দেশজুড়ে

আড়াই বছরের প্রকল্প ৪ বছরেও অর্ধেক, অনিশ্চয়তায় বাদাঘাট সড়ক

সিলেটবাসীর দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষিত কুমারগাঁও-বাদাঘাট-এয়ারপোর্ট চারলেন সড়ক নির্মাণ প্রকল্পটি কচ্ছপ গতির কবলে পড়েছে। ২০২২ সালে শুরু হওয়া আড়াই বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের কাজ চার বছর পেরিয়ে গেলেও অগ্রগতি মাত্র ৫০-৬০ শতাংশ। জমি অধিগ্রহণ জটিলতা ও মামলার পাহাড় ডিঙাতে না পেরে প্রকল্পের মেয়াদ এখন ২০২৬ সালের জুন ছাড়িয়ে আরও দুই বছর বাড়ানোর তোড়জোড় চলছে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রায় ১২ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ৬ কিলোমিটার জমি অধিগ্রহণের কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনো জমি অধিগ্রহণ হয়নি। এ অবস্থায় প্রকল্পের মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানোর জন্য মন্ত্রণালয় চিঠি পাঠানো হয়েছে। সড়কের যেসব জমি অধিগ্রহণে জটিলতা রয়েছে, সেসব জমি অধিগ্রহণ না করেই বিকল্প জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। জমি অধিগ্রহণ শেষ হয়ে গেলে কাজ শেষ করতে ছয়মাস সময় লাগবে। এজন্য প্রকল্পের মেয়াদ দ্বিতীয় দফায় আরও দুই বছর বৃদ্ধির জন্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিলেট নগরীর ভেতর দিয়ে প্রতিদিন শত শত পাথর বোঝাই ভারি ট্রাক চলাচল করে। এতে প্রায় সময় ট্রাক চাপায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এ অবস্থায় দুর্ঘটনা ও মৃত্যু ঝুঁকি এড়াতে নগরীর ভেতর দিয়ে ট্রাক চলাচলের চাপ কমাতে কুমারগাঁও-বাদাঘাট-এয়ারপোর্ট সড়ক নির্মাণের দাবি ওঠে। অবশেষে সিলেটবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে ২০১২-২০১৪ দুই অর্থবছরে প্রায় সাড়ে ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ কুমারগাঁও-বাদাঘাট-এয়ারপোর্ট সড়কটি নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে সড়কটি চারলেনে উন্নীত করার দাবি তোলেন সিলেটবাসী।

এ পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালে একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়। পরের বছর চার লেন সড়কের সঙ্গে দুটি সার্ভিস লেন যুক্ত করে তৈরি করা হয় সংশোধিত প্রস্তাবনা। ২০১৯ সালের দিকে শুধু চারলেনের প্রস্তাবনা জমা পড়ে মন্ত্রণালয়ে। অবশেষে জটিলতা কাটিয়ে ২০২২ সালে কুমারগাঁও-বাদাঘাট-এয়ারপোর্ট চারলেন সড়কের উদ্বোধন করেন কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন।

আরও পড়ুনবিলের মাঝে ২০ লাখ টাকার ‘ভুতুড়ে’ সেতু, ১০ বছরেও জোটেনি সংযোগ সড়কপ্রভাবশালীদের দখলে মৌলভীবাজারের হাজার কোটি টাকার রেলের জমি৫ বছরেও শেষ হয়নি চারশো মিটার সেতু নির্মাণ

সিলেট সড়ক ও জনপথ বিভাগের তথ্যমতে, প্রায় ৭২৮ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের আওতায় মাটির কাজসহ ১১.৮৭১ কিলোমিটার (চারলেন) সড়ক হবে রিজিড পেভমেন্টের। আর ০.৭০০ কিলোমিটার হবে ফ্লেক্সিবল পেভমেন্টের। এছাড়া দুটি পিসি গার্ডার সেতু, ২৪টি ছোট আরসিসি কালভার্ট, দুটি লিংক রোড, ছয়টি বাস-বে, আরসিসি ড্রেনসহ ফুটপাত, সিগন্যাল স্থাপন ও সড়ক রক্ষা ব্যবস্থা ছিল প্রকল্পটিতে।

সওজ’র তথ্য অনুযায়ী, প্রকল্পের আওতায় ভূমি অধিগ্রহণ হবে ৩১.৮২ একর। এতে ব্যয় ধরা হয় ২৪২ কোটি ১২ লাখ টাকা। ১ দশমিক ২ মিটার ডিভাইডার এবং দুই পাশে ৭ দশমিক ৯ মিটার করে ১৫ দশমিক ৮ মিটার প্রশস্ত চারলেন বিশিষ্ট এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৭২৭ কোটি ৬৩ লাখ ২০ হাজার টাকা। অর্থাৎ সড়কটিতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ৫৭ কোটি টাকা।

সওজ জানায়, জমি অধিগ্রহণের চারটি ও পেট্রোল পাম্পের একটি মামলা এবং উচ্চ আদালতে একটি রিট থাকায় চারলেনের এই সড়কে কাজের অগ্রগতি শুরু থেকেই চলছিল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত চারটি মামলার মধ্যে দুইটির অগ্রগতি বেশ ভালো হয়েছে, মীমাংসার পথে। আর দুটি শেষ হতে আরও কয়েকটি ধাপ পেরোতে হবে। ভূমি মালিকগণের সহযোগিতা না পেলে এগুলো শেষ হতে আরও সময় লাগতে পারে।

এদিকে স্থানীয়দের দাবি, বাদাঘাট-এয়ারপোর্ট সড়কে প্রায় ৭ কিলোমিটার রাস্তা ১৮ ফুট প্রশস্ত হিসেবে রেকর্ড ছিলো। কিন্তু ২০২৩ সালে বিএস জরিপে সেই সড়ক ৬৪ ফুট হিসেবে রেকর্ড দেখানো হয়েছে। এই ৭ কিলোমিটারের মধ্যে ধুপনিখলা মৌজার দেড় কিলোমিটার রাস্তা এলাকাবাসী ১৮ ফুট হিসেবে রাখার দাবি জানিয়েছেন। তাদের দাবি, বাকি ৪৬ ফুটের মালিকানা জনগণের। অবশ্য ৭ কিলোমিটারের মধ্যে বাকি সাড়ে ৫ কিলোমিটার সড়ক নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, কুমারগাঁও থেকে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার সম্মুখ পর্যন্ত রাস্তার নির্মাণ কাজ প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া সড়কের পাশ দিয়ে ড্রেনেজ নির্মাণও সম্পন্ন হয়েছে এ অংশে। তবে নির্মাণাধীন জায়গায় নয়াবাজার-বাদাঘাট রোড মসজিদ ও সোনাতলা বাজারে একটি পারিবারিক কবরস্থান রয়েছে। এসব জায়গায় স্থানীয়দের বাঁধায় কাজ বন্ধ রয়েছে।

এছাড়া বাদাঘাট-এয়ারপোর্ট সড়কস্থ ধুপনিখলা মৌজায় প্রায় ১.৫ কিলোমিটার রাস্তায় কোনো ধরনের কাজ দৃশ্যমান হয়নি। চামাউড়া-সালুটিকর মৌজায় রাস্তার উপর মাটি ফেলা হয়েছে। তবে সড়ক নির্মাণে কোনো কাজ দৃশ্যমান হয়নি। অবশ্য সড়কজুড়ে কালভার্ট ও সংযোগ সেতু নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান স্পেক্টা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের প্রজেক্ট ম্যানেজার শাখাওয়াত হোসেন বলেন, প্রকল্পের আওতায় মোট ১২ কিলোমিটার রাস্তা ছিল। এরমধ্যে ৪ কিলোমিটার রাস্তা ছিলো যেখানে কোনো জমি অধিগ্রহণ করা লাগেনি। সে অংশে প্রায় সকল কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি ৮ কিলোমিটার রাস্তার কাজ আমরা জমি অধিগ্রহণ ছাড়াই কাজ শুরু করি। ফলে বেশিরভাগ অংশে এখনো কাজ চলমান রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, দুইটি মৌজার মধ্যে একটি মৌজার প্রায় সাড়ে ৫ কিলোমিটার সড়কের জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত ঝামেলা মীমাংসা শেষ হওয়ার পথে। আমরা সেখানে কাজ করে যাচ্ছি। আর আরেকটি মৌজায় আড়াই কিলোমিটার রাস্তা রয়েছে, সেখানে আমরা কাজ করতে পারছি না। তবে জমি সংক্রান্ত ঝামেলা শেষ হলেই আমরা সে অংশে কাজ শুরু করবো।

তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত ৫০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আর কুমারগাও-বাঘাটাদের একটি স্থানে কবরস্থানের কিছু অংশ থাকায় সেখানে কিছু কাজ বাকি রয়েছে।

আরও পড়ুনবছরের পর বছর যায় সড়কের দুর্ভোগ কাটে না৬ বছর ধরে সাঁকো দিয়ে সেতু পারাপারভাসানী সেতুতে মরণফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে রেলিংয়ের ফাঁকা স্থান

সড়ক বিভাগ সিলেটের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. সালাহ্‌উদ্দিন সোহাগ বলেন, এখানে চারটি মৌজার জায়গা নিয়ে কিছু জটিলতা এখনো রয়েছে। তবে শীগ্রই তা সমাধান হবে। তাছাড়া অন্যান্য জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত জটিলতা সমাধান হয়েছে এবং সেসব অংশে কাজ চলমান রয়েছে।

তিনি বলেন, জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে গণপূর্ত বিভাগ ও বন বিভাগও কাজ করে। গণপূর্ত দেখে যে জায়গায় জমি অধিগ্রহণ করা হবে সেখানে কি নির্মাণ রয়েছে এবং সেটার মূল্য কত, আর বন বিভাগ দেখে সেখানে গাছ-পালা রয়েছে কিনা এটার উপর ভিত্তি করে মূল্য নির্ধারণ করা হয়। এরপর সেটা আমরা জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠিয়েছি, তারা সেটা মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। সেখান থেকে অনুমোদন আসলে পরবর্তী কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়। বাইশটিলা এলাকায় টিলা থাকায় আমরা সেই অংশ বাদ দিয়ে বাজারের মধ্যে দিয়ে রাস্তা নিয়ে যাচ্ছি।’

সালাহ্‌উদ্দিন সোহাগ বলেন, প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি না হলেও নতুন করে মেয়াদ বাড়ানোর জন্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে, আমরা এই প্রকল্পের জন্য আরও দুই বছর সময় চাইবো। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের ৬০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ৩০ হেক্টরের মতো জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। আমরা আশা করছি, আগামী এক বছরের মধ্যে রাস্তা চালু করে দিতে পারবো। জমি অধিগ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে ৭৭ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের মধ্যে ২৪টি কালভার্ট করার কথা রয়েছে, এরমধ্যে ২২টি কালভার্ট করার কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

সিলেটের সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আমির হোসেন বলেন, ধুপনিখলা মৌজা ১.৫ কিলোমিটারের জায়গা নিয়ে স্থানীয়রা কাজে বাঁধা দেওয়ায় জমি অধিগ্রহণে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। তাছাড়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজনকে কাজে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে থানায় জিডিও করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ১২ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে প্রায় ৬ কিলোমিটার অধিগ্রহণ করার কথা। কিন্তু এখনও চূড়ান্তভাবে কোনো জমি অধিগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। যে অংশে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে সেটি বাদ দিয়ে বিকল্প জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। জমি অধিগ্রহণ হয়ে গেলে ছয় মাসের মধ্যে কাজ শেষ হয়ে যাবে।

নির্ধারিত বাজেটেই এ প্রকল্প শেষ করা সম্ভব হবে কিনা জাননে চাইলে আমির হোসেন বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এখনও কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত আছে। নানা জটিলতায় কিছু এলাকায় শুরু হয়নি। নির্ধারিত বাজেটে কাজ শেষ হবে কী না তা পরবর্তীতে বলা যাবে।

আহমেদ জামিল/কেএইচকে/এএসএম