দেশজুড়ে

নদীর পাড় যেন মৃত্যুকূপ, নৌকায় উঠতে ‘সার্কাস’

সার্কাসের মঞ্চে টানটান দড়ির ওপর দিয়ে দক্ষ শিল্পীর ভারসাম্য রক্ষার খেলা দেখে হাততালি দেন দর্শকরা। মেলার মাঠে এই খেলা খুব রোমাঞ্চকর হলেও সাতক্ষীরার গাবুরার দৃশ্য আতঙ্কের। এখানকার মানুষকে নৌকায় উঠতে হলে রোজ যে শারীরিক কসরত করতে হয়, তা কোনো অংশে মৃত্যুকূপ খেলার চেয়ে কম নয়। খাড়া ও পিচ্ছিল সিসি ব্লকের (CC Block) ওপর দিয়ে টলমলে পায়ে নামতে গিয়ে বুক কাঁপে বৃদ্ধের। এক হাতে জুতা আর অন্য হাতে জীবন বাজি রেখে মায়েদের পার হতে হয় এক ভয়াবহ মরণপথ। খেয়াঘাটে পাকা সিঁড়ি না থাকায় প্রতিদিনের নদী পারাপার এখানে পরিণত হয়েছে এক নির্মম মৃত্যুকূপে।

সাতক্ষীরা উপকূলের মানচিত্রে এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের নাম গাবুরা। ২০০৯ সালে সর্বনাশা আইলায় ক্ষতবিক্ষত এই জনপদটি খোলপটুয়া ও কপোতাক্ষ নদ দ্বারা মূল ভূখণ্ড থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। শ্যামনগর উপজেলার এই ইউনিয়নটিতে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের বসবাস। দ্বীপ ইউনিয়ন হওয়ায় এখানে সড়কপথে যাতায়াতের কোনো সুযোগ নেই। যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম নৌপথ। যদিও একযুগ আগে পাশের পদ্মপুকুর ইউনিয়নের সঙ্গে সড়ক পথে যুক্ত করতে চৌদ্দরশি এলাকায় একটি ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে দুই পাশে পাকা সড়ক নির্মাণ না হওয়ায় সেই ব্রিজটি কোনো উপকারে আসেনি।

বর্তমানে এই এলাকার মানুষ নদী পথের ওপর নির্ভরশীল। অথচ বিস্ময়কর হলেও সত্য, পুরো ইউনিয়নের চারপাশ ঘিরে থাকা ৮টি খেয়াঘাটের অধিকাংশ ঘাটে লাগেনি উন্নয়নের কোনো ছোঁয়া। ফলে প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাদা-পানি মাড়িয়ে নদী পারাপার হতে হচ্ছে এখানকার হাজার হাজার মানুষকে।

সরেজমিনে গাবুরা ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায়, যাতায়াতের জন্য ইউনিয়নের চারপাশে ছোট-বড় মোট ৮টি খেয়াঘাট রয়েছে। এর মধ্যে গাবুরা-নীলডুমুর, গাবুরা-পার্শ্বেমারী এবং গাবুরা-বুড়িগোয়ালিনী ঘাট অন্যতম। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম ঘাট হলো ‘গাবুরা-নীলডুমুর’ খেয়াঘাট। উপজেলা সদর ও জেলা শহরের সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হওয়ায় প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এই ঘাট ব্যবহার করেন। কিন্তু ঘাটের দুই প্রান্তের অবস্থাই অত্যন্ত নাজুক।

বিশেষ করে নীলডুমুর অংশের অবস্থা ভয়াবহ। এখানে নদী শাসনের জন্য বসানো পিচ্ছিল সিসি ব্লকের ওপর দিয়ে মানুষকে ওঠানামা করতে হয়। ভাটার সময় যখন পানি নিচে নেমে যায়, তখন খাড়া ঢাল বেয়ে পিচ্ছিল ব্লক টপকে নৌকায় ওঠা যেন এক ভয়াবহ কসরত। বয়স্ক, শিশু ও অসুস্থ রোগীদের জন্য এটি রীতিমতো মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে।

অন্যদিকে গাবুরা প্রান্তে একসময় একটি পাকা ঘাট থাকলেও নদী ভাঙনের কবলে পড়ে সেটি এখন বিলীন হওয়ার পথে। জোয়ারের সময় কিছুটা রক্ষা মিললেও, ভাটার সময় হাঁটু সমান কাদা মাড়িয়ে নৌকায় উঠতে হয় যাত্রীদের।

স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, সাতক্ষীরা জেলা পরিষদ প্রতি বছর এই ঘাট ইজারা দিয়ে লাখ লাখ টাকা রাজস্ব আয় করে। কিন্তু যাত্রীদের সেবার মান বাড়াতে বা ঘাটের উন্নয়নে এক পয়সাও খরচ করা হয় না। বর্ষাকালে বৃষ্টি আর কাদার কারণে পরিস্থিতি এতটাই শোচনীয় হয়ে পড়ে যে, জরুরি প্রয়োজনেও মানুষ ঘর থেকে বের হতে ভয় পায়।

ঘাটের এই দুরাবস্থা নিয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. শফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আমরা দ্বীপের মানুষ, সবদিক থেকেই অবহেলিত। ব্যবসার কাজে মালামাল নিয়ে আমাকে প্রতিদিন এই ঘাট পার হতে হয়। কিন্তু ঘাটে কোনো জেটি বা সিঁড়ি না থাকায় লেবাররা মালামাল মাথায় নিয়ে ওই পিচ্ছিল ব্লকের ওপর দিয়ে উঠতে চায় না। অনেক সময় মালামালসহ পড়ে গিয়ে সব নষ্ট হয়। খাজনা ঠিকই দিই, কিন্তু সেবা পাই না। এটা আমাদের প্রতি অবিচার।

বৃদ্ধ আমজাদ হোসেন বলেন, বাপ-দাদার আমল থেকে দেখে আসছি এই কাদা মাড়িয়ে চলা। ভেবেছিলাম মরার আগে একটা পাকা ঘাট দেখে যেতে পারবো। কিন্তু কপালে নেই। গত মাসে আমার অসুস্থ স্ত্রীকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাওয়ার সময় ঘাটে নামাতে গিয়ে স্লিপ করে পড়ে যাই। পরে চিকিৎসার বদলে উল্টো আরও জখম নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছে।

মৎস্যজীবী রহমত আলী বলেন, রাতে বা ঝড়ের দিনে এই ঘাট দিয়ে পার হওয়া যে কত বড় ঝুঁকির, তা বলে বোঝানো যাবে না। কোনো লাইট নেই, বসার জায়গা নেই। বৃষ্টির সময় ভিজতে ভিজতে নৌকার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। আমরা কি এই দেশের নাগরিক না? আমাদের জীবনের কি কোনো দাম নেই?”

ঘাটের অব্যবস্থাপনায় সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন নারী, শিশু ও শিক্ষার্থীরা। গৃহিণী আয়েশা বেগম বলেন, আমাদের মতো নারীদের জন্য এই ঘাট পার হওয়া লজ্জার এবং কষ্টের। কোলে ছোট বাচ্চা, হাতে ব্যাগ, কীভাবে ওই খাড়া ব্লকের ওপর দিয়ে নামবো? প্রায়ই পা পিছলে পড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। কাদা মেখে যখন আত্মীয়ের বাড়ি বা ডাক্তারের কাছে যাই, তখন খুব অপমান লাগে। গর্ভবতী মায়েদের এই পথে হাসপাতালে নেওয়া মানে মৃত্যুকে হাতে নিয়ে চলা।

সমস্যার গভীরতা স্বীকার করে গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জি.এম. মাসুদুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, গাবুরাবাসীর দুঃখের কোনো শেষ নেই, আর এই খেয়াঘাট হলো সেই দুঃখের অন্যতম কারণ। ৫০ হাজার মানুষের যাতায়াতের প্রধান এই মাধ্যমটির এমন বেহাল দশা মেনে নেওয়া যায় না। আমি চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে জেলা প্রশাসন ও জেলা পরিষদকে বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার লিখিত ও মৌখিকভাবে জানিয়েছি। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, ফাইল চালাচালি হলেও আজ পর্যন্ত ঘাট নির্মাণের কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। মানুষ আমাকে প্রশ্ন করে, আমি উত্তর দিতে পারি না। অনতিবিলম্বে এখানে একটি ভাসমান জেটি বা পাকা ঘাট নির্মাণ করা প্রয়োজন।

সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এস. এম. মাহফুজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, গাবুরা-নীলডুমুর খেয়াঘাটটি জেলার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘাট এবং এখানকার মানুষের ভোগান্তির বিষয়টি আমরা অবগত আছি। জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে সেখানে একটি আধুনিক ও টেকসই ঘাট নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। তবে আপনারা জানেন, এ ধরনের বড় অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বড় বাজেটের প্রয়োজন হয়। বর্তমানে কিছুটা বাজেট সংকট থাকায় তাৎক্ষণিকভাবে কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। তবে আমরা বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছি। আশা করছি, খুব দ্রুতই অর্থ বরাদ্দ সাপেক্ষে সেখানে খেয়াঘাট নির্মাণের কাজ শুরু করা সম্ভব হবে।

এফএ/এমএস