রাজনীতি

গণতন্ত্রের প্রতীক খালেদা জিয়া

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয় বিএনপি এবং দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নাম। দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর মারা গেছেন বাংলাদেশের প্রথম এই নারী প্রধানমন্ত্রী। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।

তিনবার দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া এই নারী নেত্রীকে জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও কারাভোগ করতে হয়েছে দুর্নীতির অভিযোগে। বিএনপি সবসময়ই দাবি করে এসেছে যে, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে করা এই মামলাগুলো ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে পালিয়ে যান ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো বাতিল করা হয়। শেষ পর্যন্ত দীর্ঘদিন শারীরিকভাবে সংকটাপন্ন অবস্থায় থাকার পর মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে সকাল ৬টার দিকে মারা যান তিনি।

গৃহিনী থেকে রাজনীতির কিংবদন্তি

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ছিলেন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর পর বিশ্বের দ্বিতীয় কোনো মুসলিম রাষ্ট্রের নারী প্রধানমন্ত্রী। ১৯৮১ সালে তার স্বামী তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার পর রাজনীতিতে প্রবেশ করেন তিনি।

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য বাংলাদেশ সরকার পরবর্তীতে তাকে বীর উত্তম উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে মৃত্যুর কয়েক বছর আগে তার হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি।

কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও সেনা শাসনের বিরুদ্ধে বেসামরিক রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে দ্রুতই বাংলাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনীতিবিদে পরিনত হন খালেদা জিয়া।

বিএনপি মধ্য-ডানপন্থি ঘরানার হলেও রাজনীতির মাঠে বাম এবং ডান দুই ঘরানার রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই যুগপৎ আন্দোলন গড়ে এরশাদের স্বৈরশাসনের ভিত্তি দুর্বল করে দিতে সক্ষম হন তিনি।

১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি ৩০০ আসনের মধ্যে ১৪০টি আসনে জয়লাভ করে এবং খালেদা জিয়া দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন।

নারীর ক্ষমতায়নে উদ্যোগ

বাংলাদেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সংস্কারে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন খালেদা জিয়া। বিশেষভাবে নারী সাক্ষরতার হার বাড়াতে এবং তাদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে উদ্যোগী হন তিনি। এজন্য খালেদা জিয়া মেয়েদের বিনামূল্যে শিক্ষার ব্যবস্থা করেন এবং বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী পোশাক খাতের প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখেন, যেখানে বহু নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে।

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দেশে মেয়েদের স্কুলমুখী করতে বিনামূল্যে শিক্ষার পাশাপাশি শুধু তাদের জন্য আলাদা বৃত্তিরও ব্যবস্থা করে বিএনপি সরকার। বিদেশি দাতাদের সহায়তায় স্কুলে শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে দুপুরের খাবার সরবরাহের উদ্যোগও নেওয়া হয়। সব মিলিয়ে খালেদা জিয়ার অধীনে প্রাথমিক বাংলাদেশে এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়েদের ভর্তির হার বেড়ে যায়।

মার্কিন পত্রিকা নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে ১৯৯৩ সালের ১৭ নভেম্বর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে নারীর ক্ষমতায়নে ভূমিকা রাখায় খালেদা জিয়া প্রশংসিত হন।

পত্রিকাটি তাদের প্রতিবেদনে পাকিস্তানের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর নীতির সঙ্গে খালেদা জিয়ার বৈসাদৃশ্যের বিষয়টি তুলে ধরে লেখে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেগম জিয়া অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে শিক্ষা এবং কারিগরি প্রশিক্ষণকে উৎসাহিত করেছেন, বিশেষ করে মেয়েদের মাঝে।

নিজের তৃতীয় মেয়াদে ২০০১ এবং ২০০৬ সালের মধ্যে কয়েক বছর মার্কিন ফোর্বস ম্যাগাজিনের বিশ্বের ১০০ ক্ষমতাসীন নারীর তালিকায়ও স্থান পান তিনি।

ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এক সময়ের লাজুক এবং চাপা স্বভাবের গৃহবধূ বেগম জিয়া, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শিক্ষাখাতে বিপ্লব ঘটিয়েছেন, বিশেষ করে নারী শিক্ষায়।

শেখ হাসিনার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী

খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে প্রবেশ দেশটিকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে ভূমিকা রাখলেও তিনি দ্রুতই বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা শেখ হাসিনার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত হন। তারা দুজন ১৭ কোটির বেশি মানুষের এই দেশকে ১৯৯১ সাল থেকে বিভিন্ন মেয়াদে শাসন করেছেন।

রাজনৈতিক বৈরিতার কারণে পশ্চিমা কূটনীতিকদের কাছে তারা পরিচিতি পান ‘ব্যাটলিং বেগমস’ হিসেবে। বাংলাদেশের রাজনীতি গত কয়েক দশক ধরে কার্যত এই দুই নারীকে ঘিরেই ঘুরপাক খেয়েছে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক গবেষক মাইকেল কুগলম্যান বলেন, আমি যখন খালেদা জিয়ার নাম শুনি, তখন প্রথমেই মনে আসে শেখ হাসিনার সঙ্গে তার তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা৷। খালেদা জিয়া এবং হাসিনার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে তা প্রভাব বিস্তার করেছে।

২০০৮ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে সক্ষম হন মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি শেখ হাসিনা। তবে এই দীর্ঘ মেয়াদে ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের শুরুতে তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন করেও তেমন কোনো কঠোর রাজনৈতিক প্রতিরোধের মুখে পড়েননি তিনি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়াকে বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে এ সময় সফলভাবে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় করে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের সেই টানা ক্ষমতায় থাকার মেয়াদে শুধু খালেদা জিয়া নন, বিএনপির প্রায় চল্লিশ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে প্রায় দুই লাখের মতো মামলা করা হয়। দলটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই সময়ে অন্তত ৬০০ নেতাকর্মী গুমের এবং তিন হাজার নেতাকর্মী বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন।

এক সময় গণতন্ত্রের কঠোর সমর্থক খালেদা জিয়াও এই সময়ে শেখ হাসিনার দীর্ঘদিন ক্ষমতা ধরে রেখে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠা রুখতে পারেননি।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিবেশি দেশ ভারত বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে বলে বিশ্বাস করা হয়।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে আসিফ নজরুল (অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা হওয়ার আগে) বলেছিলেন, ২০১৩ সালে ঢাকায় ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ না করার সিদ্ধান্ত এবং একই বছরে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে শেখ হাসিনার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ায় তিনি (খালেদা জিয়া) রাজনৈতিকভাবে ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, যদিও ধারণা করা হয় যে খালেদা জিয়ার বিপুল সমর্থক রয়েছে, শেখ হাসিনা বিতর্কিত নির্বাচনগুলোর সময়ে কৌশলে সেই ভোটারদের ব্যালট বাক্স থেকে দূরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।

যেসব কারণে স্মরণ করা হবে খালেদা জিয়াকে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লায়লা নূর ইসলাম মনে করেন, খালেদা জিয়া বাংলাদেশে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছিলেন।

তার মতে, বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের সূচনা করা, লাখ লাখ নারীকে পোশাক খাতে চাকরির ব্যবস্থা করা, সবার জন্য বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা গড়াসহ বিভিন্ন কারণে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

অধ্যাপক আসিফ নজরুল মনে করেন, খালেদা জিয়ার গণতন্ত্রের জন্য লড়াই এবং সেই লড়াইয়ের কারণে জীবনের শেষ দিকে যে ভোগান্তির তিনি শিকার হয়েছেন, সেজন্য তিনি বহুযুগ মানুষের হৃদয়ে থাকবেন।

তিনি বলেন, খালেদা জিয়া চাইলে ২০০৬-২০০৭ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় কিংবা তার বিরুদ্ধে মামলা চলাকালীন সময়ে বিদেশে চলে যেতে পারতেন। তার বয়স হয়েছিল এবং তিনি অসুস্থ ছিলেন। তা সত্ত্বেও অনেক ভোগান্তির শিকার হতে হবে জেনেও তিনি হাসিনা সরকারের কাছে নতিস্বীকার করেননি এবং বিদেশে চলে যাওয়ার সুযোগ নেননি।

এএমএ/জেআইএম