এই আরএসএফ ই সুদানে বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ করছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সংবাদে খবর প্রকাশিত হচ্ছে। বুরহান আর দাগালোর দুই বাহিনী সুদান সংকট সৃষ্টিতে দায়ী।
যুদ্ধের মূল রসদ সোনা-তেলের খনি
সুদানের আবিষ্কৃত বিভিন্ন খনিতে কয়েকশ টন সোনা মজুত আছে বলে দাবি করা হচ্ছে। এছাড়া আরও খনি অনাবিষ্কৃত থাকতে পারে। সুদানের সবচেয়ে বড় সোনার খনি জেবেল আমের। খনিটি সরাসরি আরএসএফের নিয়ন্ত্রণে। দাগালোর পরিবারের সঙ্গেও জড়িত আল-জুনায়েদ কোম্পানি খনিটি পরিচালনা করে আসছে। এছাড়া দারফুর ও দক্ষিণ কোর্দফান অঞ্চলের সোনার খনির বেশি ভাগের নিয়ন্ত্রণ এখন আরএসএফের হাতে।
২০২৪ সালে এসব খনি থেকে আরএসএফ অন্তত ১০ টন সোনা উত্তোলন করেছে, যার বাজার মূল্য ৮৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর বড় ক্রেতা দুই দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং মিশর। এসব সোনার ৮০ শতাংশ অবৈধ পথে পাচার হয়। পাচারের জন্য প্রসিদ্ধ রুট দারফুরের সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে ইথিওপিয়া হয়ে মিশর। অন্যটি দারফুরের সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে লিবিয়া এরপর আমিরাত। এছাড়া সুদানের সর্ববৃহৎ তেলক্ষেত্র হেগলিগ গত ৮ ডিসেম্বর দখল করে নেয় আরএসএফ। সোনা ও তেলের অর্থ দিয়ে কেনা হচ্ছে অস্ত্র, যা সাধারণ মানুষকে হত্যায় ব্যবহৃত হচ্ছে।
ভয়াবহ মানবিক সংকট ও মুদ্রাস্ফীতি
এই সংঘাতে সুদানজুড়ে মারা গেছে দেড় লাখের বেশি মানুষ। দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়েছে পুরো দেশে। প্রায় এক কোটি ২০ লাখ মানুষ নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। এছাড়া শত শত নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) জানিয়েছে, সুদানে বর্তমানে ৩ কোটি মানুষের মানবিক সহায়তা প্রয়োজন। এদের মধ্যে ৯৬ লাখ মানুষ দেশের ভেতরে বাস্তুচ্যুত, আর ৪৩ লাখ মানুষ পার্শ্ববর্তী দেশে পালিয়ে গেছে। এছাড়া তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে ৭ লাখের বেশি শিশু এবং ২৪ লাখের বেশি মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখে অনাহারে দিন কাটাচ্ছে।
যুদ্ধ শুরুর পর ধারাবাহিকভাবে কমেছে সুদানি পাউন্ডের মূল্য। ২০২৫ সালে দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১১৩ শতাংশে।
ইউনিসেফের কর্মকর্তা টেড চাইবান জানিয়েছেন, এই সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। প্রায় ১৪ লাখ শিশু দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে এবং ১ কোটি ৪০ লাখ শিশু বিদ্যালয়ের বাইরে রয়েছে, যা সুদানের মোট শিশুর চার-পঞ্চমাংশ। মাত্র উত্তর দারফুরেই চলতি বছর ১ লাখ ৫০ হাজার শিশু মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে।
সূত্র : মিডল ইস্ট মনিটর/ বিবিসি/ আল-জাজিরা
কেএম