রাজনীতি

জলপাইগুড়ির পুতুল থেকে বাংলার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেগম খালেদা জিয়া এক অনন্য নাম। তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনের নেতৃত্বদাতা এবং দীর্ঘ সময় ধরে বিরোধী রাজনীতির দৃঢ় প্রতীক তিনি। অবিভক্ত ভারতের জলপাইগুড়িতে জন্ম নেওয়া একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের কন্যা ‘পুতুল’ সময়ের পরিক্রমায় পরিণত হন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী ও আলোচিত রাষ্ট্রনায়কে।

জন্ম ও শৈশব

বেগম খালেদা জিয়ার পুরো নাম খালেদা খানম পুতুল। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট, ব্রিটিশ ভারতের বঙ্গ প্রদেশের জলপাইগুড়িতে। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়। তার পিতামহ হাজী সালামত আলী এবং মাতামহ জলপাইগুড়ির তোয়াবুর রহমান।

তার বাবা ইস্কান্দার মজুমদার ছিলেন একজন ব্যবসায়ী এবং মা বেগম তৈয়বা মজুমদার ছিলেন গৃহিণী। পরিবারটি পরবর্তীতে দিনাজপুরের মুদিপাড়ায় বসবাস শুরু করে। তাদের আদি পৈতৃক নিবাস বর্তমানে বাংলাদেশের ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলার শ্রীপুর গ্রামের মজুমদার বাড়ি।

শিক্ষা ও বিবাহ

খালেদা জিয়া পাঁচ বছর বয়সে দিনাজপুর মিশন স্কুলে ভর্তি হন। পরে দিনাজপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। একই বছর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকেই তিনি খালেদা জিয়া নামে পরিচিতি লাভ করেন।

তিনি ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত দিনাজপুরের সুরেন্দ্রনাথ কলেজে পড়াশোনা করেন। এরপর স্বামীর কর্মস্থলের সূত্রে পশ্চিম পাকিস্তানে যান এবং ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত করাচিতে অবস্থান করেন। পরে ঢাকায় ফিরে এসে চট্টগ্রামের ষোলশহর এলাকায় বসবাস করেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় গ্রেফতার

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে খালেদা জিয়া আত্মগোপনে চলে যান। ১৬ মে নৌপথে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসেন। তার সঙ্গে ছিলেন দুই পুত্র তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকো। পাকিস্তানি বাহিনীর নজরে পড়লে একের পর এক বাড়ি পরিবর্তন করে আত্মগোপনে থাকতে হয় তাকে। শেষ পর্যন্ত ২ জুলাই ১৯৭১ তিনি পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন।

পরিবার

খালেদা জিয়ার স্বামী লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তম, যিনি পরবর্তীতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন। তার এক ভাই মেজর (অব.) সাঈদ ইস্কান্দার বিএনপি থেকে ফেনী-১ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। তার বড় ছেলে তারেক রহমান বর্তমানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। কনিষ্ঠ ছেলে আরাফাত রহমান কোকো ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি মালয়েশিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন।

রাজনীতিতে প্রবেশ

১৯৮১ সালের ৩০ মে এক সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হলে খালেদা জিয়া রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে (বিএনপি) যোগ দেন।

১৯৮৩ সালে তিনি দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন এবং ১৯৮৪ সালের ১০ মে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন

১৯৮৩ সালের বেগম জিয়ার নেতৃত্বে সাত দলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়। একই সময় এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন আরম্ভ হয়। বেগম জিয়া প্রথমে বিএনপিকে নিয়ে ১৯৮৩ এর সেপ্টেম্বর থেকে ৭ দলীয় ঐক্যজোটের মাধ্যমে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সূচনা করেন। একই সময় তার নেতৃত্বে সাত দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন পনেরো দলের সঙ্গে যৌথভাবে আন্দোলনের কর্মসূচির সূত্রপাত করে।

১৯৮৬ সাল পর্যন্ত পাঁচ দফা আন্দোলন চলতে থাকে। কিন্তু ১৯৮৬ সালের ২১ মার্চ রাতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এরশাদের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে বাধার সৃষ্টি হয়। ১৫ দল ভেঙে ৮ দল ও ৫ দল হয়। ৮ দল নির্বাচনে যায়। এরপর বেগম জিয়ার নেতৃত্বে ৭ দল, পাঁচ দলীয় ঐক্যজোট আন্দোলন চালায় এবং নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে।

১৯৮৭ সাল থেকে খালেদা জিয়া ‘এরশাদ হটাও’ শীর্ষক এক দফার আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। এর ফলে এরশাদ সংসদ ভেঙে দেন। তারপর পুনরায় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের উপক্রম হয়। অবশেষে দীর্ঘ আট বছর অবিরাম, নিরলস ও আপসহীন সংগ্রামের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে বিএনপি এবং খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। সেই নির্বাচনে খালেদা জিয়া মোট পাঁচটি আসনে অংশ নিয়ে পাঁচটিতেই জয়লাভ করেন।

প্রধানমন্ত্রিত্বের তিন অধ্যায়

১৯৯১ সালের ১৯ মার্চ বেগম খালেদা জিয়া পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তার সরকার দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠিত করে। ২ এপ্রিল তিনি সংসদে সরকারের পক্ষে এই বিল উত্থাপন করেন। একই দিন তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদকে স্বপদে ফিরে যাবার ব্যবস্থা করে একাদশ সংশোধনী বিল আনেন। ৬ আগস্ট ১৯৯১ সালের সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে দুটি বিল পাস হয়।

১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। যা পরবর্তীতে ৯৬ এর একদলীয় নির্বাচন হিসেবে গণ্য হয়। বিরোধীদলের আপত্তির পর ও খালেদা জিয়া ও তার দল এই একক নির্বাচন করেন। আওয়ামী লীগসহ সব বিরোধী দল এই নির্বাচন বয়কট করে। এই সংসদ মাত্র ১৫ দিন স্থায়ী হয়। খালেদা জিয়া এই সংসদেরও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। প্রবল গণ আন্দোলন ও বর্হিবিশ্বের চাপে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস হয় এবং খালেদা জিয়া পদত্যাগ করেন।

অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে চারদলীয় ঐক্যজোট গঠন করে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর সংসদ নির্বাচনে চারদলীয় ঐক্যজোট বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। খালেদা জিয়া এই সংসদেও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর এই সংসদের মেয়াদ শেষ হয়।

এমএএস/এসএনআর/জেআইএম