দেশজুড়ে

অবহেলায় ধুঁকছে গাজীপুরের সরকারি সব পর্যটন কেন্দ্র

অযত্ন আর অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে গাজীপুরের পর্যটন কেন্দ্রগুলো। বিশেষ করে সরকারি পর্যটন কেন্দ্রগুলোর অবস্থা চরম বেহাল। তবে বেসরকারি পর্যায়ের পর্যটন কেন্দ্রগুলো রিসোর্টকেন্দ্রিক ও ব্যয়বহুল হলেও সারাবছরই জমজমাট থাকে সেগুলো।

গাজীপুর সাফারি পার্ক

ঢাকা ও আশপাশের এলাকা থেকে সারাদিন পরিবার নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর জন্য সাফারি পার্ক একটি আদর্শ জায়গা। এক সময়ের জনপ্রিয় এই পর্যটন কেন্দ্রে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ক্রমেই দর্শনার্থী সংখ্যা কমছে। অব্যবস্থাপনা, প্রাণীদের প্রতি অবহেলা আর সঠিক তদারকির অভাবকে এর জন্য দায়ী করছে সাধারণ মানুষ। দালালদের দৌরাত্ম্যে বর্তমানে পার্কটিতে প্রায়ই হয়রানির শিকার হন দর্শনার্থীরা।

জানা গেছে, গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের ৪ হাজার ৯০৯ একর ভূমির মধ্যে ৩ হাজার ৮১৯ একর জায়গা জুড়ে গড়ে ওঠা সাফারি পার্ক ছোট ছোট টিলা ও শালবন সমৃদ্ধ। থাইল্যান্ডের সাফারি ওয়ার্ল্ডের অনুকরণে তৈরি সাফারি পার্কটি ২০১৩ সালে চালু করা হয়। এই সাফারি পার্কের অন্যতম আকর্ষণ কোর সাফারি। পুরো পার্কটি স্কয়ার, কোর সাফারি পার্ক, বায়োডাইভার্সিটি পার্ক, সাফারি কিংডম, এক্সটেনসিভ এশিয়ান সাফারি পার্ক নামক ৫টি অংশে বিভক্ত।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় পার্কটিতে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। এর মূল ফটক, মুর‌্যাল, প্রাণী জাদুঘর, পাখিশালা, পার্ক অফিসসহ বিভিন্ন খাদ্যের দোকানে ভাঙচুর চালানো হয়। লুটপাট করা হয় নানা সরঞ্জাম। ঘটনার ৩ মাস ৯ দিন পর দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয় গাজীপুর সাফারি পার্ক।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পার্কে অব্যবস্থাপনা ও অবহেলার কারণে একের পর এক প্রাণীর মৃত্যু, ভেতরে নোংরা, ঘাস বড়সহ গজারি গাছে লতা পেঁচিয়ে অন্ধকার হওয়ার ঘটনা ঘটছে। চলতি বছরের গত ১৬ জানুয়ারি পার্কের দেওয়াল টপকে পালিয়ে যায় একটি নীলগাই। এর আগে ২০২১ সালেও একটি নীলগাই পালিয়ে গিয়েছিল। ২০২১ সালের ২৭ ডিসেম্বর পার্কে একটি সিংহ ও একটি ওয়াইল্ডবিস্ট মারা যায়। ২০২২ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে ১১টি জেব্রা, একটি বাঘ ও একটি সিংহের মৃত্যু হয়। ২০২৩ সালের ২০ অক্টোবর মারা যায় একটি জিরাফ। ২০২১ সালে পার্কে তিনটি ক্যাঙারু মারা যাওয়ার পর থেকে ক্যাঙারু শূন্য হয়ে যায় কোর সাফারি। এছাড়া লেকগুলো একসময় ব্ল্যাক ও হোয়াইট সোয়ানে পরিপূর্ণ থাকলেও বর্তমানে একটিও নেই।

পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঢাকা থেকে ঘুরতে আসা আব্দুল মালেক মিয়া বলেন, পার্কের মধ্যে অনেক কিছু পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে, হরিণের বেষ্টনীতে খাবার নেই, ঘোড়াটা শুকিয়ে গেছে। বোঝাই যাচ্ছে দায়িত্বে থাকারা পশু-প্রাণীগুলোর স্বাস্থ্যের বিষয়ে অবহেলা করছে। এছাড়া দর্শনার্থীদের বসার কোনো জায়গা নেই বা ওয়াক ওয়েগুলো ভালো না। এটাকে পরিচর্যা ও প্লানিং করা যায়, আরও সুন্দর করে বনায়ন করা যায়। তাহলে হয়ত দর্শনার্থী বাড়বে।

আরেক দর্শনার্থী সাইফুল ইসলাম বলেন, সুন্দর একটা পরিবেশ উপভোগ করার জন্য এখানে এলাম। কিন্তু এখানে প্রত্যেকটা প্রাণী দেখে মনে হচ্ছে অগোছালো অবস্থা রয়েছে। যেভাবে থাকা দরকার সেভাবে নেই। ভেতরে একটি মাত্র বাঘ দেখলাম, তাও রোগা হয়ে রয়েছে। অনেক পাখি দেখলাম নেই। খাঁচা আছে পাখি নেই।

সাফারি পার্কের দায়িত্বে থাকা বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) তারেক রহমান জাগো নিউজকে বলেন, পার্কের কিছু সংস্কার করা হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পার্ক নিয়মিত খোলা রয়েছে। চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত সরকারি ব্যবস্থাপনায় পার্কের কার্যক্রম চলমান থাকবে। পার্কের অনুকূল পরিবেশে বিভিন্ন পশুপাখি প্রজনন করছে। পার্কের স্বকীয়তা ধরে রাখতে আমরা প্রাণান্ত চেষ্টা করছি। পার্কের সমস্যাগুলোর বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অবগত আছে।

ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান

গাজীপুরের এক সময়ের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে সবাই ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানকেই জানতো। সময়ের পরিক্রমায় এ উদ্যানটি এখন প্রায় পর্যটকশূন্য। নানা অব্যবস্থাপনা আর অযত্নে পার্কটির জৌলুস হারিয়েছে। গত ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে পার্কটিতে কোনো পিকনিক পার্টিকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। সাধারণত ২০ টাকার টিকিট কেটে ভেতরে প্রবেশ করে দর্শনার্থী ও পর্যটক। সেখানে দেখার মতো বা উপভোগ করার মতো কোনো বিনোদন কেন্দ্র নেই। যেসব কটেজ রয়েছে তাও অযত্ন আর অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দর্শনার্থীদের জন্য বিশ্রামাগার থাকলেও সেগুলো ব্যবহার অনুপযোগী। শিশু পার্ক থাকলেও তা ব্যবহার উপযোগী নয়। যারা টিকিট কেটে প্রবেশ করেন তারাই হতাশ হয়ে ফিরে আসেন।

ভাওয়াল রাজবাড়ি

গাজীপুরে ভাওয়াল রাজাদের প্রাসাদ ভাওয়াল রাজবাড়ি এখন জেলা প্রশাসকের কার্যালয় হলেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ প্রতিদিন দেখতে আসেন ঐতিহাসিক ভাওয়াল রাজবাড়ি। এর সৌন্দর্য দেখে অনেকে অভিভূত হলেও এখানে পর্যটকদের জন্য নেই কোনো সুযোগ-সুবিধা। শুক্রবার ও শনিবার সরকারি ছুটির দিন এটি বন্ধ থাকে। তারপরও পর্যটকরা এসে ঘুরে দেখেন।

ঈশাখার মাজার

গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার বক্তারপুরে রয়েছে ইতিহাসের বিশাল জায়গা জুড়ে থাকা ঈশা খার নাম। তার কবরস্থান রয়েছে বক্তারপুরে। সেখানেও প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ ঈশাখার মাজার দেখতে আসেন। এখানেও নেই পর্যটকদের জন্য কোনো সুযোগ সুবিধা।

বেলাই বিল

ঐতিহ্যবাহী বেলাই বিলের মাছ এ অঞ্চলের মানুষের আমিষের জোগান দেয়। বর্ষায় এর কিছু রূপ দেখা গেলেও শুষ্ক মৌসুমে দূষিত পানি আর কলকারখানার বর্জ্যে এর পানি ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়ে। বর্ষায় বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ ঘুরতে আসেন বেলাই বিলে।

অপরদিকে বেসরকারি পর্যটন কেন্দ্রগুলো বেশিরভাগই রিসোর্ট কেন্দ্রিক। সেখানে ডে লং প্রোগ্রাম থেকে রাত্রি যাপনের সুযোগও রয়েছে। বেসরকারি ও ব্যক্তিগত রিসোর্টগুলোর মধ্যে সরাহ রিসোর্ট, ভাওয়াল রিসোর্ট, ছুটি রিসোর্ট, নক্ষত্রবাড়ি, গ্রিন টেক, গ্রিন ভিউ, রাজেন্দ্র ইকো রিসোর্টগুলোতে সাড়া বছরই পর্যটক আসে। এসব রিসোর্ট ব্যয়বহুল হলেও শিশু-কিশোরসহ সবার বিনোদনের সব রকম ব্যবস্থা সেখানে রয়েছে।

এ ব্যাপারে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আলম হোসেন বলেন, গাজীপুরের পর্যটন কেন্দ্র ও বিনোদন কেন্দ্র সমূহ ব্যবহারে এর খরচ সবার সাধ্যের মধ্যে রাখা হবে। এগুলো যেন ভালোভাবে চলে তার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

এফএ/এএসএম