বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেগম খালেদা জিয়ার উত্থান ছিল অনেকটাই অপ্রত্যাশিত। ব্যক্তিজীবনে রাজনীতি থেকে দূরে থাকা এই গৃহিণী কখনোই সরাসরি রাজনীতিতে জড়ানোর আগ্রহ দেখাননি। তবে এক করুণ ও জটিল পরিস্থিতিতে স্বামী, সাবেক রাষ্ট্রপতি ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর তাকে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে আসতে হয়।
রাজনীতির বাইরে থাকা এক গৃহিণীবেগম খালেদা জিয়ার জন্ম ১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতের দিনাজপুর জেলার জলপাইগুড়ির ইস্কান্দার মজুমদার ও তৈয়বা মজুমদারের ঘরে। ভারত বিভক্তির পর তার বাবা জলপাইগুড়ি থেকে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে চলে আসেন। তার আদি বাড়ি মূলত দেশের দক্ষিণ-পূর্ব জেলা ফেনীতে। খালেদা জিয়া দিনাজপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং পরে সুরেন্দ্রনাথ কলেজে অধ্যয়ন করেন। ১৯৬০ সালে তিনি জিয়াউর রহমানকে বিয়ে করেন।
শিক্ষাজীবন শেষে পারিবারিক জীবনেই বেশি মনোযোগী ছিলেন খালেদা জিয়া। স্বামী জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীতে কর্মরত থাকাকালীন এবং পরে রাষ্ট্রপতি হলেও খালেদা জিয়াকে খুব একটা প্রকাশ্য রাজনীতিতে দেখা যায়নি। রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ কিংবা দলীয় কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা ছিল না তার।
জিয়াউর রহমানের মৃত্যু ও রাজনৈতিক শূন্যতা১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শহীদ হন। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গভীর সংকটে পড়ে। দলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নেতার আকস্মিক মৃত্যুতে নেতৃত্বশূন্যতা তৈরি হয়, যা দলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে।
দলের চাপ ও বাস্তবতার মুখে রাজনীতিতে প্রবেশজিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপির সিনিয়র নেতারা মনে করেন, দলের ঐক্য ধরে রাখতে এবং রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে জিয়ার পরিবারের কাউকে সামনে আনা প্রয়োজন। সে সময় দলীয় নেতাকর্মীদের অনুরোধ ও চাপের মুখে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে শুরু করেন খালেদা জিয়া।
তিনি ১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি সাধারণ সদস্য হিসেবে বিএনপিতে যোগ দেন। ১৯৮৩ সালে তিনি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এটি কোনো পূর্বপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত ছিল না; বরং পরিস্থিতির বাস্তবতায় নেওয়া একটি বাধ্যতামূলক পদক্ষেপ।
সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব১৯৮২ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের পর খালেদা জিয়া গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য সর্বাত্মক আন্দোলনের সূচনা করেন। তিনি এরশাদের স্বৈরাচারের অবসান ঘটাতে ১৯৮৩ সালে গঠিত সাত দলীয় জোট গঠনের স্থপতি ছিলেন।
এরশাদ সরকারের সামরিক শাসনামলে খালেদা জিয়া ধীরে ধীরে বিরোধী রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ মুখ হয়ে ওঠেন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে তার নেতৃত্ব বিএনপিকে সংগঠিত করে এবং রাজপথে সক্রিয় করে তোলে। রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি একজন দৃঢ় ও প্রভাবশালী নেত্রী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
বিএনপির চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব১৯৮৪ সালে খালেদা জিয়া বিএনপির চেয়ারপারসনের দায়িত্ব নেন। এরপর দল পুনর্গঠন, আন্দোলন-সংগ্রাম ও নির্বাচনমুখী রাজনীতিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। খালেদা জিয়া ১৯৮৬ সালের কারচুপির নির্বাচনের বিরোধিতা করেন এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। যদিও আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) মতো রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা এরশাদের অবৈধ সরকারকে বৈধতা দেওয়ার জন্য জাতীয় পার্টির নেতৃত্বাধীন শাসনের অধীনে নির্বাচনে যোগ দিয়েছিল।
খালেদা জিয়ার দৃঢ় সংকল্পের কারণে, তাকে ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সাতবার আটক করা হয়েছিল । তিনি বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলকে শক্তিশালী একটি সংগঠনে পরিণত করেন যার ফলে তারা সারা দেশে ৩২১টি ছাত্র সংসদগুলোর মধ্যে ২৭০টি জয়লাভ করে। এই ছাত্ররা এরশাদের শাসনের পতনের আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯৮০ দশকে এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কঠোর বিরোধিতা এবং বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে ভূমিকা রাখার কারণে তিনি ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি একটি অবাধ ও সুষ্ঠু সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন বেগম জিয়া। তার প্রধানমন্ত্রিত্বকালে বাংলাদেশ সংসদীয় গণতন্ত্রে পরিণত হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার মেয়াদে কিছু বড় অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। কর্মসংস্থানের হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় এই সময় এবং শুধু তৈরি পোশাকশিল্প খাতেই পাঁচ বছরে কর্মসংস্থানের বৃদ্ধি ছিল ২৯ শতাংশ। প্রায় দুই লাখ নারী এই সময় তৈরি পোশাকশিল্প খাতে যোগ দেন।
খালেদা জিয়া জাতিসংঘে গঙ্গার পানি-বণ্টনের সমস্যা উত্থাপন করেন যাতে বাংলাদেশ গঙ্গার পানির ন্যায্য অংশ পায়। ১৯৯২ সালে তাকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানানো হলে সেখানে তিনি রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীদের সমস্যা উত্থাপন করেন এবং পরে মিয়ানমার সরকার ১৯৯০ দশকের প্রথম দিকে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে একটি চুক্তি করে।
১৯৯৬ সালে বিএনপির নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর খালেদা জিয়া টানা দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হন, কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং পুনরায় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রতিশ্রুতির কারণে, তিনি এক মাসের মধ্যে পদত্যাগ করেন। যদিও বিএনপি ১৯৯৬ সালের জুনের নতুন নির্বাচনে হেরে যায়, দলটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সংসদে সবচেয়ে বড় বিরোধী দল হিসেবে ১১৬টি আসন পায় সেই নির্বাচনে।
১৯৯৯ সালে বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গে চারদলীয় জোট গঠন করে এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি আন্দোলন কর্মসূচি শুরু করে। বেগম খালেদা জিয়া দুর্নীতি ও সন্ত্রাস নির্মূলের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়ী হন। ফোর্বস ম্যাগাজিন নারী শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নে তার ভূমিকার জন্য ২০০৫ সালে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারীদের তালিকায় তাকে ২৯ নম্বরে স্থান দেয়।
২০০৬ সালে খালেদা জিয়া একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে, তাকে ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্বাসনে পাঠানোর একাধিক প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে দুর্নীতির অভিযোগে স্বৈরাচারী সরকার গ্রেপ্তার করে।
ক্ষমতায় থাকাকালীন, খালেদা জিয়ার সরকার বাধ্যতামূলক বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা, মেয়েদের জন্য দশম শ্ণিণী পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষা, ছাত্রীদের জন্য একটি শিক্ষা ‘উপবৃত্তি’ এবং শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য খাদ্য প্রবর্তন করে শিক্ষা ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি করেছিল। তার সরকার সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ২৭ বছর থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছর করে এবং শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ করে।
বেগম জিয়া কোনো আসনেই পরাজিত না হওয়ার অনন্য রেকর্ডের অধিকারী। তিনি ১৯৯১ থেকে ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনগুলোতে পাঁচটি পৃথক সংসদীয় আসনে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০৮ সালে, তিনি যে তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন সেখানে তিনি জয়লাভ করেছিলেন।
২০০৯ সাল থেকে, যখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার বাংলাদেশকে একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত করে, তখন তিনি গণতন্ত্রের জন্য তার লড়াই নতুন করে শুরু করেছিলেন। সরকার তাকে জোরপূর্বক তার বাড়ি থেকে বের করে দেয় এবং গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন শুরু করায় তাকে দুইবার গৃহবন্দী করা হয়ে। গণতন্ত্রের প্রতি তার ভূমিকার জন্য, তাকে ২০১১ সালে নিউ জার্সির স্টেট সিনেট ‘গণতন্ত্রের জন্য যোদ্ধা’ উপাধিতে সম্মানিত করে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ২০১৮ সালে বেগম খালেদা জিয়াকে ১৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২০২০ সালের কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিস প্রতিবেদনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় আইন বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিল যে, মূলত নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য একটি রাজনৈতিক চক্রান্ত হিসেবেই তাকে সাজা দেওয়া হয়েছিল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যে তার ‘ন্যায্য বিচারের অধিকারকে সম্মান করা হয়নি।’
বিশ্লেষকদের মূল্যায়নরাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে আগমন ছিল পরিস্থিতিনির্ভর ও অনিচ্ছাকৃত। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজেকে একজন দক্ষ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি থেকে রাজনীতির শীর্ষে ওঠার এই যাত্রা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি ব্যতিক্রমী অধ্যায়।
সব মিলিয়ে, রাজনীতিতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ না থাকা সত্ত্বেও স্বামী জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা, দলীয় চাপ ও দায়িত্ববোধ থেকেই খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে প্রবেশ। পরবর্তী সময়ে সেই অনিচ্ছুক যাত্রাই তাকে দেশের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেত্রীতে পরিণত করে।
ইএআর/এমএমএআর/এমএস