সিজারের সময় গর্ভের শিশুকে কেটে দুই খণ্ড করার ঘটনায় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের চিকিৎসার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে যদি এই অবস্থা হয় তা হলে অন্যান্য হাসপাতালে কী অবস্থা হবে। একইসঙ্গে ডাক্তারের কাছে যদি রোগী নিরাপদ না হয় রোগী কোথায় পাবে নিরাপত্তা এমন প্রশ্নও করেছেন হাইকোর্ট।
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক প্রসূতির গর্ভের শিশুকে দ্বিখণ্ডিত করে জরায়ু কেটে ফেলার ঘটনায় আদালতের শুনানিতে বিবাদীদের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরুকে উদ্দেশ্য করে এমন প্রশ্ন তোলেন আদালত।
আদালত আরও বলেন, আপনি শিশুকে কেটে ফেলার ছবি দেখেছেন। জবাবে আব্দুল মতিন খসরু বলেন কোথায় ছবি। তখন ছবিটি বের করে দেখতে বলেন। মতিন খসরু ছবি দেখেন।
কুমিল্লার সিভিল সার্জন, কুমিল্লা মেডিকেলের পরিচালকসহ অস্ত্রোপচারকারী পাঁচ চিকিৎসক বুধবার আদালতের তলবে হাজির হওয়ার পর তাদের পক্ষে দেয়া ব্যাখ্যা শুনেন হাইকোর্ট।
আদালতের আদেশ অনুযায়ী বুধবার কুমিল্লার সিভিল সার্জন আব্দুল মজিদ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. স্বপন কুমার অধিকারী, গাইনি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. করুনা রানী কর্মকার, ডা. নাসরিন আক্তার পপি, ডা. জানিবুল হক, ডা. দিলরুবা শারমিন ও ডা. আয়েশা আফরোজ আদালতে হাজির হন। এরপর ঘটনার বিষয়ে শুনানি হয়। আদালতে ভুক্তভোগী নারীর পক্ষে শুনানি করেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শেগুফতা তাবাসসুম। চিকিৎসকদের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আবদুল মতিন খসরু। হাসপতালের পরিচালকের পক্ষে ছিলেন এ কে এম কামরুজ্জামান মামুন ও হালিমা খাতুন কনা। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অরবিন্দ কুমার রায়।
আইনজীবী আবদুল মতিন খসরু কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের করা একটি তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে তুলে ধরে বলেন, ওই ঘটনা তদন্ত করে কুমিল্লা মেডিকেল কর্তৃপক্ষ একটি রিপোর্ট দিয়েছেন। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, গর্ভের শিশুর মাথা আটকে গিয়ে জরায়ু ফেটে যাওয়াই প্রসূতির জীবন রক্ষার স্বার্থেই চিকিৎসকরা শিশুর মাথা ও জরায়ু কেটেছে।
তখন আদালত বলেন, এটাই ইনকুয়ারি (তদন্ত) করতে চাই।
তবে এরপর আইন ও সালিশ কেন্দ্রের আইনজীবী শেগুফতা তাবাসসুম আদালতকে বলেন, ঘটনার আগে করা এক আল্ট্রাসনোগ্রাফে দেখা যায়, গর্ভের শিশুর স্বাভাবিক মুভমেন্ট ও অবস্থা ছিল।
এ সময় আদালত বলেন, ‘যেহেতু ওই ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদনটি ওই মেডিকেলেরই তিনজন ডাক্তার করেছেন। সেহেতু আমরা চাচ্ছি বাইরে কাউকে দিয়ে করা একটি তদন্ত প্রতিবেদন আসুক। আমরা সেটা দেখি।’
এ পযার্য়ে আদালত বলেন, এখানে দুটো জিনিস এসেছে। তারা বাচ্চাটাকে নরমাললি প্রসব করানোর চেষ্টা করেছে কি না এবং আল্ট্রাসনোগ্রাম করা হয়েছিল কি-না।
মতিন খসরু বলেন, শিশু প্রসব করার আগে আল্ট্রাসনোগ্রাম করার জন্য বলা হয়েছিল কিন্তু রাতের বেলায় তা করতে পারেনি। এ পর্যায়ে আদালত প্রশ্ন তোলেন কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে যদি রাতের বেলা এই অবস্থা হয় তা হলে অন্যান্য হাসপাতালে কী অবস্থা হবে।
শুনানিতে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের আইনজীবী শেগুফতা তাবাসসুম আদালতে বলেন, অস্ত্রোপচারের আগে ১৭ মার্চ করা এক আল্ট্রাসনোগ্রামে গর্ভের শিশুকে স্বাভাবিক অবস্থায় দেখা গিয়েছিল।
শেগুফতা তাবাসসুম বলেন, শিশুটি দ্বিখণ্ডিত করার পর তাদের কাছে হাসপাতালের যেসব কাগজপত্র ছিল তারা তা কেড়ে নেয়। এখানে ছবি আছে আপনারা দেখুন। ছবিটি শিশুর বাবা সংগ্রহ করে দিয়েছিল। সেখানকার দারুয়ানের তোলা ছবি বলেও জানান আইনজীবী। এরপর আদালত দুই সদস্যবিশিষ্ট ওই তদন্ত কমিটি করে দেয়।
ঘটনা তদন্তে দুই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। তাদের একজন বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গাইনি বিভাগের প্রধান ও জাতীয় অধ্যাপক ডা. শায়লা খাতুন। কমিটির সদস্যরা তদন্তে নারীর জরায়ুসহ নবজাতকের মাথা বিছিন্ন করার কারণ খোঁজে দেখবেন। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য বলেছেন আদালত।
কুমিল্লার সিভিল সার্জন ও কুমিল্লা মেডিকেলের পরিচালকসহ অস্ত্রোপচার সংশ্লিষ্ট সাত চিকিৎসকের উপস্থিতিতে বুধবার বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন।
গত ২৫ মার্চ সিজার করার সময় এক নারীর জরায়ুসহ নবজাতকের মাথা বিছিন্ন করার ঘটনায় ‘ডাক্তার দুই খণ্ড করলেন নবজাতককে’ শিরোনামে পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেই প্রতিবেদন নজরে নিয়ে স্বঃপ্রণোদিত হয়ে কুমিল্লার সিভিল সার্জন, কুমিল্লা মেডিকেলের পরিচালক ও অপারেশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পাঁচ চিকিৎসকসহ মোট ১১ জনকে তলব করেছিলেন আদালত। সেইসঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কেন কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ হবে না- তা জানতে চেয়েও রুল জারি করেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহারিচালক, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক, কুমিল্লার সিভিল সার্জন, মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের পরিচালক, অস্ত্রোপচারে নেতৃত্বদানকারী চিকিৎসক, কুমিল্লা মেডিকেলের গাইনি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান করুণা রানী কর্মকারসহ অস্ত্রোপচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।
সিভিল সার্জন ও হাসপাতালের পরিচালকের ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দিয়ে পাঁচ চিকিৎসককে ১১ এপ্রিল হাজির হতে বলেছেন। এই সময়ের মধ্যে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে কমিটিকে। সেদিন মামলার পরবর্তী শুনানি হবে।
এফএইচ/জেডএ/এমএস