মতামত

দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রীকে বিদায়ী সালাম

সাধারণ একজন গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে আসা দেশের প্রথম ও তিনবারের নারী প্রধানমন্ত্রী গতকাল ৩০ ডিসেম্বর ভোর ৬টায় ঢাকায় ইন্তেকাল করেছেন। দিনটি দেশের ইতিহাসে এক শোকাবহ দিন। গণতন্ত্রের মা হিসেবে পরিচিত, বাংলাদেশের প্রথম ও তিনবারের নারী প্রধানমন্ত্রী আর নেই এটিই বাস্তবতা। তাঁর মৃত্যু শুধু একজন সাবেক জনদরদি, আপোসহীন সরকারপ্রধানের বিদায় বার্তা জানিয়েছে। এটি একটি যুগের অবসান, একটি রাজনৈতিক অধ্যায়ের সমাপ্তি এবং এদেশের লাখো-কোটি মানুষের আবেগ, স্মৃতি ও সংগ্রামের ইতিহাসের পরিসমাপ্তি।

পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতির কঠিন দেয়াল ভেঙে যিনি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেছিলেন, তাঁর সেই যাত্রা ছিল রক্ত, অশ্রু ও প্রতিকূলতায় ভরা। ব্যক্তিগত জীবনের গভীর ট্র্যাজেডি, দীর্ঘ নির্বাসন ও রাজনৈতিক নিপীড়নের মধ্য দিয়েই তিনি রাজনীতির ময়দানে অবিচল ছিলেন। ক্ষমতার লোভ নয়, বরং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের প্রত্যয়ই তাঁকে বারবার রাজপথে ফিরিয়েছে। এই বিশ্বাস তাঁর অনুসারীদের হৃদয়ে গভীরভাবে প্রোথিত।

তিনবারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার ভার কাঁধে নিয়েছেন সংকটময় সময়ে। সামরিক শাসন-উত্তর গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বহুদলীয় রাজনীতির পথ সুগম করা এবং সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ইতিহাসে আলাদা করে চিহ্নিত থাকবে। সে কারণেই সমর্থকরা তাঁকে ‘গণতন্ত্রের মা’ বলে অভিহিত করেছেন। যিনি বারবার ভোটাধিকার, সংসদীয় রাজনীতি ও জনগণের শাসনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।

এই বিদায় আমাদের দেশের জন্য একটি বিশেষ অর্জনকে স্মরণ করিয়ে দেয়। বাংলাদেশের মতো সমাজে একজন নারী তিনবার রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন, এটি নিজেই একটি ইতিহাস। সমালোচনা, বিতর্ক ও ভিন্নমত সত্ত্বেও এই সত্য অস্বীকার করা যায় না যে তিনি নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের একটি শক্তিশালী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

তাঁর শাসনামলে দেশ পেয়েছে দৃশ্যমান উন্নয়ন ও সামাজিক অগ্রগতি। অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারী ক্ষমতায়ন এবং দারিদ্র্য বিমোচনে নানা উদ্যোগ দেশের সামাজিক মানচিত্রে পরিবর্তন এনেছে। বিশেষ করে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে তাঁর ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক। তাঁর পথচলা অসংখ্য নারীকে সাহস দিয়েছে। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন রাষ্ট্রক্ষমতা একজন সাধারণ নারীর জন্য অযোগ্য নয় বরং নারীর নেতৃত্বেও রাষ্ট্র এগোতে পারে।

তবে তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের মূল্যায়ন একমাত্রিক নয়। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, রাজনৈতিক মেরুকরণ, নির্বাচন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে বিতর্কও ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে। তিনি যেমন প্রশংসিত হয়েছেন দৃঢ় নেতৃত্বের জন্য, তেমনি সমালোচিত হয়েছেন কঠোর শাসনব্যবস্থার অভিযোগে। ইতিহাস তাঁকে বিচার করবে অর্জন ও বিতর্ক এই দুইয়ের আলোতেই।

আজ তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত শুধু একটি দল নয়, শোকাহত একটি সময়, সমাজ ও দেশ। রাজনীতির কোলাহল ছাপিয়ে আজ মানুষ স্মরণ করছে একজন সংগ্রামী নারীকে, যিনি জীবনের বড় অংশ উৎসর্গ করেছিলেন রাষ্ট্র ও রাজনীতির জন্য। ক্ষমতা এসেছে, ক্ষমতা গেছে; কিন্তু

গণতন্ত্রের জন্য তাঁর সংগ্রাম তাঁকে ইতিহাসে বাঁচিয়ে রাখবে।গণতন্ত্রের মা আজ নেই, কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার, সংগ্রাম, সাহস ও রাজনৈতিক প্রত্যয় যা বাংলাদেশের ইতিহাসে দীর্ঘদিন আলোচিত থাকবে। এই বিদায়ের মধ্য দিয়ে জাতি হারাল এক বিতর্কিত হলেও অবিসংবাদিত প্রভাবশালী অধ্যায়কে। আজ নীরব শ্রদ্ধায় জাতি তাঁর প্রতি শেষ বিদায় জানাচ্ছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কিছু বিদায় আছে, যা কেবল ক্ষমতার পালাবদলই করে না, তা সময়ের সাক্ষ্য, রাষ্ট্রের বিবর্তন এবং সমাজের মানসিক রূপান্তরের প্রতীক। “বাংলাদেশের প্রথম ও তিনবারের নারী প্রধানমন্ত্রীর বিদায়” তেমনই এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। এই বিদায় এক নারীর ব্যক্তিগত সংগ্রাম থেকে রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রে উঠে আসার দীর্ঘ যাত্রার পরিসমাপ্তি; একই সঙ্গে এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি অধ্যায় বন্ধ হওয়ার সংকেত।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতি ছিল প্রবলভাবে পুরুষতান্ত্রিক। সেই বাস্তবতায় একজন নারী যিনি প্রথমবারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন, তা ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা। শুধু নারী হওয়াই নয়, প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশ, দলীয় ভাঙন, সামরিক হস্তক্ষেপ-উত্তর অনিশ্চয়তা, সবকিছু মিলিয়ে নেতৃত্বের সেই শুরু ছিল কঠিন। প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ নারীর সক্ষমতা নিয়ে প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল এবং রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিল।

তিনবারের প্রধানমন্ত্রী হওয়া কোনো কাকতালীয় নয়; এটি ধারাবাহিক রাজনৈতিক লড়াই, দল গঠন ও নির্বাচনি বৈধতা অর্জনের ফল। দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার অর্থ কেবল নীতি নির্ধারণ নয় বরং রাষ্ট্রযন্ত্রের গভীরে প্রভাব বিস্তার, উন্নয়ন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন এবং বৈশ্বিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থান নির্ধারণ। এই সময়ে অবকাঠামো উন্নয়ন, দারিদ্র্য হ্রাস, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, নারীশিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে অগ্রগতির মতো ইতিবাচক অর্জন সামনে এসেছে। উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতা অনেকের কাছে তাঁকে ‘স্থিতিশীলতার প্রতীক’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।কিন্তু ক্ষমতার দীর্ঘস্থায়িত্বের সঙ্গে সঙ্গে সমালোচনাও বেড়েছে। গণতান্ত্রিক চর্চা, নির্বাচন ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা, বিরোধী দলের রাজনৈতিক পরিসর, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, এসব প্রশ্ন সময়ের সঙ্গে আরও তীব্র হয়েছে। সমর্থকদের যুক্তি ছিল, উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার জন্য শক্ত নেতৃত্ব প্রয়োজন; সমালোচকদের মতে, সেই শক্ত নেতৃত্ব ধীরে ধীরে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার জন্ম দিয়েছে। এই দ্বন্দ্বই তাঁর শাসনামলের সবচেয়ে বড় বিতর্ক।

নারী নেতৃত্বের প্রশ্নে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। স্থানীয় সরকারে নারী প্রতিনিধিত্ব, সংসদে সংরক্ষিত আসন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে নারীর অগ্রাধিকার, এসব উদ্যোগ নারীর দৃশ্যমানতা বাড়িয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ ও পোশাকশিল্পে কর্মসংস্থান নারী ক্ষমতায়নের বাস্তব উদাহরণ। তবে একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়া কি স্বয়ংক্রিয়ভাবে নারীবান্ধব রাজনীতির নিশ্চয়তা দেয়? নাকি ক্ষমতার কাঠামোই শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নির্ধারণ করে? এই প্রশ্নের উত্তর একক নয়, বরং বহুস্তরবিশিষ্ট।

তিনবারের প্রধানমন্ত্রিত্বের পথে সংকটও কম আসেনি। রাজনৈতিক সহিংসতা, আন্দোলন-দমন, প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক, এসব ঘটনা রাষ্ট্র পরিচালনার কঠিন বাস্তবতাকে সামনে এনেছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মানদণ্ড নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আবার একই সময়ে উন্নয়ন সূচকে অগ্রগতি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সক্ষমতা এবং বৈদেশিক সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষার প্রশংসাও এসেছে। এই বৈপরীত্যই তাঁকে এক জটিল রাজনৈতিক চরিত্রে পরিণত করেছে। যেখানে অর্জন ও বিতর্ক পাশাপাশি অবস্থান করে।

বিদায়ের মুহূর্তে তাই মূল্যায়ন সহজ নয়। ইতিহাস কাউকে একরৈখিকভাবে বিচার করে না। অবকাঠামোর দৃশ্যমান উন্নয়ন যেমন : ইতিহাসে থাকবে, তেমনি রাজনৈতিক মেরুকরণ ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার প্রশ্নও উপেক্ষিত হবে না। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তাঁর উত্তরাধিকার গঠিত হবে এই দুই ধারার সমন্বয়ে।

আজ মরহুমা বেগম খালেদা জিয়ার এই বিদায় আরেকটি বড় প্রশ্ন সামনে এনেছে। তা হলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতির ভবিষ্যৎ। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা নেতৃত্বের বিদায়ে দল ও রাষ্ট্র কতটা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রস্তুত, তা একটি বড় পরীক্ষা। নেতৃত্ব বিকাশ, দলীয় গণতন্ত্র ও জবাবদিহি, এসব বিষয় ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য নির্ধারক হয়ে উঠবে। প্রথম ও তিনবারের নারী প্রধানমন্ত্রীর বিদায় তাই কেবল অতীতের হিসাব না করে এটি নতুন ভবিষ্যতের রূপরেখা আঁকারও সুযোগ করে দেবে বলে বিশ্লেষকগণ মনে করছেন।

সবশেষে, এই বিদায় আমাদের দেশের জন্য একটি বিশেষ অর্জনকে স্মরণ করিয়ে দেয়। বাংলাদেশের মতো সমাজে একজন নারী তিনবার রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন, এটি নিজেই একটি ইতিহাস। সমালোচনা, বিতর্ক ও ভিন্নমত সত্ত্বেও এই সত্য অস্বীকার করা যায় না যে তিনি নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের একটি শক্তিশালী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

মানুষের জীবন ও ক্ষমতা ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু ইতিহাস দীর্ঘস্থায়ী। বাংলাদেশের প্রথম ও তিনবারের নারী প্রধানমন্ত্রীর বিদায় সেই ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে অনেক গৌরবগাথা লিখে গণতন্ত্রের মা মরহুমা বেগম খালেদা জিয়ার একটি বড় অধ্যায় বন্ধ হয়ে গেল। এখন দায়িত্ব বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের এই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও মানবিক রাজনীতির মধ্যে নতুন ভারসাম্য গড়ে তোলা। তবে চিরবিদায়ের পর এখন তাঁর জন্য দেবার কিছুই নেই। আছে শুধু একটি জিনিস। সেটা হলো, আমরা সবাই তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে দোয়া করি, তিনি যেন জান্নাতুল ফেরদৌসের উচ্চতর মকামে অবস্থান করার সুযোগ পান।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। fakrul@ru.ac.bd

এইচআর/এএসএম