মতামত

সুষ্ঠু নির্বাচনের চার মূলমন্ত্র: প্রজ্ঞা, সংলাপ, প্রস্তুতি ও সততা

জেদ মানুষের একটি প্রাকৃতিক মানসিক গুণ অথবা বদ অভ্যাস, যা কখনো কাজে আসে, আবার কখনো বিপদ ডেকে আনে। জেদ ধরার শক্তি থাকলে মানুষ নিজের লক্ষ্য অর্জন করতে পারে কিন্তু যখন জেদ অযৌক্তিকভাবে বেড়ে যায়, তখন তা শুধু ব্যক্তির ক্ষতি করে না, সমাজের সুরক্ষিত প্রক্রিয়াকেও বিপন্ন করে। বাংলার প্রবাদ ‘জেদের ভাত কুকুরকে দিয়ে খাওয়ানো’ এই বাস্তবতাকেই সহজভাবে তুলে ধরে। ভাত রান্না করতে যে শ্রম ও যত্ন লাগে তা কুকুরের জন্য দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ, অনেক কুকুর ভাতে মোটেও সন্তুষ্ট নয়। তারা ভাতের চেয়ে কয়েকটি হাড় পেলে বেশি খুশি হয়। তাই প্রবাদটি যেমন জেদ ধরে নেওয়া সিদ্ধান্তের ফল তেমনি প্রাপ্য ব্যক্তি বা সমাজকে না পৌঁছিয়ে শয়তানি প্ররোচনায় অন্যদিকে নষ্ট করার নামান্তর।

আমাদের সমাজে রাজনৈতিক অঙ্গনে এই প্রবাদটি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। আমরা প্রায়ই দেখি কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতা জেদ ধরে কোনো সিদ্ধান্ত নেন, আমরা যা বলেছি, সেটাই সঠিক। জনগণের প্রয়োজন, জনমতের যথার্থতা, সময়োপযোগী প্রক্রিয়া সবই বাদ পড়ে যায়। এমন জেদের ফলাফল হয় বিচ্ছিন্নতা, অস্থিরতা এবং বিভাজন। ভোট, জনমত বা নীতি যা সমাজের জন্য মূল্যবান, তা হয়ে পড়ে অপ্রয়োজনীয় বা অপচয়। এমনকি বহু প্রতীক্ষিত জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হলেও শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার মোহে আমাদের পারস্পরিক জেদ কমেনি এবং রাজনৈতিক মতভেদও দূরীভূত হয়নি।

সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক উদাহরণ দেখা গেছে। কোনো এলাকায় সঠিক সময় বা প্রক্রিয়া বিবেচনা না করে ভোট আয়োজন করা হয়। রাজনৈতিক দলের জেদ, ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা বা নির্বাচনি কৌশলই সেই সময়কে প্রাধান্য পায়। ফলাফলে জনগণের আস্থা ক্ষুণ্ন হয়, ভোটার বিভ্রান্ত হয়, এবং রাজনৈতিক সংহতি নষ্ট হয়। একইভাবে, কোনো পরিবারে কোনো সদস্য জেদ ধরে অন্যের পরামর্শ উপেক্ষা করলে সম্পর্ক জটিল হয়। এক্ষেত্রে জেদের ভাত সত্যিই কুকুরকে খাওয়ানোর মতো শ্রম ও সম্পদ নিঃশেষ হয়, কিন্তু ফলাফল সঠিক প্রাপ্য ব্যক্তি বা উদ্দেশ্যে পৌঁছায় না।

শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নয়, সামাজিক ও কর্মক্ষেত্রেও জেদের প্রভাব স্পষ্ট। কোনো অফিসে বস্তুগত যুক্তি উপেক্ষা করে কর্মকর্তা জেদ ধরে সিদ্ধান্ত নিলে প্রকল্প ব্যর্থ হয়। স্কুলে শিক্ষক বা শিক্ষার্থী জেদ ধরলে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হয়। এমনকি পারিবারিক বা বন্ধু-বান্ধব সম্পর্কেও জেদের প্রভাব ধীরে ধীরে অনুভূত হয়। কারণ জেদ শুধু নিজস্ব মনোভাবকে প্রাধান্য দেয়, অন্যের অনুভূতি ও প্রয়োজনকে অন্যায়ভাবে উপেক্ষা করে।

সেদিন টেলিফোনে একটি জটিল নালিশ এসেছিল। সেটা একটি পারিবারিক বিশৃঙ্খলা জাতীয় মনো-সামাজিক সমস্যা। এর একটা ন্যায্য বিচার বা সালিশ করার জন্য বার বার ফোন আসতে থাকলো বিভিন্ন কর্নার থেকে। কিন্তু আমি তো কোন বিচারক নই। তবুও সবার দাবি আমিই নাকি পারবো এর সঠিক সমাধান করে দিতে।

অনেকের অনুরোধ শুনে বিপদে পড়ে গেলাম। কীভাবে কি করব, কীভাবে এর একটা সুষ্ঠু সমাধান হবে তা নিয়ে গভীর চিন্তা করতে থাকলাম। সেদিন পার হলো, পরের সাররাত ভাবনার অন্ত নেই। অতঃপর সেই সমস্যার প্রকৃত কারণ খুঁজতে তৎপর হলাম।

ঐ সমস্যার প্রৃকতি খুবই সাধারণ। তবে সেটা আমাদের সমাজের আর দশটা প্রচলিত পারিবারিক বিশৃঙ্খলার মতো নয়। যে কোনো সমস্যা হলে তার তার সমাধান অবশ্যই আছে। তবে সমস্যাক্রান্তকে সেই সমস্যা থেকে মুক্তি পাবার জন্য প্রবল ইচ্ছা পোষণ করে নানামুখী তৎপরতা চালাতে হয়। সমস্যাক্রান্ত ঘুমন্ত ব্যক্তির সমস্যা কখনই সমাধান করা যায় না।

সমস্যাক্রান্তকে তার সমস্যা থেকে নিষ্কৃতি পাবার ব্যাকুলতা থাকতে হবে। সেই সমস্যার টুটি চেপে ধরার জন্য পারিপার্শ্বিক সহায়তা নেবার চেষ্টা করতে হবে। আমারে কাছে চাওয়া সহায়তা দেবার জন্য আমি প্রস্তুত হয়ে যখন সেই পরিবারের কাছে যোগাযোগ করলাম তখন একটি বিষয় পর্যবেক্ষণ করা গেল। আর সেটা হলো উভয়ের চরম ইগো। সেই ইগো থেকে উৎপত্তি নিয়েছে ভীষণ জেদ!

এই প্রবাদকে কেবল একটি রসিকতা হিসেবে না ভেবে সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হিসেবে ‘জেদের ভাত কুকুরকে দিয়ে খাওয়ানো’ বন্ধ করতে হবে। আমাদের নিজেদের প্রজ্ঞা, যৌথসংলাপ ও যথার্থ প্রস্তুতি ও সততা হোক সামনের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সকল দলীয় এবং স্বতন্ত্র ভোটপ্রার্থীদের প্রকৃত রেসিপি।

তারা উভয়ে মারাত্মক জেদের বশবর্তী হয়ে পরস্পরকে দূরে ঠেলে দেবার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। দীর্ঘদিন পেরিয়ে কখন বছর পেরিয়ে গেছে এবং পর পর অনেকগুলো বছর পেরিয়ে তারা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভিন্ন দিকে প্রচণ্ড আর্থ-সামাজিক ও মানসিক ক্ষতির ঘূর্ণিপাকে ডুবে গেছে সেটা তারা নিজেদের উপলব্ধিতে আনতে পারছে না। আর এই নড়বড়ে অবস্থার সুযোগে তৃতীয় পক্ষ এসে তাদেরকে ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করতে শুরু করেছে!

এখন তাদের উপর কাউন্সেলিং চালানো বেশ জটিল। যেমন অবস্থা হয়েছে আমাদের বর্তমান দ্বিবিধ ভোটের আয়োজন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনের ভিতরে অচেনা গতি-প্রকৃতি নিয়ে।

জেদের বাড়াবাড়ি আমাদের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ পেরিয়ে বৃহত্তর রাজনৈতিক অঙ্গনকে ভ্রান্তপথে ঠেলে দিচ্ছে। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত জাতীয় নির্বাচনের তপশীল ঘোষিত হলেও শুধু ক্ষমতায় যাবার লোভ বা মোহে আমাদের পারস্পরিক জেদ কমেনি, মতভেদও দূরীভূত হয়নি। এই সুযোগে আমাদের নিজেদের সৃষ্ট নাজুক পরিস্থিতি অবলোকন করে দেশের মৌলিক কাঠামোকে নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু হয়ে গেছে বৈশ্বিক মহলে। তবে আমাদের জেদের ভাত পথের কুকুর অথবা বন্য কুকুর কে দিতে চেষ্টা করলে সেটা বড় বুমেরাং হতে পারে।

সেজন্য জেদের এই অযৌক্তিক প্রবণতা মোকাবিলার একমাত্র উপায় হচ্ছে আমাদের নিজস্ব যুক্তি, প্রজ্ঞা ও সংলাপের ওপর নির্ভরতা। কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে প্রক্রিয়া ঠিক আছে কিনা, সময়োপযোগী কিনা, প্রাপ্তব্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান প্রস্তুত কিনা এসব যাচাই করা জরুরি। সংসার হোক বা রাষ্ট্র হোক, কোনো কাজের ফল কেবল জেদের ওপর নির্ভর করে আসে না। একটি শান্ত প্রক্রিয়া, মানবিক বিবেচনা, সময় ও অভিজ্ঞতা সব মিলিয়ে সঠিক ফল দেয়।

আমাদের দেশে হেমন্তের আমন ধান মাড়াই ও শীতের পিঠার সঙ্গে এ অবস্থার অদ্ভুত মিল আছে। পিঠা বানাতে সময়, ময়ান, তাপমাত্রা, ও ধৈর্য দরকার। যদি কেউ মণ্ড না বানিয়ে তাড়াহুড়ো করে চুলায় ভাতে হাত দিয়ে বসে, পিঠা ভেঙে যাবে। ঠিক একইভাবে, রাজনৈতিক বা সামাজিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও যদি প্রক্রিয়া, প্রস্তুতি ও সংলাপ উপেক্ষা করে কেবল জেদ দ্বারা এগোনো হয়, ফলাফলও ব্যর্থ হয়।

আরও গভীর বিশ্লেষণে দেখা যায়, জেদের ভাত কুকুরকে দেওয়া মানে শুধু অপচয়। এটি সম্পদ ও আস্থার অপব্যবহার করার শামিল। আমাদের পরিকল্পনায় রাষ্ট্রীয় সম্পদ, সময়, সামাজিক সম্মিলিত পরিশ্রম সবই ব্যবহার করা হয় কিন্তু সঠিক উদ্দেশ্য বা প্রয়োজন পূরণ হয় না। যেমন, কোনো নির্বাচনি প্রচারণায় প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হয়, কিন্তু যদি জনমত গঠন না হয় বা ভোটের পরিবেশ অনিশ্চিত থাকে তবে সেই ব্যয় আর ফলাফল উভয়ই অপচয়।

অতএব, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে জেদের ভূমিকা সীমিত রাখা প্রয়োজন। জেদ কখনো উৎসাহ বা উদ্যম দিতে পারে, কিন্তু পরিপক্বতা, সংলাপ ও যুক্তি ছাড়া জেদ একমাত্র ক্ষতির কারণ হয়।

সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসই এ কথা প্রমাণ করে। দেশের কিছু অঞ্চলে তাড়াহুড়ো করে গণভোট বা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যেখানে জেদ ছিল প্রধান চালিকা শক্তি। এর দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল কি? বিভাজন, সামাজিক অস্থিরতা, এবং ভোটারের আস্থা ক্ষুণ্ণ। এই দৃশ্যটি আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় অযৌক্তিক জেদ শুধুই নিজের পছন্দকে এগিয়ে দেয়, কিন্তু সমাজ বা রাষ্ট্রের সঠিক লক্ষ্যকে প্রাপ্য ফল দেয় না।

একইভাবে, ব্যক্তিগত জীবনে জেদের ভাত কুকুরকে দেওয়ার প্রবাদও আমাদের শিক্ষা দেয় যতটা শ্রম, সময় ও সম্পদ দিয়ে কোনো কাজ করা হলো, যদি সেটি সঠিক ব্যক্তির কাছে না পৌঁছায়, তা ব্যর্থ হয়। তাই প্রয়োজন যুক্তি, পরিকল্পনা, মানবিক বিবেচনা এবং সময়োপযোগী প্রক্রিয়া।

শুধু শিক্ষা বা রাজনীতি নয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এই দর্শন গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের পরিবারে, অফিসে, স্কুলে বা বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনেও অযৌক্তিক জেদ কেবল অপচয় করে। বরং সংলাপ, সমঝোতা এবং প্রজ্ঞার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিলে ফলাফল প্রাপ্য ব্যক্তি বা সমাজের কাছে পৌঁছায়।

এছাড়া আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় এই শিক্ষাটি গুরুত্বপূর্ণ। যে-কোনো উদ্যোগে বা সিদ্ধান্তে জেদকে প্রাধান্য দিলে ফলাফল নিখুঁত হবে না। গণভোট হোক, নীতি প্রণয়ন হোক, পরিবার বা অফিসের সিদ্ধান্ত হোক প্রক্রিয়া, প্রস্তুতি ও যুক্তি সবসময় জেদের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

যেমন শীতের পিঠা বানিয়ে আহারের মুহূর্ত পর্যন্ত যেমন অভিজ্ঞ রাঁধুনি ও দক্ষ পরিবেশনকারী প্রয়োজন, তেমনি গণতন্ত্রকে সফল করতে প্রয়োজন পরিপক্বতা, সংলাপ ও আস্থা। এআই-সঞ্জাত পিঠা নিখুঁত হতে পারে, কিন্তু মানুষের অভিজ্ঞতা ছাড়া তা পূর্ণতা পেতে পারে না। ঠিক তেমনি গণভোটের ফলাফলও কেবল সংখ্যায় বা জেদের উপর নির্ভর করলে সমাজের জন্য অপ্রয়োজনীয় অপচয় হয়ে যেতে পারে।

সুতরাং এই প্রবাদকে কেবল একটি রসিকতা হিসেবে না ভেবে সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হিসেবে ‘জেদের ভাত কুকুরকে দিয়ে খাওয়ানো’ বন্ধ করতে হবে। আমাদের নিজেদের প্রজ্ঞা, যৌথসংলাপ ও যথার্থ প্রস্তুতি ও সততা হোক সামনের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আমাদের সকল দলীয় এবং স্বতন্ত্র ভোটপ্রার্থীদের প্রকৃত রেসিপি।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। fakrul@ru.ac.bd

এইচআর/এমএস