দেশজুড়ে

যশোরে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতদের আগেই ধরে নেয়ার অভিযোগ

যশোরে র‌্যাব ও পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে গত তিন দিনে ৭ জন নিহত হয়েছেন। মাদক নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর হুঁশিয়ারির পর গত শনিবার ভোরে বন্দুকযুদ্ধের প্রথম ঘটনা ঘটে। অভয়নগরের এই বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় তিনজন নিহত হন। স্থানীয়ভাবে তারা মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। রোববার ভোরেও শহরের সুজলপুর এলাকায় বন্দুকযুদ্ধে আরও এক মাদক ব্যবসায়ী নিহত হন। সর্বশেষ রোববার ভোরে শহরে পৃথক দু’টি বন্দুকযুদ্ধে তিনজন নিহত হয়েছেন। এই তিনজনও মাদক ব্যবসায়ী বলে দাবি পুলিশের। তবে আজ নিহতদের পরিচয় শনাক্ত না হলেও শনি ও রোববার নিহতদের পরিবারের দাবি তাদের আগের রাতেই ধরে নিয়ে গিয়েছিল সাদা পোশাকের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। শনিবার ভোরে অভয়নগর উপজেলার চলিশিয়া ইউনিয়নের বাগদাহ গ্রামে বন্দুকযুদ্ধে নিহতরা স্থানীয় শীর্ষ মাদক বিক্রেতা বলে দাবি করে র‌্যাব। এ সময় আহত হন র্যাবের দুই সদস্য। ঘটনাস্থল থেকে ৪শ বোতল ফেনসিডিল, দুটি পিস্তল ও ৫ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে র‌্যাব। সেদিন নিহত হন, উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের মৃত আব্দুল বারিক শেখের ছেলে হাবিবুর রহমান ওরফে হাবি শেখ (৪৪), একই গ্রামের মৃত ছত্তার কাসারীর ছেলে মিলন কাসারী (৪৩) ও তাদের প্রধান সহযোগী নাদের আলীর ছেলে আবুল (৪২)।

এরআগে ১৮ মে ভোরে এ তিনজনকেই উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের তেতুঁলতলা নূরানী হাফিজিয়া মাদরাসা এলাকা থেকে প্রশাসনের পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ ওঠে। এ ব্যাপারে তাদের পরিবারের সদস্যরা অভয়নগর থানা পুলিশ, খুলনা ও যশোর র্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও ঘটনার ব্যাপারে সবাই অস্বীকার করেন।

কিন্তু শনিবার র‌্যাব-৬ এর খুলনাস্থ কোম্পানি কমান্ডার জাহিদ জানিয়েছিলেন, তাদের একটি টহল টিম ভোরে অভয়গরের বাগদা এলাকায় নওয়াপাড়া-পায়রা সড়কে চেকপোস্ট বসায়। এ সময় তারা দুটি মোটরসাইকেলের গতিরোধ করার চেষ্টা করলে তারা র‌্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। দুর্বৃত্তদের গুলিতে দু’জন র‌্যাব সদস্য আহত হলে র্যাবও পাল্টা গুলি চালায়। এক পর্যায়ে মোটরসাইকেলের ৬ আরোহীর মধ্যে তিনজন গুলিবিদ্ধ হয় এবং বাকিরা পালিয়ে যায়। পরে গুলিবিদ্ধদের হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

এ বিষয়ে নওয়াপাড়া পৌর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিম শেখ অভিযোগ করেছেন, তার বড় ভাই হাবিবুর রহমান শেখসহ সুমন পাটোয়ারি ও আবুল কালামকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার তাদের যার যার বাড়ি থেকে সাদা পোশাকে র্যাব পরিচয়ে ধরে নেয়া হয়। এরপর কোথাও তাদের খোঁজ মেলেনি। শনিবার সকালে তাদের মৃত্যুর খবর পান পরিবারের সদস্যরা।

একইভাবে রোববার ভোরে যশোরে বন্দুকযুদ্ধে ডালিম হোসেন (৩৫) নামে এক মাদক বিক্রেতা নিহত হন। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে অস্ত্র-গুলি এবং ৫শ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। যশোর সদর উপজেলার রঘুরামপুর গ্রাম থেকে ওই মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ১৫-১৬ জনের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি মডেল থানায় পৃথক দুটি মামলা করেছে। নিহত ডালিমের বিরুদ্ধেও অর্ধ ডজন মামলা রয়েছে বলে পুলিশ দাবি করেছে।

যশোর কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি একেএম আজমল হুদা জানান, রোববার ভোরে যশোর-ছুটিপুর সড়কের রঘুরামপুর গ্রামে দু’দল মাদক বিক্রেতা বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে এমন সংবাদ পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে মাদক ব্যবসায়ীরা পালিয়ে যায়। পরে ঘটনাস্থল থেকে মাদক ব্যবসায়ী ডালিম হোসেনের (৩৫) মরদেহ উদ্ধার করা হয়। একইসঙ্গে ঘটনাস্থল থেকে ১টি ওয়ানশুটার গান, ১ রাউন্ড গুলি, ৪টি গুলির খোসা ও ৫শ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।

কিন্তু নিহত ডালিমের চাচা মোশারফ হোসেন জানিয়েছেন, বছর দশেক আগে ডালিমের বাবা সোহরাব মারা যান। এরও আগে ডালিমের মা হালিমা খাতুন নতুন করে সংসার শুরু করেন অন্য এক যায়গায়। তখন থেকে বাবার কাছে ছিলেন ডালিম। বাবা মারা যাওয়ার পর ডালিম তার খালা বেবীর কাছে থাকতেন। প্রায় ৫ বছর আগে তিনি শহরের চাঁচড়া এলাকার একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। অতি সম্প্রতি চাঁচড়া চেকপোস্ট-পালবাড়ি সড়কের ইউনিক পাম্পের কাছে এক দারোগার বাড়িতে ভাড়া থাকতেন ডালিম। একা থাকতেন ওই বাড়িতে।

নিহতের খালা বেবী খাতুন দাবি করেন, শনিবার রাত তিনটার দিকে একদল পুলিশ সাদা পোশাকে ডালিমের ভাড়া বাড়িতে যায়। তাকে ডেকে তোলার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ হ্যান্ডকাপ পরিয়ে দেয়। পরে তাকে গাড়িতে করে অন্য স্থানে নিয়ে যায়। রাতে বোন হালিমার কাছ থেকে সংবাদ পেয়ে তিনি বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নেন। দুপুরে জানতে পারেন ডালিমের মরদেহ হাসপাতালে রয়েছে।যারা রাতে ডালিমকে নিয়ে গিয়েছিল তাদের প্রত্যেকের মাথায় হেলমেট ছিল। শুধু হ্যান্ডকাপ দেখে বাড়ির দ্বিতীয় তলার বাসিন্দারা ধারণা করে সাদা পোশাকের লোকজন পুলিশ।

এলাকার একটি সূত্র জানিয়েছে, দুই বছর আগে ডালিম ৭ হাজার পিস ইয়াবাসহ র্যাব সদস্যদের হাতে আটক হয়েছিলেন। বছর খানেক তাকে জেলে থাকতে হয়। পরে আইনজীবীর মাধ্যমে তিনি জামিনে বের হন। শংকরপুর এলাকার কুখ্যাত মাদক বিক্রেতা কাজী তারেকের সঙ্গে ডালিম মাদক কেনাবেচা করতেন। তারেক পুলিশি অভিযানে কোণঠাসা হয়ে পড়ায় আত্মগোপন করেন।

সর্বশেষ সোমবার ভোরে কথিত বন্দুকযুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনজন নিহত হয়েছেন। দুটি স্থানে এ বন্দুকযুদ্ধের পর পুলিশ মরদেহ তিনটি উদ্ধার করেছে। তবে তাদের পরিচয় এখনও জানা যায়নি। যদিও নিহতরা মাদক ব্যবসায়ী দাবি করে পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনাস্থল থেকে অস্ত্র, গুলি ও মাদকদ্রব্য পাওয়া গেছে।

যশোর কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি একেএম আজমল হুদা জানান, সোমবার রাত সাড়ে তিনটার দিকে যশোর শহরতলীর শেখহাটি ও খোলাডাঙ্গায় মাদক ব্যবসায়ীরা নিজেদের মধ্যে গোলাগুলি করছে এমন সংবাদ পায় পুলিশ। খবর পেয়ে পুলিশ ওই স্থান দুটিতে যায়। এ সময় শেখহাটির নওয়াব আলীর খেজুর বাগান নামক স্থান থেকে দুইটি মরদেহ ও ৪শ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।

একইসঙ্গে খোলাডাঙ্গা মাঠের মধ্যে থেকে এক মরদেহ ও একশ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। তবে তাদের পরিচয় জানা যায়নি বলে জানিয়েছেন ওসি। ঘটনাস্থল থেকে দুইটি পিস্তল ও গুলির খোসা পাওয়ার কথাও জানান তিনি।

মিলন রহমান/এফএ/পিআর