দেশজুড়ে

ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার নিষিদ্ধ, বিপাকে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকরা

বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন নিষিদ্ধ করেছে সরকার। অথচ ভূগর্ভস্থ পানিকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্র নিজেই কয়েক দশক ধরে কৃষি ব্যবস্থাকে গড়ে তুলেছে। হঠাৎ করেই সেই পানির ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে করে জারি করা সরকারি গেজেটে বড় ধরনের নীতিগত সমস্যা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

সম্প্রতি জারি করা গেজেটে রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নাটোর জেলার বরেন্দ্র এলাকার চার হাজার ৯১১টি মৌজাকে ‘নিষিদ্ধ অঞ্চল’ ঘোষণা করে সেচসহ সব কাজে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। কেবলমাত্র খাবার পানির জন্য ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের অনুমতি রাখা হয়েছে।

গেজেটে পরিবেশ সুরক্ষা ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাসের যুক্তি তুলে ধরা হলেও কৃষিকাজ কীভাবে চলবে সে বিষয়ে কোনো বিকল্প পরিকল্পনা, বিকল্প সেচব্যবস্থা কিংবা ক্ষতিপূরণের দিকনির্দেশনা নেই। এতে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষি ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

গেজেট অনুযায়ী, ঘোষিত সব মৌজায় সেচ ও অন্যান্য কাজে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ। তবে এতে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য কোনো ছাড়, বাস্তবায়নের সময়সূচি বা অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা উল্লেখ করা হয়নি। কৃষক, গবেষক ও নীতিবিশেষজ্ঞদের মতে, বরেন্দ্র এলাকার কৃষি বাস্তবতাকে উপেক্ষা করেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

বরেন্দ্র অঞ্চল দেশের অন্যতম খরাপ্রবণ এলাকা। উঁচু-নিচু ভূমি, লালচে কাদামাটি ও কম বৃষ্টিপাতের কারণে এখানকার কৃষি দীর্ঘদিন ধরেই সেচনির্ভর। ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশক থেকে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) মাধ্যমে সরকার হাজার হাজার গভীর নলকূপ স্থাপন করে বোরো ধানসহ সেচনির্ভর ফসল চাষে উৎসাহ দেয়। এই নীতির ফলে শস্য বিন্যাস, ভূমি ব্যবহার, ঋণ ব্যবস্থা এবং গ্রামীণ জীবিকা আমূল বদলে যায়। বরেন্দ্র অঞ্চলের পুরো অর্থনীতি গড়ে ওঠে নলকূপনির্ভর সেচ ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, নতুন গেজেটে ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারের দায় কৃষকদের ওপর চাপানো হলেও এই ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা উপেক্ষা করা হয়েছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক অভিজিৎ রায় বলেন, ‌‘এই ব্যবস্থা কৃষকরা তৈরি করেননি। রাষ্ট্রই এটি পরিকল্পনা করেছে, অর্থায়ন করেছে এবং পরিচালনা করেছে। এখন কোনো বিকল্প না দিয়েই বড় এলাকাজুড়ে ভূগর্ভস্থ পানি নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। এটি ঠিক নয়। আগে এর বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, পরে এই সিদ্ধান্ত বাস্তাবায়ন করা দরকার।’

পানি উত্তোলন নিষিদ্ধ মৌজার কৃষকরা বলছেন, তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন: ফারাক্কার কারণে বরেন্দ্র অঞ্চল কারবালায় পরিণত হয়েছেপানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় বরেন্দ্র অঞ্চলে ফসল উৎপাদন ব্যাহত

রাজশাহীর তানোর উপজেলার রাষ্ট্রপতি গোল্ড মেডেলপ্রাপ্ত কৃষক ও স্বশিক্ষিত কৃষিবিজ্ঞানী নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘বরেন্দ্র কোনো অনাবাদি অঞ্চল নয়। ধান থেকে সবজি সবকিছুই সেচনির্ভর। কৃষকদের সঙ্গে কথা না বলে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।’

নওগাঁর সাপাহার ও পোরশা উপজেলায় কৃষকরা জানান, সেখানে কার্যকর কোনো ভূ-উপরিস্থ পানির উৎস নেই। খালগুলো ভরাট, জলাধার সীমিত এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা কার্যত নেই।

সাপাহারের প্রান্তিক কৃষক বশির উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘নলকূপ ছাড়া আমাদের আর কোনো ভরসা নেই। পানি বন্ধ হলে জমি অনাবাদি পড়ে থাকবে।’

কৃষকরা বলছেন, গেজেট জারির আগেই তারা বীজ, সার ও জমি প্রস্তুতে বিনিয়োগ করেছেন। এখন সেচ বন্ধ হলে তাদের বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে, অথচ কোনো সহায়তার নিশ্চয়তা নেই।

যদিও গেজেটের ভাষা কঠোর, বাস্তবে এর প্রয়োগ অসম ও অসমতা পূর্ণ বলে অভিযোগ উঠেছে। কোথাও ছোট কৃষকদের নলকূপ ব্যবহার না করতে সতর্ক করা হলেও প্রভাবশালীরা পানি উত্তোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।

তানোর উপজেলার কালমা ইউনিয়নের কৃষক আবদুল হামিদ বলেন, ‘এই সিদ্ধান্ত পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব নয় কর্তৃপক্ষও তা জানে। তাই প্রয়োগ হচ্ছে বেছে বেছে, দুর্বলরা চাপে পড়ছেন।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের অসম প্রয়োগ পরিবেশ সুরক্ষা যেমন ব্যাহত করবে, তেমনি পানি ব্যবস্থাপনায় মানুষের আস্থাও নষ্ট করবে।

অধ্যাপক অবিজিৎ রায় বলেন, পানি সংকট বাস্তব, পরিবর্তন দরকার। কিন্তু হঠাৎ করে কৃষকদের থামিয়ে দিলে তা কাজ করবে না। ধাপে ধাপে এবং বিকল্প দিয়ে এগোতে হবে।

বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়া এই গেজেট কার্যকর করা বাস্তবসম্মত নয়। এটি বাস্তবায়ন হলে ২৫ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমি অনাবাদি থাকবে এবং চলতি মৌসুমেই প্রায় ২৭ লাখ মেট্রিক টন ফসল উৎপাদন কমে যাবে।’

তিনি বলেন, সম্প্রতি পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ও পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সঙ্গে বৈঠকে বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। আমরা ফসল ফলানো এবং বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত কৃষিকাজ চালু রাখার অনুরোধ জানিয়েছি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, গেজেটে পরিবেশ সুরক্ষা ও কৃষি বাস্তবতার মধ্যে সমন্বয় নেই। এমনকি বিকল্প উন্নয়নের দায়ভার কার তাও স্পষ্ট নয়।

বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজের গবেষক ও আঞ্চলিক সমন্বয়কারী শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘পানি সংরক্ষণ নীতি হতে হবে ধাপে ধাপে। আগে নিষেধাজ্ঞা পরে সমাধান—এভাবে চললে ক্ষুদ্র কৃষকরা কৃষি থেকে ছিটকে পড়বেন।’

হঠাৎ চাষাবাদ বন্ধ হয়ে গেলে বরেন্দ্র অঞ্চলে অভিবাসন, ঋণগ্রস্ততা ও সামাজিক সংকট বাড়তে পারে। তাই অবিলম্বে গেজেট পুনর্বিবেচনা, কৃষকদের সঙ্গে আলোচনা, ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন এবং প্রান্তিক কৃষকদের জন্য অন্তর্বর্তী সহায়তা দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

এসআর/এএসএম