পানির পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমে আসায় পুরোপুরি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে পড়েছে ইরাকের ঐতিহাসিক টাইগ্রিস বা দজলা নদী। একসময় যে নদী মেসোপটেমিয়ার সভ্যতাকে প্রাণ দিয়েছিল, সেই টাইগ্রিস এখন দূষণ ও পানিশূন্যতার দ্বিমুখী সংকটে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, জরুরি ব্যবস্থা না নিলে টাইগ্রিসের প্রবাহ একসময় পুরোপুরি থেমে যেতে পারে।
দক্ষিণ ইরাকের আমারা শহরের বাসিন্দা মানদিয়ান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নেতা শেখ নিধাম ক্রেইদি আল-সাবাহি বলেন, পানি নেই তো জীবনও নেই।। তার ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, প্রবাহমান নদীর পানি ছাড়া অন্য কোনো উৎসের পানি পান করা নিষিদ্ধ। তিনি বিশ্বাস করেন, পানি যতদিন প্রবাহমান থাকে, ততদিন তা পবিত্র। কিন্তু বাস্তবতা হলো, টাইগ্রিস হয়তো আর বেশিদিন প্রবাহমান থাকবে না।
টাইগ্রিস (দজলা) ও ইউফ্রেটিস (ফোরাত)- এই দুই নদীই প্রাচীন ‘ফার্টাইল ক্রিসেন্ট’-এর ভিত্তি, যা বর্তমানে ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ইসরায়েল, ফিলিস্তিন, জর্ডান, মিশর ও তুরস্কের অংশবিশেষ। টাইগ্রিসের উৎপত্তি তুরস্কে, সেখান থেকে এটি ইরাকের প্রধান দুই শহর মসুল ও বাগদাদ অতিক্রম করে ইউফ্রেটিসের সঙ্গে মিলিত হয়ে শাত্ত আল-আরব নামে উপসাগরে গিয়ে পড়ে। এই নদীর অববাহিকায় বসবাস করে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ, যাদের সুপেয় পানি, সেচ, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্পকারখানা এই নদীর ওপর নির্ভরশীল।
কিন্তু গত তিন দশকে টাইগ্রিসের পানিপ্রবাহ ভয়াবহভাবে কমেছে। তুরস্ক টাইগ্রিস নদীর উজানে বড় বড় বাঁধ নির্মাণ করায় বাগদাদে পৌঁছানো পানির পরিমাণ প্রায় ৩৩ শতাংশ কমে গেছে। একই সঙ্গে ইরানও যৌথ নদীগুলোর পানি বাঁকিয়ে নেওয়ায় টাইগ্রিসে পানির প্রবাহ আরও হ্রাস পেয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ইরাকের ভেতরে পানির অতিরিক্ত ও অব্যবস্থাপনা।
ইরাকের কৃষিখাত একাই অন্তত ৮৫ শতাংশ ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহার করে। জলবায়ু সংকট পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। গত কয়েক দশকে ইরাকে বৃষ্টিপাত কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। দেশটি বর্তমানে প্রায় এক শতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ খরার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে পানির চাহিদা সরবরাহকে ছাড়িয়ে যাবে।
জানা গেছে, চলতি বছরের গ্রীষ্মে টাইগ্রিসের পানি এতটাই কমে যায় যে অনেক জায়গায় মানুষ হেঁটে নদী পার হতে পেরেছে। নদীর পানির পরিমাণ কমে যাওয়ায় দূষণের মাত্রাও বেড়ে গেছে। নদীর পানিতে শহরের অপরিশোধিত পয়ঃবর্জ্য, কৃষিজ কীটনাশক ও সার, তেলশিল্পের বর্জ্য ও চিকিৎসা বর্জ্য মিশছে।
২০২২ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, বাগদাদের বিভিন্ন স্থানে টাইগ্রিসের পানির মান ‘খুবই খারাপ’। ২০১৮ সালে দূষিত পানি পান করে দক্ষিণের বাসরা শহরে অন্তত ১ লাখ ১৮ হাজার মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হয়।
পরিবেশবাদী সংগঠন ‘হুমাত দিজলা’র প্রতিষ্ঠাতা সালমান খাইরাল্লা বলেন, নদীর পানির গুণগত মান সম্পূর্ণভাবে এর পরিমাণের ওপর নির্ভর করে। পানি যত কমবে, দূষণ তত বাড়বে।
এই সংকট মোকাবিলায় ইরাক সরকার তুরস্কের সঙ্গে একাধিকবার আলোচনা করেছে। গত নভেম্বরে বাগদাদ ও আঙ্কারা একটি সমঝোতা কাঠামোতে সই করে, যার আওতায় নদীদূষণ রোধ, আধুনিক সেচব্যবস্থা চালু ও পানি ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। তেল দিয়ে পানি অবকাঠামোর বিনিময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে এটি ‘অয়েল-ফর-ওয়াটার’ চুক্তি হিসেবেও পরিচিত। তবে বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, চুক্তিটি অস্পষ্ট, আইনি বাধ্যবাধকতাহীন এবং ইরাকের পানিসম্পদের ওপর তুরস্কের প্রভাব বাড়াতে পারে।
পানির অভাবে মানিদিয়ান সম্প্রদায়ের ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এক হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে দক্ষিণ ইরাকে বসবাস করা এই সম্প্রদায়ের বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা বর্তমানে ৬০ হাজার থেকে ১ লাখের মধ্যে, যার মধ্যে ইরাকে অবশিষ্ট আছে ১০ হাজারেরও কম। অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে গেছেন বা কুর্দিস্তান অঞ্চলে সরে গেছেন।
টাইগ্রিস যদি সত্যিই শুকিয়ে যায়, তাহলে তা শুধু একটি নদীর মৃত্যু নয়, ইরাকের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও কোটি মানুষের জীবনযাত্রার ওপর নেমে আসবে ভয়াবহ বিপর্যয়।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান
এসএএইচ