বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মতো এবং পঁচাত্তর-পরবর্তী সামরিক আইন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যতীত সংবিধানের ভিত্তিতে কোনো রাজনৈতিক দলের বয়কট ছাড়া সব দলের অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে আগামী ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে দেশের গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রার ইতিহাসে এই নির্বাচন বিরাট মাইলফলক।
স্বাধীন স্বদেশে ১৯৭৩ সালের প্রথম নির্বাচনও বাহাত্তরের সংবিধানের ভিত্তিতে পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক দেশের রীতি অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তারপর সুদীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে নির্বাচনসহ গণতন্ত্র ইস্যু নিয়ে নানা সময়ে রক্তাপ্লুত আন্দোলন-সংগ্রাম যেমন হয়েছে, তেমনি পরীক্ষা-নিরীক্ষাও খুব একটা কম হয়নি। কিন্তু গণতন্ত্রের সার্বজনীন রীতি অনুযায়ী না হওয়ায় তা স্থায়ী হতে পারা সম্ভব ছিল না। এই দিকটি বিবেচনায় নিয়ে বলা যায় পুনরায় নতুন করে গণতান্ত্রিক রীতি অনুযায়ী ভোটপর্ব আমাদের শুরু করতে হচ্ছে।
লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড : ১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল আমাদের প্রজন্মের দেখা এবং পাকিস্তানের প্রথম কেন্দ্রীয় নির্বাচন। গণতন্ত্রের লড়াই সংগ্রামের ভেতর দিয়ে তখন আমাদের প্রজন্মের রাজনীতিতে হাতেখড়ি হচ্ছে। জাতিও গণতন্ত্র ও ভোটের চর্চা সবে শুরু করেছে। ইয়াহিয়ার মার্শাল ল চলছে। তাতে আবার রয়েছে বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো সামরিক শাসনের লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতি নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। তখন অবশ্য এখনকার মতো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কথাটা ছিল না।
তবে তখনো এমন কথা উঠেছিল যে, সামরিক আইন ও দমনপীড়নমূলক প্রশাসন রেখে কি ৬ দফা ও ১১ দফার পক্ষে সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ ভোট আদৌ সম্ভব? ভোট দেয়া যাবে তো? সিভিল ও মিলিটারি প্রশাসন কি করবে? বলাই বাহুল্য বঙ্গবন্ধু এসব প্রশ্নটি আমলেই নেননি।
সেই দিনগুলোতে বাম রাজনীতির একজন কর্মী হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের মুখে শুনে বুঝে নিয়েছিলাম, জনগণ হচ্ছে সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। নির্বাচন কমিশন হচ্ছে তারই প্রধান অনুঘটক। নীরব-নিষ্ক্রিয়-ভীতু-অদৃঢ়প্রতিজ্ঞ জনসমর্থন নয়, বিক্ষুব্ধ-প্রতিবাদী-সাহসী-দৃঢ়প্রতিজ্ঞ জনগণই নিধারণ করে ভোট হবে কেমন? যদি মানুষ থাকে ঐক্যবদ্ধ ও জাগরিত, তবে ভোটকে ছিনতাই দুঃসাধ্য। তখন সে রকম কিছু হলে গণবিপ্লব সত্যাসন্ন হয়ে উঠবে। কথাটা সত্য প্রমাণিত হয়েছিল সত্তরের সেই ইতিহাস সৃষ্টিকারী নির্বাচনে।
পাকিস্তানি আমলা-পুলিশ-মিলিটারি, যাদের পাকিস্তানি শাসকরা প্রশিক্ষণ দিয়ে নিজেদের মতো করে গড়ে তুলেছিল তাদের স্বার্থের রক্ষক হিসেবে, তারা নির্বাচনে পাকিস্তানপন্থি দলের পক্ষে দাঁড়ায়নি বা দাঁড়াতে সাহস পায়নি, এমনকি একটা বড় অংশ ভোট দিতে সাহায্য করেছিল জয় বাংলার প্রার্থীকে। সেই দিনগুলোতেই বুঝে নিয়েছি, জনগণই ইতিহাসের ভাগ্যনিয়ন্তা। জনগণের কারো কারো সন্তান কিংবা ভাই-বোন হচ্ছেন সিভিল ও মিলিটারি আমলারা, তাই তারা শেষ পর্যন্ত জনগণের পাশেই দাঁড়ায়। অর্থাৎ বাস্তবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে জনগণ, প্রশাসন-পুলিশ-মিলিটারি কেউ নয়। সক্রিয় জনসমর্থনের পাল্লা যে দিকে থাকে ভারী, সে দিকে হেলে পড়ে নির্বাচনের মাঠ।
বলাই বাহুল্য, সত্তরের নির্বাচনের আগে ভাষা আন্দোলনের পর থেকে সুদীর্ঘ সময় ধরে লড়াই-সংগ্রাম ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে বাংলার জনগণ গড়ে তুলেছিল সত্তরের সেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড।
ক্ষুদ্র এ কলামে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সম্পর্কে বাংলাদেশ আমলের অভিজ্ঞতা এখানে আলোচনা না করে বর্তমান নির্বাচন সামনে রেখে কেবল এটুকুই বলতে হয়, নীরব-নিষ্ক্রিয়-ভীতু-দিগভ্রান্ত জনগণের সমর্থন বিএনপির ২০ দলীয় জোট ও ঐক্যফ্রন্টের দিকে আছে সত্য, কিন্তু বিক্ষুব্ধ-প্রতিবাদী-সাহসী ও দিকনির্দেশ সংবলিত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ জনগণ, যারা হচ্ছে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের নিয়ামক শক্তি, সেই ধরনের জনগণ তাদের সঙ্গে নেই।
প্রশ্নটা হলো থাকবে কেমন করে? ক্যান্টনমেন্টের শক্তিতে মিথ্যা ও বিকৃত ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়ানো দলটির ট্রেক রেকর্ড হচ্ছে আমাদের জাতিসত্তাবিরোধী। ঘাতক-দালাল জামায়াতকে দিয়েছিল রাজনীতি করতে। সবশেষে করেছিল ক্ষমতার অংশীদার। সঙ্গে ছিল হাওয়া ভবন ও খোয়াব ভবন। পরিণতিতে আসে ১/১১; দলটি তখন সক্রিয় ও প্রতিবাদী হওয়া দূরে থাক, মেরুদণ্ডহীন হয়ে পড়ে।
ভাবা যায়, দুই দুই বারের প্রধানমন্ত্রী এবং দ্বিতীয় জনসমর্থিত দলের প্রধান নেতাকে যখন জেলে নিয়ে যাওয়া হয়, তখনো দলটি গর্তে ঢুকে বসে আছে! বলাই বাহুল্য দলটি জামায়াতকে সঙ্গে নিয়েই সুকৌশলে নির্বাচনের কমবেশি এক মাস আগে ড. কামালদের সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি ও ভাবাদর্শে গোঁজামিল দিয়ে সমর্থকদের ভুলিয়ে চাঙ্গা তথা সক্রিয়-প্রতিবাদী-সাহসী করতে প্রয়াসী হয়েছিল।
কিন্তু তা কি সম্ভব? বরং ধারণা করা যায়, এতে দলটির আর সেই সঙ্গে ড. কামালদের আম-ছালা, কুল-মান সবই গেছে। এমন একটি দল বা জোটের (জোট আবার দুটো!) পেছনে সমর্থক জনগণ কখনো সক্রিয় হতে পারে না। তাই দলটি নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সৃষ্টির নিয়ামক জনগণ পাবে, এমনটা কল্পনা করা আর বোকার স্বর্গে বাস করা একই কথা।
এক কথায় বলতে হয়, ক্ষমতা কিংবা যড়যন্ত্রের অংশী হওয়া ছাড়া বিএনপি দলটি রাজনীতির মাঠে থেকে জনগণকে কখনো সক্রিয় করতে পারেনি। সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মাঠে বিএনপি দলটি খেলতে পারে না। প্রকৃত বিচারে নিজের মধ্যে যদি থাকে অসামঞ্জস্যতা, তবে সেই ব্যক্তি খেলতে পারে না।
বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনী ইশতেহারে বলছে, ‘কোনো রাষ্ট্রকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ’ করার ‘স্পেস’ দিবে না। এ কথা বলে নিজেই আবার লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড পাওয়ার জন্য ধরনা দিচ্ছে বিদেশিদের কাছে। এই দ্বিচারিতা নিয়ে নির্বাচনে সমতল মাঠ সৃষ্টির জন্য জনগণকে সঙ্গে পাওয়া যায় না। আসলে প্রবাদটাই সত্য, যারা নাচতে জানে না তারাই বলে উঠান বাঁকা।
সাম্প্রদায়িকতা : সেই সত্তরের নির্বাচনের পর স্বাধীন বাংলাদেশে জাতীয় ও স্থানীয় অনেক নির্বাচন দেখার অভিজ্ঞতা দেশবাসীর রয়েছে। এক কথায় বলা যায়, এই প্রথমবারের মতো দেখা গেল, নির্বাচনে প্রকাশ্যে কোনো সাম্প্রদায়িক প্রচারণা দেশে নেই।
১৯৭৩-এর নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানো হয়েছিল। সঙ্গে ছিল পাকিস্তানি আমলের সেই বস্তাপচা সর্বব্যাপী অন্ধ ভারত বিরোধিতা। মসজিদ থেকে উলুধ্বনি শোনা যাবে আর ফেনী পর্যন্ত ভারত হয়ে যাবে ইত্যাদি কথা, যা বলা হয়েছিল ২০০১-এর নির্বাচনের আগে, সে ধরনের কথা এখন চুপসে মাটিতে মিশে গেছে।
এবারের নির্বাচনে এমন সব প্রচারণা ভেতরে ভেতরে অপ্রকাশ্যে কি কতটুকু আছে, তা নিয়ে বাক্বিতণ্ডা থাকবেই। এখানে এটাও বলতে হয়, নির্বাচনকে ঘিরে কোথাও কোথাও কিছু কিছু সংখ্যালঘুদের ওপর নাশকতামূলক অশুভ কর্মকা-ও সংঘটিত হচ্ছে।
এতদসত্ত্বেও একটু বলা যায়, প্রকাশ্যে সংকীর্ণ ও অন্ধ ওই সব প্রচারণা বন্ধ হওয়া জাতির বড় এক অর্জন। এই অর্জন কীভাবে কার বদৌলতে হলো এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক থাকবে বিষয়টা বিবেচনায় নিয়ে বলতে হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দশ বছরের শাসনামলের ভেতর দিয়ে এই অর্জন বর্তমানে সাধিত হয়েছে। রাষ্ট্র রাজনীতি ও সমাজ জীবনের প্রকাশ্য তৎপরতায় এমন ভারসাম্য দেখতে পাওয়া যাবে, তা নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরুর পরও কল্পনা করতে পারিনি।
২০০১ সালের নির্বাচনের পর এথেনিক ক্লিনজিংয়ের ঘটনা পাথরচাপা দিয়ে জামায়াত সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও বিএনপি এখন বলছে, সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় গঠন করা হবে। যারা বলেছিল উলুধ্বনির কথা, তারা এখন আগ বাড়িয়ে বলছে মন্ত্রণালয়ের কথা!
রাজনীতিতে কত অদ্ভুত ঘটনাই ঘটে! কীভাবে কেন এমনটা হলো, তা নিয়ে আলোচনা গবেষণা যেমন প্রয়োজন তেমনি সেই অর্জনকে ধরে রাখার জন্য তৎপর হওয়া দেশপ্রেমিক কর্তব্য। প্রশ্ন হলো, এই অর্জন কি আমরা ধরে রেখে সমূলে উৎপাটিত করতে পারব? নির্বাচনের পর কি আবারো সেই স্বার্থান্বেষী মহল সাম্প্রদায়িকতার খড়গ নিয়ে মাঠে নামবে?
গৃহযুদ্ধ : সব দলের অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে এবং জনগণ যতটুকু সক্রিয় ততটুকু লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সৃষ্টির ভেতর দিয়ে যখন নির্বাচন হচ্ছে, তখন ২০ দলীয় জোটের অন্যতম প্রধান নেতা কর্নেল (অব.) অলি দিয়ে যাচ্ছেন গৃহযুদ্ধের হুঁশিয়ারি।
এ দিকে এক টকশোতে দেখলাম, ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী পঁচাত্তরের হত্যার প্রসঙ্গ টেনে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন, এটাও গৃহযুদ্ধ আহ্বানেরই নামান্তর। প্রসঙ্গত সমর্থক জনগণকে মাঠে নামতে না পেরে নির্বাচনে যারা সুবিধা করতে পারছে না, হেরে যাবে বলে স্থির নিশ্চিত, তা নানা ধরনের কথা স্বাভাবিকভাবেই বলবে। যেমন ড. কামালও বলছেন ভয়াবহ পরিণতির কথা! এমনটা বলা আর প্রকাশ্যে হত্যা কিংবা গৃহযুদ্ধের ঘোষণা দেয়া এক কথা নয়।
বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যার পর থেকে দেশি-বিদেশি কারা কীভাবে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক শাসকদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল, তা দেশবাসীর অজানা নয়। বাঙালি জাতি অনেক লড়াই করে আবারো বর্তমান সময়ের উপযোগী মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় ফিরে এসেছে।
কোনো ব্যক্তি-গোষ্ঠী-দল-মহল যদি জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে জাতিকে সেই পথ থেকে বিচ্যুত করে উল্টো পথে নিতে গৃহযুদ্ধ বাধাতে চায়, তবে তা প্রতিহত ও স্তব্ধ করার মতো যোগ্যতা ও ক্ষমতা যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির নেতৃত্ব ও জনগণের রয়েছে, তা ২০১৪/১৫ সালের ড্রেস রিহার্সেলে প্রদর্শন করা হয়েছে। ওই অভিজ্ঞতা স্মরণে রেখে ওই অনভিপ্রেত ভ্রান্ত ও রক্তাক্ত পথে কারো পা না বাড়ানোই জাতির জন্য একান্ত মঙ্গল।
সব দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে এবং সাম্প্রদায়িকতা প্রকাশ্যে না এনে গণতন্ত্রের যে অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে, সেই পথেই অগ্রসর হোক জাতির গণতন্ত্রের অভিযাত্রা। এটাই নির্বাচন সামনে রেখে বিজয়ের মাসে নতুন ইংরেজি নববর্ষ সামনে রেখে দেশবাসীর একান্ত কামনা।
লেখক : রাজনীতিক।
এইচআর/এমকেএইচ