মতামত

মুক্তির নব-সংজ্ঞা ও মানবিক রাষ্ট্রের চ্যালেঞ্জ

মহান বিজয়দিবস বাংলাদেশের জন্য কেবল যুদ্ধজয়ের ঐতিহাসিক স্মারক নয়, এটি এক জীবন্ত নৈতিক দলিল, যা জাতির আত্মপরিচয়, মূল্যবোধ ও ভবিষ্যৎ আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে দাঁড়িয়ে বিজয় দিবস উদ্‌যাপন মানে কেবল ১৯৭১ সালের বীরত্ব ও আত্মত্যাগ স্মরণ করা নয়, বরং বর্তমান সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বাস্তবতার কষ্টিপাথরে মুক্তির অর্থকে নতুনভাবে বিশ্লেষণ করা।

স্বাধীনতার দ্বিপাক্ষিক প্রকৃতি—যা একাধারে ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক মুক্তি এবং অন্যদিকে মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি—আজ বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের কাছে এক জটিল প্রশ্নের মুখোমুখি। দীর্ঘ অর্ধশতাব্দী অতিক্রান্ত এই সময়ে জাতি তার অর্জনের শীর্ষবিন্দুতে যেমন : দাঁড়িয়ে, তেমনি কাঠামোগত দুর্বলতা ও নতুন সংকটের একটি জটিল রূপরেখা উন্মোচিত হয়েছে। এই বছর বিজয়দিবস উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ তাই এক আত্মসমীক্ষার সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যেখানে মুক্তির স্বপ্ন পূরণের পথে চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা উভয়ই সমানভাবে বিদ্যমান।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল জাতির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম, যা গভীরভাবে প্রোথিত ছিল আত্মমর্যাদা, মানবাধিকার এবং শোষণমুক্ত একটি সমাজের আকাঙ্ক্ষায়। যুদ্ধের প্রতিটি অধ্যায়ে নিহিত ছিল স্বাধীনতার নৈতিক ভিত্তি, যা জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের সমতার বার্তা বহন করে। কিন্তু অর্ধশতকেরও বেশি সময় পরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি প্রজন্মগতভাবে বদলে গেছে। যুদ্ধ-অভিজ্ঞ প্রজন্মের স্মৃতি এখন ইতিহাসের মূল্যবান ভাণ্ডারে সংরক্ষিত, যা আবেগের গভীরতা বহন করে। অন্যদিকে, তরুণ প্রজন্ম—বিশেষ করে জেনারেশন জেড ও আলফা—মুক্তিযুদ্ধকে দেখছে একটি প্রতীকী শক্তি হিসেবে, যা তারা বিচার করছে বর্তমান শাসন কাঠামোর মূল্যবোধ, স্বচ্ছতা, বাক্‌স্বাধীনতা, সততা ও জবাবদিহিতার মানদণ্ডে।

এই নতুন প্রজন্ম দেশপ্রেমকে আর কেবল আবেগ বা ঐতিহ্যের বিষয় মনে করে না; তাদের কাছে দেশপ্রেম এখন ন্যায়বিচার, সুযোগের সমতা এবং রাষ্ট্রের প্রতি স্বচ্ছতার একটি প্রায়োগিক চাহিদা। তারা চায় স্বাধীনতার বাস্তব রূপটি তাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রতিফলিত হোক। এই প্রজন্মের কাছে বিজয় দিবস তাই একটি উৎসব নয়, বরং স্বাধীনতার ঘোষিত লক্ষ্যগুলো বাস্তবে কতটা পূরণ হয়েছে, তার একটি কড়া যাচাই প্রক্রিয়া। তারা প্রশ্ন করে: মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গঠিত রাষ্ট্র কেন বৈষম্য, দুর্নীতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার শিকার? এই আদর্শগত পরিবর্তনই প্রমাণ করে যে স্বাধীনতার চেতনা স্থবির নয়, বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিকশিত হচ্ছে, এবং তরুণরাই সেই বিকাশের প্রধান চালক।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা ২০২৫ সালে এক গভীর পুনঃমূল্যায়নের পথে। স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য ছিল একটি গণতান্ত্রিক, মানবিক রাষ্ট্র গঠন, যা জনগণের মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে। কিন্তু দীর্ঘ পথচলায় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভিত্তি দুর্বল হয়েছে, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব প্রকট হয়েছে এবং নাগরিক অংশগ্রহণ সীমিত হয়েছে। রাজনৈতিক মেরুকরণ জনমতকে বিভক্ত করেছে এবং ফলস্বরূপ সামাজিক সংহতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

নাগরিক সমাজে চলছে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, অংশগ্রহণমূলক নীতি ও কার্যকর জবাবদিহিতা নিয়ে নতুন আলোচনা। এই আলোচনাগুলি কেবল ক্ষমতায় কে আছে তা নিয়ে নয়, বরং রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হবে সেই প্রক্রিয়াগত দিক নিয়ে। জনগণ, বিশেষ করে যুবসমাজ, একটি ন্যায়সঙ্গত ও দায়িত্বশীল রাষ্ট্রের জন্য যে নিরন্তর দাবি তুলছে, তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনারই উন্নততর ও আধুনিক ব্যাখ্যা।

বিজয় দিবস এখানে পরিণত হয়েছে এমন একটি সময়ে, যখন জাতি নিজেদের প্রশ্ন করতে বাধ্য: স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরে আমরা কতটা ন্যায়সংগত এবং জনমুখী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি? রাষ্ট্রের দুর্বলতা, আইনের শাসনের অভাব এবং দুর্নীতির ব্যাপকতা প্রমাণ করে যে রাজনৈতিক মুক্তি অর্জিত হলেও, মানবিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন পূরণের সংগ্রাম এখনও চলছে। এই সংগ্রামে বিজয়ী হওয়ার জন্য প্রয়োজন শুধু ক্ষমতার হস্তান্তর নয়, বরং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা।

স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমে মুক্তিযুদ্ধের নতুন গবেষণা, সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ ও বাস্তবভিত্তিক তথ্য অন্তর্ভুক্তি জরুরি। তরুণদের কাছে মুক্তিযুদ্ধকে কেবল স্মৃতিধর্মী উপাখ্যান হিসেবে উপস্থাপন না করে, একে নৈতিক ও নাগরিক শিক্ষা হিসেবে গুরুত্ব দেওয়া উচিত, যা তাদের প্রশ্ন করতে, বিশ্লেষণ করতে এবং দায়িত্বশীল নাগরিক হতে শেখাবে। বিজয় দিবসকে তাই শুধু উৎসব নয়, ভবিষ্যৎ সমাজ গঠনের একটি শিক্ষামূলক প্ল্যাটফর্ম হিসেবেও বিবেচনা করা উচিত।

অর্থনৈতিক পরিবর্তন নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের মূল বাস্তবতা। তৈরি পোশাক শিল্প, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স, ক্ষুদ্রঋণ, গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ এবং প্রযুক্তি-নির্ভর উদ্যোক্তাদের উত্থান দেশের অর্থনীতিকে দ্রুত এগিয়ে নিয়েছে। বিশ্বের সামনে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের এক রোল মডেল হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এই আপাত সাফল্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে ন্যায্য বণ্টন এবং মানবিক নিরাপত্তার এক গভীর সংকট।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও তার সুফল কতটা ন্যায়সংগতভাবে সমাজের সকল স্তরে বণ্টিত হচ্ছে, তা আজ বড় প্রশ্ন। আয়বৈষম্য অতীতের যে-কোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রকট, যেখানে সম্পদ ও সুযোগ সুবিধা মুষ্টিমেয় শ্রেণির হাতে কেন্দ্রীভূত। শহর-গ্রামের ব্যবধান কেবল অবকাঠামোগত নয়, বরং সুযোগ প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও দৃশ্যমান। জীবনযাত্রার লাগামহীন ব্যয় এবং ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছিল শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা, কিন্তু ২০২৫ সালে সেই লক্ষ্য পরিণত হয়েছে ন্যায্য বণ্টন, ন্যূনতম সামাজিক নিরাপত্তা এবং সকল নাগরিকের মৌলিক মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে।

অর্থনৈতিক অগ্রগতির বিপরীতে, যুব বেকারত্ব আজ বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এক নীরব হুমকি এবং মানবিক মুক্তির পথে প্রধান অন্তরায়। বিশালসংখ্যক শিক্ষিত তরুণ জনগোষ্ঠী—যারা দেশের সবচেয়ে বড় শক্তি—চাকরি বা সম্মানজনক কর্মসংস্থানের অভাবে হতাশাগ্রস্ত। শিক্ষার সঙ্গে শ্রমবাজারের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে গভীর সংযোগহীনতা এই সংকটের অন্যতম প্রধান কারণ। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে বের হওয়া হাজার হাজার তরুণ উপযুক্ত কাজ পাচ্ছে না, কারণ তাদের পাঠ্যক্রম বাজারের উপযোগী দক্ষতা দিতে ব্যর্থ।

এই বেকারত্ব কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, এটি ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক পর্যায়ে গভীর মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করে। কর্মসংস্থানের অভাব তরুণদের মধ্যে গভীর হতাশা, আত্মবিশ্বাসের অভাব এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতার জন্ম দেয়। তারা প্রশ্ন তোলে: যদি কঠোর পরিশ্রম এবং উচ্চশিক্ষার পরেও একটি সম্মানজনক জীবন নিশ্চিত না হয়, তবে স্বাধীনতার অর্থ কী? অনেক তরুণ জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে বাধ্য হয়ে অসংগঠিত 'গিগ ইকোনমি'-র ঝুঁকিপূর্ণ এবং নিরাপত্তাহীন কাজে যোগ দিচ্ছে, যেখানে সামাজিক সুরক্ষা বা স্থায়ী আয়ের কোনো নিশ্চয়তা নেই।

রাষ্ট্রের দুর্বল স্থায়ী সামাজিক কাঠামো, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব এবং পুঁজিবাদের শোষণমূলক চরিত্র এই বেকারত্বকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার ব্যর্থতা প্রমাণ করে যে, শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন আজও অধরা। যুব বেকারত্ব মোকাবিলা না করতে পারলে, এই বিশাল জনসংখ্যা একসময় সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার চালিকাশক্তিতে পরিণত হতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তন আজ বাংলাদেশের জন্য কোনো ভবিষ্যৎ হুমকি নয়, বরং এক চরম অস্তিত্ব সংকট। উপকূলীয় অঞ্চল ডুবে যাওয়া, নদীর ভাঙন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, চাষযোগ্য জমি কমে যাওয়া, ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু-নির্ভর অভিবাসন মানুষের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলছে। স্বাধীনতার পর এই প্রথমবার পরিবেশ-নিরাপত্তা জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সমানতালে উঠে এসেছে। হাজার হাজার মানুষ প্রতি বছর ঘরবাড়ি হারিয়ে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে, যা পরিবেশগত উদ্বাস্তুদের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী তৈরি করেছে।

ফলে ২০২৫ সালের বিজয় দিবসে জলবায়ু ন্যায়বিচারই স্বাধীনতার নতুন ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতির সামনে প্রশ্ন: ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিরাপদ ও স্থিতিশীল পরিবেশ দেওয়া কি আজকের রাষ্ট্রের অপরিহার্য দায়িত্ব নয়? জলবায়ু অভিযোজন নীতি প্রণয়ন এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে জলবায়ু অর্থায়ন ও ন্যায়বিচারের জন্য বাংলাদেশের বলিষ্ঠ ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে আধুনিক বৈশ্বিক বাস্তবতায় পুনর্বিন্যস্ত করছে। পরিবেশগত মুক্তি এখন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির সমার্থক।

সামাজিক সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের ক্ষেত্রেও ২০২৫ সালের বিজয় দিবস নতুন চিন্তা উত্থাপন করছে। বাংলাদেশের সংস্কৃতি ঐতিহাসিকভাবে বহুমাত্রিক ও সহনশীল হলেও, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সামাজিক বিভাজন, ভুল তথ্যের বিস্তার, রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং প্রজন্মগত অবিশ্বাস সমাজে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি করেছে। ঐক্যের দিন হিসেবে বিজয় দিবস তাই হয়ে উঠছে পুনর্মিলনের আহ্বান।

মুক্তিযুদ্ধ ছিল বহুত্ববাদ ও মানবাধিকারের সংগ্রাম। এই চেতনায় সংখ্যালঘু, নারী, শ্রমজীবী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং ভিন্ন সক্ষমতার মানুষদের সমান মর্যাদায় জাতীয় গল্পে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক চর্চায় এই বহুত্ববাদ ও অন্তর্ভুক্তি প্রতিফলিত হওয়া উচিত। সমাজের সব মানুষের মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত না হলে, বিজয়ের আনন্দ কখনো পূর্ণতা পাবে না। তথ্য প্রযুক্তির যুগে ভুল ও মিথ্যা তথ্যের বন্যা যখন সামাজিক সম্প্রীতি নষ্ট করছে, তখন সত্য ও ঐক্যের পক্ষে দাঁড়ানোই আজকের বিজয় দিবসের নৈতিক দায়িত্ব।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থানও বিজয় দিবসকে নতুন মাত্রা দিচ্ছে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন, জলবায়ু কূটনীতিতে সক্রিয়তা, মানবিক সহমর্মিতা প্রদর্শন এবং দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতায় বাংলাদেশের ভূমিকা আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত। ১৯৭১ সালের নৈতিক শক্তি আজও বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের পরিচয়ের ভিত্তি।

তবে শক্তিশালী বৈদেশিক সম্পর্ক বজায় রাখতে হলে দেশের অভ্যন্তরীণ প্রতিষ্ঠানকে আরও শক্তিশালী, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হতে হবে। আন্তর্জাতিক পরিচিতি কখনোই অভ্যন্তরীণ বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। আন্তর্জাতিক সম্মান তখনই অর্থবহ হয় যখন দেশের প্রতিটি নাগরিক ন্যায়বিচার, নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা উপভোগ করে। অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা বৈদেশিক নীতিকেও দুর্বল করে দিতে পারে।শিক্ষাক্ষেত্রে ইতিহাস চর্চা এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমে মুক্তিযুদ্ধের নতুন গবেষণা, সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ ও বাস্তবভিত্তিক তথ্য অন্তর্ভুক্তি জরুরি। তরুণদের কাছে মুক্তিযুদ্ধকে কেবল স্মৃতিধর্মী উপাখ্যান হিসেবে উপস্থাপন না করে, একে নৈতিক ও নাগরিক শিক্ষা হিসেবে গুরুত্ব দেওয়া উচিত, যা তাদের প্রশ্ন করতে, বিশ্লেষণ করতে এবং দায়িত্বশীল নাগরিক হতে শেখাবে। বিজয় দিবসকে তাই শুধু উৎসব নয়, ভবিষ্যৎ সমাজ গঠনের একটি শিক্ষামূলক প্ল্যাটফর্ম হিসেবেও বিবেচনা করা উচিত।

নাগরিক আন্দোলন আজকের বাংলাদেশের আরেক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। সড়ক নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, নারীর অধিকার, ন্যায়বিচার, দুর্নীতি প্রতিরোধ, পরিবেশ রক্ষা—এসব ইস্যুতে যে সক্রিয়তা সৃষ্টি হয়েছে, তা মুক্তিযুদ্ধের অংশগ্রহণমূলক চেতনারই আধুনিক রূপ। তরুণ প্রজন্মের সাহসী উচ্চারণ প্রমাণ করে, স্বাধীনতার প্রকৃত শক্তি লুকিয়ে আছে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে। এই আন্দোলনগুলি গণতান্ত্রিক পরিসর পুনরুদ্ধারের এবং জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার একটি শক্তিশালী মাধ্যম।

বিজয় দিবস ২০২৫ তাই স্মরণ করিয়ে দেয় যে স্বাধীনতা কেবল অতীতের অর্জন নয়, এটি ভবিষ্যতের প্রতি এক গুরুতর দায়িত্ব ও নৈতিক প্রতিজ্ঞা। শহীদদের রক্তদানে অর্জিত স্বাধীনতা আমাদের নৈতিকভাবে বাধ্য করে ন্যায়সঙ্গত, স্বচ্ছ, মানবিক ও সমতাভিত্তিক সমাজ নির্মাণের দিকে। স্বাধীনতার চেতনা সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়, কিন্তু তার মর্মবস্তু—মানবমর্যাদা, ন্যায়, সাহস ও সহমর্মিতা—চিরকালীন।

সর্বোপরি, বিজয় দিবস ২০২৫ এমন এক সময়ে এসেছে যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার অর্থ নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত হচ্ছে। আজ স্বাধীনতার মানদণ্ড শুধু ভৌগোলিক সার্বভৌমত্ব নয়; এটি বিচার, জবাবদিহিতা, সমান সুযোগ, পরিবেশ-নিরাপত্তা, সামাজিক মর্যাদা, অর্থনৈতিক মুক্তি এবং নাগরিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার সামগ্রিক প্রতিশ্রুতি। ১৯৭১ সালের মুক্তির স্বপ্ন ছিল মানবিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন।

২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে সেই স্বপ্ন পূরণ করার জন্য প্রয়োজন নৈতিক সাহস, নতুন চিন্তা, শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান এবং সর্বোপরি জাতীয় ঐক্য। দারিদ্র্য, যুব বেকারত্ব এবং আয়বৈষম্যের মতো কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করে এবং পরিবেশগত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার মাধ্যমেই কেবল সেই মানবিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন পূরণ হতে পারে।

বিজয় দিবস তাই স্মরণ নয়, ভবিষ্যতের প্রতি প্রবহমান এক প্রতিজ্ঞা। স্বাধীনতার আলো যতক্ষণ জনগণের জীবনে ন্যায়, সমতা ও মর্যাদা এনে দিতে পারে, ততক্ষণই বিজয় দিবস তার প্রকৃত তাৎপর্য বহন করবে।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।

এইচআর/জেআইএম