এলাকার নাম শশীর চর। যা বর্তমানে মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার অন্তর্ভুক্ত। কথিত আছে, বৃটিশ আমলে এ এলাকায় ‘শশী বাবু’ নামের একজন জমিদার ছিলেন। তাঁর নামানুসারেই এলাকার নামকরণ করা হয় শশীর চর। বৃহত্তর শশীর চরের অন্তর্ভুক্ত গ্রামগুলো হচ্ছে স্নানঘাটা, জমাদার কান্দি, কাঁচিকাটা, পাতাইলা কান্দি, শনিকোণা, উত্তর উড়ার চর, কদমতলি, ভবানী শংকর, নামির চর ও মাতুব্বর কান্দি।
এলাকার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে আড়িয়াল খাঁ নদের শাখা। মৌসুমী ফসলে সেজে ওঠে প্রতিটি গ্রাম। ফুল, ফল, ফসলের শশীর চর সবার কাছেই নান্দনিক। শান্ত-শিষ্ট এলাকা। একটি গ্রামের সাথে আরেকটি গ্রামের সৌহার্দ সহোদরের মতো। মিলেমিশে চলে যুগের পর যুগ।
শশীর চরের যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে গ্রীষ্মকালে পায়ে হাঁটা পথ আর বর্ষাকালে নৌকা। সবখানেই কাঁচা রাস্তা। মাঝে মাঝে আবার ভাঙা। অনেক রাস্তা আবার তলিয়ে যায় পানির নিচে। বর্ষায় সেখানে ভরসা কেবল বাঁশের সাঁকো কিংবা নৌকা। জনগণ কার্যত নিরুপায়।
শশীর চর কৃষিপ্রধান অঞ্চল। কৃষকের সংখ্যাই বেশি। কোনো কোনো মৌসুমে ধান, গম, পাট, আখ, সরিষা, কলই, মুসুরি, পেঁয়াজ, রসুন, ধনিয়া তাদের অর্থকরী ফসল। তবে বর্ষা মৌসুমের কয়েক মাস জমি থাকে পানির নিচে। ফলে অর্থনৈতিক অবস্থা আহামরি ভালো বলা যায় না। কেননা বছরের ছয় মাস বসে বসেই খেতে হয় সবাইকে। বেশিরভাগেরই আবার ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’।
এতসব হতাশার মাঝেও ১৯২৬ সালে আশার আলো হয়ে এলো একটি দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এলাকার ছেলেমেয়েকে ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য উদ্যোগ নেন শশীর চরের অন্তর্গত ভবানী শংকর গ্রামের আল্লামা ফয়েজ উদ্দিন আহম্মেদ (রহ.)। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন একটি মাদরাসা। পাশের গ্রাম স্নানঘাটায় প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি। নাম রাখেন স্নানঘাটা ইসলামিয়া মাদরাসা। নিজ বাড়ির চাচাতো ভাই মো. গয়াজুদ্দিন ঢালী ও মো. মালাই ঢালীর দান করা জমিতে গড়ে তোলেন প্রতিষ্ঠানটি। প্রথমে এবতেদায়ী পর্যন্ত চালু করেন। এরপর থেকে পড়াশোনায় উন্নতির দিকে যেতে থাকে এলাকাটি। সুনাম ছড়িয়ে পড়ে মাদরাসার।
মহকুমা শহর থেকে বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ বলা যায় শশীর চরকে। আড়িয়াল খাঁ নদ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে গ্রামটি। তারপরও বেশকিছু মানুষের উদ্যোগে মাদরাসাটি চলতে থাকে। নিজস্ব ভবন না থাকায় পাশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে পাঠদান চলতে থাকে। পাশাপাশি খুব ভোরে মসজিদে মসজিদে মক্তবের প্রচলন ছিল।
রাতের বেলা কেরোসিন চালিত হারিকেন বা বাতিই ভরসা। সন্ধ্যা হলেই হারিকেনের চিমনি পরিষ্কার করে আলো জ্বালাতে হয়। সন্ধ্যার পর থেকে ঘণ্টা দুই আলো জ্বললেও রাত বাড়ার সাথে সাথে একে একে নিভে যেতে থাকে সব আলো। তখন নিকষ কালো অন্ধকার ঘিরে ধরে এলাকাটিকে।
সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হলেও দূর-দূরান্ত থেকে দ্বীনি এলেম শেখার জন্য শিক্ষার্থীরা আসতে থাকেন। গৃহস্থ বাড়িতে তাদের লজিং থাকার ব্যবস্থা করা হয়। আল্লামা ফয়েজ উদ্দিনের বাড়িতে দুটি কাচারি ঘরে বোডিং চালু করা হয়। দূরের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। বিশাল পাতিলে রান্না হয়। দিনভর পড়াশোনার গুনগুন শব্দ ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে।
এলাকাবাসীর সহায়তায় দ্বীনি শিক্ষা প্রচারের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত স্নানঘাটা ইসলামিয়া মাদরাসাটি ক্রমান্বয়ে ফাযিল পর্যন্ত এমপিওভুক্ত হয়। একসময় কাগজে-কলমে মাদরাসার নাম হয় স্নানঘাটা ইসলামিয়া সিনিয়র মাদরাসা’। প্রতিষ্ঠাতা ফয়েজ উদ্দিন আহম্মেদ বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষের কাছ থেকে সাহায্য আনতে শুরু করেন। ধান, চাল, ডালসহ বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে গ্রামের মানুষ তাঁকে সাহায্য করতে থাকেন। তৎকালীন রাজনীতিবিদ আব্দুল করিম ঢালীর সঙ্গে সখ্য ছিল শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের। ফয়েজ উদ্দিন মাদরাসাটি উন্নত করার লক্ষ্যে আব্দুল করিম ঢালীর সাহায্য চাইলেন। তিনি বড় হুজুরকে সঙ্গে নিয়ে শেরে বাংলার সঙ্গে দেখা করেন। মাদরাসার উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখেন তাঁরা।
স্থানীয়দের কাছে শোনা যায়, ফয়েজ উদ্দিন আহম্মেদ ১৮ শতকের শেষের দিকে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় ‘বড় হুজুর’ নামে পরিচিত ছিলেন। তার বাবা মোহাম্মদ ঢালী একজন আদর্শ কৃষক ছিলেন। কৃষকের সন্তান হিসেবে ফয়েজ উদ্দিনের বাবা ছেলেকে আদর্শ কৃষকই বানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফয়েজ উদ্দিনের পড়াশোনার প্রতি ব্যাপক আগ্রহ ছিল।
তাই পড়াশোনার আগ্রহ নিয়ে বর্তমান কালকিনি উপজেলার শিকারমঙ্গল এলাকার মামা বাড়িতে (ঢালী বাড়ি) চলে যান। সেখানেই প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। পরে এলাকার বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন মাওলানা খলিলুর রহমান বাহার উল্লাহর আদর্শে আকৃষ্ট হয়ে তাঁর সান্নিধ্যে কয়েক বছর এলমে দ্বীন গ্রহণ করেন। পরে উচ্চ শিক্ষার জন্য হাটহাজারী মাদরাসায় যান। সেখান থেকে পড়া শেষ করে কলকাতা আলীয়া মাদরাসায় গিয়ে আরবি সাহিত্যে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন।
শিক্ষাগ্রহণ শেষে এলমে দ্বীন প্রচার ও শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে নিজ জন্মস্থান ভবানী শংকরে ফিরে আসেন। গ্রামে এসে প্রতিবেশী হাজী তজিমুল্লাহ ফরাজীর মেয়ে মোসাম্মৎ মরিয়ম বিবির সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এক ছেলে আফছার উদ্দিন আহমেদ ও এক মেয়ে মোসাম্মৎ রাবেয়া খাতুনকে রেখে প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর পার্শ্ববর্তী উত্তর উড়ার চর গ্রামের ঢালী বাড়ির মোহাম্মদ ফরমান ঢালীর মেয়ে জবেদা বিবিকে বিবাহ করেন। সে পক্ষে তাঁর আরও পাঁচটি কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করেন। তাদের নাম রাখেন ফরিদা খানম, মমতাজ বেগম, রিজিয়া খানম, সুফিয়া বেগম ও অজুফা খানম।
এলাকার ‘বড় হুজুর’ খ্যাত ফয়েজ উদ্দিন শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ইসলাম প্রচারকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তিনি হাজী শরীয়ত উল্লাহর ফরায়েজী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তৎকালীন পীরজাদা আবা খালেদ রশিদ উদ্দিন ওরফে বাদশা মিয়ার নেতৃত্বে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলেন।
কথিত আছে, একবার অনাবৃষ্টির সময় এলাকার বিশাল বিলে (জমি) তাঁর নেতৃত্বে নামাজ পড়ে মোনাজাত দেওয়া হয়। মোনাজাত শেষ না হতেই তুমুল বৃষ্টিপাত শুরু হয়। সবাই তাঁকে ফেলে দৌড়ে চলে যায়। তিনি লাঠি ভর দিয়ে ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরতে থাকেন। এ অবস্থায় কেউ একজন দেখে তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দেন। এমন অনেক অলৌকিক ঘটনা আছে তাঁর জীবনে। পরবর্তীতে তাঁর একমাত্র ছেলে মাওলানা আফছার উদ্দিন আহমেদ ঢাকা আলীয়া থেকে কামিল পাস করে মাদরাসার শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। পরে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
১৯৮০ সালের দিকে বার্ধক্যজনিত কারণে আল্লামা ফয়েজ উদ্দিন আহম্মেদ নিজবাড়িতে ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুর পর বাড়িতেই কবর খোড়েন আত্মীয়-স্বজনরা। কিন্তু এলাকাবাসীর অনুরোধে তাঁকে তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা প্রাঙ্গণে শায়িত করা হয়।
বৃহত্তর ফরিদপুরের মধ্যে এটিই প্রথম এবং প্রাচীন ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বলে জনশ্রæতি রয়েছে। বংশ পরম্পরায় ফরায়েজী আন্দোলনের খলিফা হন মাওলানা আফছার উদ্দিন আহমেদও। এলাকায় তাঁকেও ‘বড় হুজুর’ বলে সম্মান করেন সবাই। ফলে মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে মিলাদ বা দোয়া পড়ানো, মৃতের জানাজা পড়ানো, মসজিদের ইমামতি, আজান দেওয়া, জমির ভাগ-বণ্টন, ধর্মীয় মাসআলা দেওয়া, শীতের মৌসুমে ওয়াজ-মাহফিল করা, গরুর ক্ষুরা রোগের জন্য পাকা কলা পড়ানো, অসুখ-বিসুখের জন্য পানি পড়া দেওয়া, গ্রামের ছোটখাটো বিচার-বৈঠক তো আছেই। ফলে তাঁকে ‘শাহ সাহেব’ উপাধিও দেওয়া হয়।
একসময় মাদরাসার অধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব পালন শেষে অবসর জীবন যাপন করেন মাওলানা আফছার উদ্দিন আহমেদ। তাঁর জীবদ্দশায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা আলীয়া মাদরাসায় শিক্ষাজীবন শেষ করে একমাত্র ছেলে মাওলানা মেছবাহ উদ্দিন ফয়েজী গ্রামে ফিরে আসেন। মাদরাসার আরবি প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। পরে বাবার মৃত্যুর পর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে মাদরাসার হাল ধরেন। একসময় তিনি উপাধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব পালন করছিলেন। কিন্তু মধ্য বয়সে কিডনি সংক্রান্ত জটিলতায় প্রয়াত হন তিনি।
ইসলামের প্রচার বা খেদমতে নিবেদিত পরিবারটি তাদের দায়িত্বভার থেকে অব্যাহতি পান আল্লাহর ইশারায়। এলাকার মানুষের ভালোবাসায় মাদরাসাটি এরই মধ্যে শতবর্ষ অতিক্রম করার গৌরব অর্জন করে। মাদরাসাটির অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী দেশে-বিদেশে সুনামের সঙ্গে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন এবং বর্তমানেও করছেন।
তথ্যসূত্র
১. ইতিহাস ঐতিহ্য অমরত্বের কালকিনি, আকন মোশাররফ হোসেন, পৃষ্ঠা- ২১২/২১৩২. বড় হুজুরের পুত্রবধূ আমেনা বেগম৩. একমাত্র পুত্র মাওলানা আফছার উদ্দিন আহমেদ৪. একমাত্র নাতি মাওলানা মেছবাহ উদ্দিন ফয়েজী৫. বড় মেয়ে রাবেয়া খাতুনের ছেলে মাওলানা আব্দুল মাজেদ।
লেখক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
ওএফএফ/এএসএম