বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আরও আগে দেশে ফিরতে পারলে দেশ ও দলের জন্য একটি সুবিধাজনক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারতো বলে মন্তব্য করেছেন দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান।
তিনি বলেন, দেশে একটি রাজনৈতিক শূন্যতা বিরাজ করছে, যা অত্যন্ত বিপজ্জনক। এই পরিস্থিতি শুধু দেশের জন্য নয়, বিএনপির জন্যও কিছুটা কঠিন অবস্থা তৈরি করেছে।
মতিউর রহমান বলেন, সাধারণত তিনি বড় সমাবেশে বা মাইকে কথা বলেন না। কিন্তু বর্তমান বিশেষ পরিস্থিতিতে এই অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি জরুরি মনে করেছেন—বিএনপির জন্য নয়, দেশের জন্য।
রোববার (২১ ডিসেম্বর) রাজধানীতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
মতিউর রহমান বলেন, তারেক রহমানের দীর্ঘ অনুপস্থিতি বিএনপির জন্য নানান প্রশ্ন ও বিভ্রান্তির সুযোগ তৈরি করেছে, যা দলটির জন্য নেতিবাচক হিসেবে দাঁড়িয়েছে। গত এক বছর বা ১৫ মাসে বিএনপির বিভিন্ন স্তরের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও দলের জন্য খুব ইতিবাচক হয়নি— এ বিষয়টি বিএনপি নেতৃত্ব নিশ্চয়ই জানেন এবং এখনো তা সংশোধনের সুযোগ রয়েছে।
তিনি বলেন, জরিপ অনুযায়ী বিএনপি এখনো দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল এবং নির্বাচনে তারা বেশি ভোট পেয়ে বিজয়ী হতে পারে—এমন সম্ভাবনাও রয়েছে। তবে ক্ষমতায় আসতে যাওয়া একটি দলের নেতৃত্ব ও কর্মীদের মধ্যে বিনয়, সৌজন্য, ভদ্রতা এবং সহনশীলতা আরও দৃশ্যমান হওয়া জরুরি।
বিএনপির প্রার্থী তালিকা নিয়েও জনমনে তেমন উৎসাহ নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, কিছু কিছু জায়গায় বিষয়গুলো পুনর্বিবেচনার সুযোগ রয়েছে কি না, তা দলের ভেবে দেখা উচিত।
মতিউর রহমান বলেন, এই সভার সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো—এটি বিএনপিপন্থি সাংবাদিকদের সমাবেশ বলা যাবে না। বিভিন্ন মত ও পছন্দের সাংবাদিক এবং সম্পাদকদের উপস্থিতি এটিকে একটি শক্তিশালী ও বিশ্বাসযোগ্য আয়োজন করেছে।
গণমাধ্যমের ওপর সাম্প্রতিক হামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের ওপর হামলার ঘটনায় বিএনপি নেতাদের অবস্থানের জন্য তিনি ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞ। সংকটময় সময়ে দল-মত নির্বিশেষে সাংবাদিক সমাজের পাশে দাঁড়ানো গণতন্ত্র ও ভবিষ্যৎ গণমাধ্যমের জন্য একটি ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করেছে।
নির্বাচন প্রসঙ্গে মতিউর রহমান বলেন, তিনি সবসময় সুষ্ঠু নির্বাচন চান। আগে কখনো নির্বাচন নিয়ে সংশয় প্রকাশ না করলেও সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে তার মনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে—আগামী দুই মাস কীভাবে যাবে, নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু হবে এবং এর প্রভাব কী হতে পারে।
প্রথম আলো সম্পাদক বলেন, গত ৫০ বছরে কোনো সরকার আমলেই সংবাদপত্র শিল্প খুব স্বস্তিতে ছিল না। তবে বিগত ১৫–১৬ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে গণমাধ্যম সবচেয়ে ভয়াবহ নিপীড়নের শিকার হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার সরাসরি হস্তক্ষেপ, মালিকানা বদল, সম্পাদক পরিবর্তন—সবকিছুই ঘটেছে। জুলাই-আগস্টের পরিবর্তন না হলে প্রথম আলোর অস্তিত্বই হয়তো থাকতো না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তবে তুলনামূলকভাবে বিএনপি আমলে গণমাধ্যম কিছুটা স্বস্তিতে ছিল উল্লেখ করে মতিউর রহমান বলেন, সমালোচনার পরও তখন প্রকাশ্য আক্রমণ, মামলা বা কারাবরণের ভয় ছিল না। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ২০০১ সালে ছাত্রদলের বিষয়ে সমালোচনার পর সরকার তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়েছিল, যা দুটি সরকারের মধ্যে একটি বড় পার্থক্য।
মতিউর রহমান বলেন, বিএনপির আমলে তার সঙ্গে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের খোলামেলা আলোচনা হয়েছে, তর্ক-বিতর্ক হয়েছে, কিন্তু সমালোচনামূলক লেখালেখি বন্ধ হয়নি।
ভবিষ্যতে বিএনপি ক্ষমতায় এলে আরও বেশি সহনশীলতা ও সমালোচনা শোনার মানসিকতা প্রত্যাশা করেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি বলেন, আগামী সরকার যে-ই গঠন করুক, তাদের সামনে সময়টা হবে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন সময়। এত বিভেদ, বিরোধ ও সংকট নিয়ে কোনো দেশ বা সমাজ টেকসই হতে পারে না।
জাতীয় ঐক্য ও সমঝোতার পরিবেশ তৈরিকে আগামী সরকারের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হিসেবে উল্লেখ করে মতিউর রহমান বলেন, গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধ ও নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তনের পথেই দেশকে এগোতে হবে। সে পথে সংবাদপত্রের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, আর সমালোচনা শোনার মানসিকতা ছাড়া তা সম্ভব নয়।
মতবিনিময় সভায় বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদক, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব এবং বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
কেএইচ/ইএ/এমএস