মতামত

বিএনপি আবার দুর্নীতির দুর্গন্ধেই ডুব দিলো!

বিএনপি নেতা বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষিত হতে যাচ্ছে ৮ ফেব্রুয়ারি- এটা একটি পুরোনো খবর এবং এই খবরকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যেই দেশে-বিদেশে দলটি তাদের নানাবিধ তৎপরতা শুরু করেছে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের রাজনৈতিক কৌশলে ক্ষমতায় থাকতে ও যেতে সুবিধানুযায়ী কৌশল গ্রহণ করবে এটাই স্বাভাবিক।

প্রশ্ন ওঠে তখনই যখন ক্ষমতায় যেতে বা টিকে থাকতে রাজনৈতিক দলগুলো সন্ত্রাস, অচলাবস্থা এবং ক্ষমতা বা বিচারবিভাগকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক কৌশলগুলোকে বাস্তবায়ন করে বা করার চেষ্টা করে। বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনছে যে, বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট সরকার বেগম জিয়াকে শাস্তি দিতে চাইছে। আর সরকার বলছে, বিচার বিভাগকে কোনো ভাবেই প্রভাবিত করা হয়নি, কারণ দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর যাবত মামলা চলার পর সেই মামলাকে কোনো ভাবেই প্রভাব বিস্তার করে দ্রুততার সঙ্গে রায় দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগের কোনো ভিত্তি আসলে নেই।

আমরা গণমাধ্যমকর্মীরা জানি যে, বেগম জিয়া এই মামলায় প্রায় ১৫০ বারেরও বেশি তারিখ পরিবর্তন করেছেন। আদালত পরিবর্তন, বিচারক পরিবর্তন, উচ্চ আদালতে মামলা স্থগিত/স্থানান্তর/খারিজের আবেদনসহ এমন কোনো চেষ্টা নেই যে বেগম জিয়ার পক্ষের আইনজীবীরা করেননি। শেষাবধি তারা রাজনৈতিক অজুহাত তুলছেন, যা বাংলাদেশের যে কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এমনকি এরশাদের মতো স্বৈরশাসককেও রাজনৈতিক বিবেচনায় শাস্তি দেওয়া হচ্ছে বলে তার পক্ষের আইনজীবীরা এক সময় বলতেন। একথাও সত্য যে বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিবেচনায় যে মামলা/বিচার চলে বা খারিজ হয়ে যায়, প্রতিটি সরকারের আমলেই এরকমটি হতে দেখা গেছে।

আগেই বলেছি, রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে বিচার বিভাগকে ব্যাবহারের নজিরও আমরা দেখেছি। কিন্তু আবারও সেই প্রশ্নটি করতে হচ্ছে যে, বেগম জিয়ার এই মামলার ক্ষেত্রে কি সেরকম কোনো কিছু হয়েছে কিনা? বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে আরো অনেক মামলা ছিল যেগুলো এখনও চলছে এবং ভৈরব সেতুতে দুর্নীতি বিষয়ক মামলাটি ইতোমধ্যেই খারিজ হয়ে গেছে। এমনকি বেগম জিয়াকে ঘুষ দেওয়ার মামলাগুলো আদালত আমলেই নেয়নি। কিন্তু জিয়া অর্ফানেজ ও চ্যারিটেবল ট্রাস্টের দুর্নীতির মামলা দু’টি কেন আদালত আমলে নিলো সে বিষয়ে ইতোমধ্যেই আমরা জেনেছি যে, এই মামলায় বিচারিক আদালতে উপস্থাপনের মতো যথেষ্ট প্রমাণাদি ছিল বলেই মামলা দু’টি এতোদিন ধরে চলতে পেরেছে এবং শেষাবধি জিয়া অর্ফানেজ ট্রাস্টের দুর্নীতি মামলাটি একটি রায়ের উপান্তে এসে পৌঁছেছে।

এখানে কোনো ভাবেই রাজনৈতিক প্রভাবে কিছু করা হয়েছে বলে মনে করেন না এমন মানুষের সংখ্যা যেমন আছে তেমনই এমন মানুষও এদেশে পাওয়া যাবে যে, যারা মনে করেন, একজন সরকার-প্রধান চাইলে এর চেয়েও বড় দুর্নীতি করতে পারেন বা পারতেন, বেগম জিয়াতো সেটা করেননি, তাহলে তাকে শাস্তি দেওয়া হবে কেন?

এই যে ক্ষমতাবান কাউকে ছাড় দেওয়া এবং জনগণের একাংশের মনে সামান্য ক’টি টাকা নয়-ছয় করার বিষয়টি কোনো বিষয়ই নয়- বাংলাদেশকে এই সংস্কৃতি থেকে বের করে আনার যে নতুন ট্রেন্ড (যুদ্ধাপরাধী রাঘব-বোয়াল ও ক্ষমতাবানদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসা ও বিচার কার্যকর করার ভেতর দিয়ে প্রতিষ্ঠিত) শুরু হয়েছে তার সঙ্গে সম্পূর্ণ ভাবে সাংঘর্ষিক। যে যতটুকু অন্যায় করেছে ততটুকু শাস্তি তাকে ভোগ করতেই হবে, এক চুল কমও নয়, এক চুল বেশিও নয়।

মজার ব্যাপার হলো আইন বিশেষজ্ঞরাই যখন দলীয় অবস্থান থেকে ট্রাস্টের টাকা ব্যক্তিগত ভাবে উত্তোলন ও ব্যক্তিগত নামে জমি কেনার জন্য ব্যয় করাকে বৈধ মনে করেন এবং সেটা টেলিভিশনে লাখ লাখ দর্শকের সামনে উচ্চকণ্ঠে প্রচার করেন তখন আসলে এদেশের মানুষের মনে নতুন সন্দেহ তৈরি হয়, তাহলে কি সরকার সত্যি সত্যিই বেগম জিয়াকে রাজনৈতিক বিবেচনায় শাস্তি দিচ্ছে? কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তরে এ কথাটিই দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে হয় যে, কোনো ভাবেই ট্রাস্টের টাকা ব্যক্তিগত ভাবে ব্যবহারে কোনো সুযোগ নেই, ট্রাস্টিদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তেও ব্যক্তিগত কারো নামে ট্রাস্টের টাকা দিয়ে জমি কেনাকে বৈধ করা যাবে না।

হতে পারে যে, বেগম জিয়ার দুই পুত্র যাদের নামে জমি কেনা হয়েছে তাদেরকে এতিম/অসহায় মনে করেন কেউ কেউ এবং তার কারণেই তাদের নামে জমি ক্রয়কে বৈধতা দিতে চাইছেন, কিন্তু সেটাও কতটুকু বৈধ তা বিচারের জন্য আপনাকে একটু দলীয় মতের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে এবং দুর্নীতির কোনো কম/বেশি মাপযন্ত্র যে নেই সেটাও বুঝতে হবে। যে অর্ফানেজ ট্রাস্টের কোনো ঠিকানা নেই, নেই কোনো ভবন/অফিস, আছে কেবল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সেই ট্রাস্টের নামে বিদেশ থেকে টাকা এসেছে এবং সেই টাকা তুলে নিয়ে একাধিকবার ব্যবহার করার প্রমাণ থাকার পরেও যারা মনে করেন এক্ষেত্রে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি তারা যে দোষে সরকারকে দায়ী করছেন সেই একই রাজনৈতিক অন্ধত্বের দোষে দোষী কিনা সেটা নির্ণয় করবে কে?

তবে লক্ষ্যণীয় যে, বিএনপি বা তাদের জোটভুক্ত রাজনৈতিক দলগুলো এরই মধ্যে ধরেই নিয়েছে যে, ৮ ফেব্রুয়ারি বেগম জিয়াকে শাস্তি পেতেই হচ্ছে। আর শাস্তি পেলে এক দিনের জন্য হলেও হয়তো তাকে জেলেও যেতে হতে পারে, এরকমটিও কেউ কেউ বলতে শুরু করেছেন। যদি সম্পূর্ণ বিষয়টি বিজ্ঞ আদালতের এখতিয়ারভুক্ত। কিন্তু এদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিষয়টিকে আদালত থেকে টেনেটুনে রাজপথে নামানোর চেষ্টায় যে প্রায় সফল হয়েছেন সেটা এতোই দৃষ্টিকটু ভাবে লক্ষ্যমান যে মাঝে মাঝে মনে হয় কবে এদেশে আইন-আদালতকে রাজনীতি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে? রাজনৈতিক প্রস্তুতি হিসেবে এক্ষেত্রে বিএনপি যে কাজটি এরই মধ্যে করেছে তা আসলে দলটির ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে, যদি তারা আদৌ ভবিষ্যতে রাজনৈতিক দল হিসেবে এদেশে থাকতে চায় আর কি।

হঠাৎই বাংলাদেশের সবচেয়ে পরিচিত বাম-পরিবারের বিএনপি-নেতা নজরুল ইসলাম খান নির্বাচন কমিশনে গিয়ে বিএনপি’র সংশোধিত একটি গঠনতন্ত্র জমা দিয়ে এসেছেন, জানা গেলো যে, সেখানে বিএনপি’র গঠনতন্ত্রের সবচেয়ে ভালো বলে বিবেচিত যে প্রস্তাবনা সেই ৭(ঘ) ধারাটি তুলে দেওয়া হয়েছে, যেখানে দুর্নীতিবাজ বা সামাজিক ভাবে নিন্দিত কোনো ব্যক্তিকে দলটির সদস্যপদে বা নির্বাচনে মনোনয়ন দেবে না বলে দলটি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। জেনারেল জিয়া তার সকল সেনা-ক্ষমতা, রাষ্ট্রীয়-ক্ষমতা এবং অবৈধ অর্থ ব্যবহার করে একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেও নিজেকে ‘নির্দোষ দুর্নীতিবাজ’ ইমেজের নেতা বলে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন এদেশের আওয়ামী-বিরোধী বর্ণান্ধ বুদ্ধিজীবী/সাংবাদিক/রাজনীতিবিদ/এনজিওবিদদের কারণে। কিন্তু তার স্ত্রীর নেতৃত্বে সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকে জেনারেল জিয়ার পুত্রদ্বয়ের সম্পদ-সম্পত্তি যে ভাবে বেড়েছে তাতে আলাদিনের চেরাগের দৈত্যটিও ভয়ে মুর্ছা যাওয়ার কথা এ কারণে যে, তারও এই ক্ষমতা নেই মানুষকে রাতারাতি এতো ধনবান করে দেওয়ার ক্ষেত্রে।

২০০১-২০০৬ সালের শাসনামলে বিএনপি-জামায়াতের দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশকে পাঁচবারেরও বেশিবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হতে হয়েছে। রাষ্ট্রের কাছে কালোটাকা ও তাদের মালিকগণ সাধারণ মানুষের জীবনের চেয়েও অত্যধিক মূল্যবান ছিল। বাংলাদেশে এখনও দুর্নীতি হচ্ছে এবং রাষ্ট্র চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আইন করে, শাস্তি দিয়ে সেটা বন্ধ করার কিন্তু একটি রাজনৈতিক দল যারা কিনা একাধিকবার দেশ চালিয়েছে এবং আগামীতেও ক্ষমতায় যেতে আগ্রহী তারা যদি দুর্নীতি-বিরোধী অবস্থান থেকে সরে যায় তাহলে মানুষ যে রাজনীতির প্রতি আস্থা হারিয়েছে সেটা আর কোনোদিনও ফিরে আসবে কি? আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় মনে হচ্ছে, বিএনপি এটাই চাইছে, বিএনপি’র জনক যেমন রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের জন্য কঠিন করে তোলার ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং করেওছিলেন সেরকম বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন ঘটানোর সকল পথ উন্মুক্ত করে দিয়ে এদেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের কাছ থেকে রাজনীতিকে কেড়ে নিতে চাইছেন। কারণ এর পরে আর কোনো সাধারণ মানুষের বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলে না থাকবে কোনো অবস্থান, না থাকবে অংশগ্রহণ, দুর্নীতির মাধ্যমে কাড়ি কাড়ি টাকা/ক্ষমতা যারা অর্জন করতে পারবেন তারাই কেবল দলটির সদস্য বা নেতা হতে পারবেন, বাকি সবাই তাদের দয়ায় এদেশে টিকে থাকবে আর কি!

হয়তো অনেকেই বলবেন যে, এটা বিএনপিকে টিকিয়ে রাখার একটি কৌশল, যাতে বিএনপি নেতৃত্বের (বেগম জিয়া ও তারেক জিয়া) দুর্নীতির দায়ে শাস্তি হলেও দলটিতে তাদের নেতৃত্বকে টিকিয়ে রাখা যায়। যদি এটাই সত্য হয় (এটাই যে সত্য সে কথা আর বিএনপি’র নেতারা গোপন রাখছেন না) তাহলে বিএনপি এতোদিন যে বুলি ছেড়েছে ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ’, তা আর ধোপে টেকে না এবং একটাই সত্য প্রতিষ্ঠিত হয় যে, বিএনপি-টিএনপি বলে আর কিছু নেই এদেশে এদেশে কেবল জেনারেল জিয়ার স্ত্রী, পুত্র ও পৌত্রাদিই সত্য, এর বাইরে সকলই মিথ্যে, সকলই ভ্রম। দুর্নীতি মামলাকে রাজনৈতিক মামলা বলে একদিকে জনগণের সমর্থন চেয়ে অপরদিকে দলীয় গঠনতন্ত্র থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদকে বাদ দিয়ে বিএনপি নামক দলটি আবার দুর্নীতির দুর্গন্ধেই ডুব দিলো। সুখের কথা হলো, বাংলাদেশের মানুষ তাদের রাজনৈতিক অধিকারবোধের ক্ষেত্রে অনেকটাই সচেতন হয়েছে, কোনো বিশেষ পরিবারের স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি আর ক্ষমতার অপব্যবহারের কাছে তারা আর জিম্মি থাকতে চাইবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে, তা সে যে পরিবারই হোক না কেন। ঢাকা ৩০ জানুয়ারি, মঙ্গলবার ২০১৮

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। masuda.bhatti@gmail.com

এইচআর/পিআর