প্রবাস

ফ্যাসিবাদ পতনের পরের সংকট, বিপ্লব কেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়

আবুল কালাম আজাদ

ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে একটি গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লব সফল হওয়ার পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো-ক্ষমতার শূন্যতা কীভাবে পূরণ হবে। ইতিহাস বারবার দেখিয়েছে, ফ্যাসিবাদ উৎখাত হলেই গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার কিংবা জনগণের আকাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রব্যবস্থা আপনাতেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় না। বরং বিপ্লবোত্তর সময়টাই সবচেয়ে সংকটপূর্ণ, সবচেয়ে নাজুক এবং সবচেয়ে নির্ধারণী। এই সময় যদি একটি সুসংগঠিত, আদর্শভিত্তিক ও জনআকাঙ্ক্ষানির্ভর বিপ্লবী সরকার গঠন না করা হয়, তাহলে যে ক্ষতিগুলো সৃষ্টি হয় সেগুলো অনেক ক্ষেত্রে আগের ফ্যাসিবাদের চেয়েও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

প্রথম এবং সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয় ক্ষমতার শূন্যতা থেকে। ফ্যাসিবাদী শাসন ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রযন্ত্র এক ধরনের অচলাবস্থায় পড়ে। প্রশাসন, নিরাপত্তা বাহিনী, বিচার বিভাগ-সবখানেই অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। এই শূন্যতায় যদি বিপ্লবের নেতৃত্ব একটি বৈধ ও গ্রহণযোগ্য সরকার গঠন করতে ব্যর্থ হয়, তবে পুরোনো শাসনের অবশিষ্ট শক্তি, সুবিধাভোগী গোষ্ঠী কিংবা নতুন ক্ষমতালোভী মহল সেই শূন্যতা দখল করতে উদ্যত হয়। এতে বিপ্লবের মূল চেতনা ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যায় এবং জনগণ যে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিল, তা বাস্তবায়িত না হয়ে উল্টো বিশৃঙ্খলায় রূপ নেয়।

দ্বিতীয় বড় ক্ষতি হয় বিপ্লবের আদর্শিক বিচ্যুতি। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই সাধারণত ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা, মানবাধিকার ও জনগণের অংশগ্রহণের প্রতিশ্রুতি নিয়ে সংঘটিত হয়। কিন্তু বিপ্লবোত্তর সরকার গঠিত না হলে এই আদর্শগুলো কোনো কাঠামোগত রূপ পায় না। তখন বিপ্লব কেবল একটি ঘটনা হিসেবে ইতিহাসে থেকে যায়, একটি চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে রাষ্ট্রের রূপান্তর ঘটাতে পারে না। আদর্শের জায়গা দখল করে নেয় ব্যক্তিগত স্বার্থ, দলীয় হিসাব কিংবা বিদেশি প্রভাব। ফলে বিপ্লবের নামে আবারও শোষণ, দমন ও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ শুরু হয়।

তৃতীয়ত, জনগণের মধ্যে হতাশা ও বিশ্বাসভঙ্গ তৈরি হয়। বিপ্লবের সময় মানুষ জীবন, সম্পদ ও নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে ফেলে রাজপথে নেমে আসে এই আশায় যে, একটি নতুন ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু বিপ্লবের পর যদি তারা দেখে কোনো সুস্পষ্ট সরকার নেই, দিকনির্দেশনা নেই, ন্যায়বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হয়নি, তবে জনগণের সেই বিশ্বাস দ্রুত ভেঙে পড়ে। এই হতাশা ভবিষ্যতে যে কোনো গণআন্দোলনকে দুর্বল করে দেয়, কারণ মানুষ তখন মনে করে-লড়াই করে লাভ নেই, শেষ পর্যন্ত সবই ক্ষমতার খেলায় পরিণত হয়।

চতুর্থ ক্ষতিটি হলো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের পুনর্গঠন ব্যর্থ হওয়া। ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত দলীয়করণ, দুর্নীতি ও দমননীতির হাতিয়ারে পরিণত হয়। বিপ্লবের পর একটি বিপ্লবী সরকারের প্রধান দায়িত্ব থাকে এসব প্রতিষ্ঠানকে সংস্কার করা-প্রশাসনকে নিরপেক্ষ করা, বিচার বিভাগকে স্বাধীন করা, নিরাপত্তা বাহিনীকে জনগণের অধিকার রক্ষার ভূমিকায় ফিরিয়ে আনা। কিন্তু সরকার না থাকলে বা দুর্বল থাকলে এই সংস্কার প্রক্রিয়া শুরুই হয় না। ফলে পুরোনো কাঠামো নতুন মুখোশ পরে টিকে যায় এবং ফ্যাসিবাদের বীজ রাষ্ট্রের ভেতরেই রয়ে যায়।

পঞ্চমত, নিরাপত্তাহীনতা ও সহিংসতা বাড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। ক্ষমতার শূন্যতা মানেই আইনশৃঙ্খলার দুর্বলতা। বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে যদি কার্যকর সরকার না থাকে, তবে অপরাধী চক্র, সশস্ত্র গোষ্ঠী কিংবা চরমপন্থিরা সুযোগ নেয়। তারা নিজেদের মতো করে ‘ন্যায়বিচার’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে, যা শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের জীবনে ভয়াবহ দুর্ভোগ ডেকে আনে। অনেক দেশে দেখা গেছে, ফ্যাসিবাদ পতনের পর শক্তিশালী বিপ্লবী সরকার গঠিত না হওয়ায় দেশ গৃহযুদ্ধ, মিলিশিয়া শাসন কিংবা দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতার দিকে ধাবিত হয়েছে।

ষষ্ঠ ক্ষতিটি হলো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাষ্ট্রের অবস্থান দুর্বল হয়ে যাওয়া। একটি বিপ্লবী মুহূর্তে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো খুব সতর্কভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে। যদি তারা দেখে বিপ্লবের পর কোনো সুসংহত সরকার নেই, তবে তারা নিজেদের স্বার্থে বিভিন্ন পক্ষকে সমর্থন দিতে শুরু করে। এতে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়ে। বিপ্লবী সরকার না থাকলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাষ্ট্র তার অবস্থান পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতে পারে না, ফলে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, কূটনৈতিক চাপ কিংবা পরোক্ষ হস্তক্ষেপের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।

সপ্তমত, ন্যায়বিচারের প্রশ্নটি ঝুলে থাকে। ফ্যাসিবাদী শাসনে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম, খুন, দুর্নীতি ও লুটপাটের বিচার জনগণের অন্যতম প্রধান দাবি থাকে। বিপ্লবোত্তর সরকার ছাড়া এই বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা প্রায় অসম্ভব। বিচারহীনতা চলতে থাকলে একদিকে যেমন ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পায় না, অন্যদিকে অপরাধীরা নতুনভাবে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পায়। এতে রাষ্ট্রে একটি ভয়ংকর বার্তা যায়-ক্ষমতাবান হলে অপরাধ করেও পার পাওয়া যায়।

অষ্টম ক্ষতি হলো রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে অনিয়ন্ত্রিত দ্বন্দ্ব। বিপ্লবের সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও আদর্শিক গোষ্ঠী একত্রিত হয় একটি অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে। কিন্তু বিপ্লবের পর যদি কোনো গ্রহণযোগ্য সরকার না থাকে, তবে এই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। কে নেতৃত্ব দেবে, কার আদর্শ রাষ্ট্র পরিচালনার ভিত্তি হবে-এই প্রশ্নগুলো সংঘাতে রূপ নেয়। একটি বিপ্লবী সরকার এই দ্বন্দ্বগুলোকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমাধান করার সুযোগ তৈরি করে। তা না হলে দ্বন্দ্ব সহিংসতায় রূপ নিতে পারে।

নবমত, অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি হয়। বিপ্লবের সময় অর্থনীতি সাধারণত চাপে থাকে। উৎপাদন ব্যাহত হয়, বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় একটি বিপ্লবী সরকারের দায়িত্ব থাকে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করা, জনগণের ন্যূনতম চাহিদা নিশ্চিত করা এবং ভবিষ্যৎ উন্নয়নের রূপরেখা দেওয়া। সরকার না থাকলে বা অকার্যকর হলে মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব ও দারিদ্র্য বেড়ে যায়। এতে বিপ্লবের প্রতি সাধারণ মানুষের বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়।

দশম ক্ষতি হলো সাংবিধানিক শূন্যতা। ফ্যাসিবাদী শাসন সাধারণত সংবিধানকে বিকৃত বা অকার্যকর করে তোলে। বিপ্লবের পর একটি অন্তর্বর্তী বা বিপ্লবী সরকারের কাজ হলো নতুন সাংবিধানিক কাঠামোর দিকে যাত্রা শুরু করা। এই প্রক্রিয়া না থাকলে রাষ্ট্র দীর্ঘদিন আইনি অনিশ্চয়তায় ভোগে। কোন আইন কার্যকর, কোন কর্তৃপক্ষ বৈধ-এই প্রশ্নগুলো অস্পষ্ট থেকে যায়, যা রাষ্ট্র পরিচালনাকে জটিল করে তোলে।

একাদশত, বিপ্লবের নেতৃত্বের নৈতিক দায়বদ্ধতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। যারা জনগণকে বিপ্লবে আহ্বান জানায়, তাদের ওপর একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব বর্তায়-বিপ্লবের ফলকে রক্ষা করা। বিপ্লবী সরকার গঠন না করে যদি নেতৃত্ব দায়িত্ব এড়িয়ে যায় বা দ্বিধাগ্রস্ত থাকে, তবে ইতিহাসের কাঠগড়ায় তাদের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে পড়ে। এতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে বিপ্লবী রাজনীতির বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন হয়।

দ্বাদশত, ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থানের ঝুঁকি থেকেই যায়। ইতিহাসের নির্মম সত্য হলো-ফ্যাসিবাদ পরাজিত হয় ঠিকই, কিন্তু ধ্বংস হয় না যদি তার সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি ভেঙে ফেলা না যায়। বিপ্লবী সরকার ছাড়া এই ভিত্তি ভাঙার কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কিছু সময় পর সেই শক্তিগুলো নতুন নামে, নতুন মুখে আবার ফিরে আসে এবং জনগণকে আরও কঠিন দমননীতির মুখে ঠেলে দেয়।

সবশেষে বলা যায়, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিপ্লব কেবল ক্ষমতা পরিবর্তনের ঘটনা নয়, এটি একটি রাষ্ট্র ও সমাজকে পুনর্গঠনের ঐতিহাসিক সুযোগ। এই সুযোগ তখনই বাস্তব রূপ পায়, যখন বিপ্লবোত্তর সময়ে একটি সুসংগঠিত, দায়িত্বশীল ও জনআকাঙ্ক্ষাভিত্তিক বিপ্লবী সরকার গঠিত হয়। তা না হলে বিপ্লব তার নিজের সন্তানকেই গ্রাস করে, আর জনগণ আবারও এক অনিশ্চিত, অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে যায়। ইতিহাস এই শিক্ষা বহুবার দিয়েছে-প্রশ্ন হলো, আমরা তা শিখতে প্রস্তুত কি না।

আবুল কালাম আজাদ যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ও কলামিস্টcolumnistazad@gmail.com

এমআরএম/এএসএম