চট্টগ্রামের ব্যাটিংবান্ধব উইকেটে ফ্রি স্ট্রোক খেলা যাচ্ছে। বল ব্যাটে আসছে। গতির পাশাপাশি বাউন্সেও মোটামুটি স্থিতি আছে। তাই ডি ভিলিয়ার্সের মত জাত স্ট্রোকমেকারের স্বচ্ছন্দ-সাবলীল খেলা সহজ হয়েছে।
তাই ভাবা হচ্ছিল সোমবার ম্যাচ জেতানো সেঞ্চুুরির পর এক গাল স্বস্তির হাসি নিয়ে জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের কনফারেন্স হলে এসে ঢুকবেন এবি ডি ভিলিয়ার্স। বসেই বলবেন, ‘আরে কি চমৎকার উইকেট! বল একটুও থেমে আসে না। উঁচু-নীচুও হয় না। সব ঠিকঠাক। ইচ্ছেমত স্ট্রোক খেলা যায়। এমন উইকেটই তো আমি চাই। কিন্তু বাংলাদেশে এসে তা পাই কই? সিলেট ও ঢাকায় পাইনি। আজ মনের মত উইকেট পেলাম, নিজের স্বাভাবিক ব্যাটিংটাও করতে পারলাম। আমি খুব খুশি। আসলে এমন ব্যাটিং ফ্রেন্ডলি উইকেটই হওয়া উচিৎ সব ভেন্যুতে তাহলে রান হবে। চার ও ছক্কার প্রদর্শনীতে মাঠ মাতবে। দর্শকরা খেলা দেখে মজা পাবেন।’
কিন্তু অবাক করা সত্য হলো, তার ধার কাছ দিয়েও গেলেন না ডি ভিলিয়ার্স। উল্টো যা বললেন, তা শুনে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা লজ্জায় ডুববেন। বাংলাদেশের অনেক বিদগ্ধ ক্রিকেট সংগঠক, কোচ ও ফ্র্যাঞ্চাইজিরাও হয়ত মুখ লুকাবেন।
প্রেস কনফারেন্সে প্রশ্ন উঠলো, ‘আচ্ছা সাগরিকার জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে প্রায় প্রতি ম্যাচে অনেক রান হচ্ছে। দর্শকরা ‘বিগ স্কোরিং গেম’ দেখে বেশ আনন্দ পাচ্ছেন। আপনার কি মনে হয় না বিপিএলের আকর্ষণ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়ানোর জন্য ঠিক এমন ব্যাটিং বান্ধব উইকেটই দরকার?’
জবাবে ডি ভিলিয়ার্স কী ব্যাখ্যা দিলেন শুনুন, ‘না না তা কেন হবে? সব পিচই যদি ব্যাটিং সহায়ক হয়, উইকেট যদি শুধুই ব্যাটসম্যানদের বন্ধু হয় তাহলে তো খেলা জমবে না। খালি বেশী রান হলেই কি আর ম্যাচ জমে? তা বরং একঘেয়ে ও বিরক্তির খোরাক হয়ে উঠবে।’
এটাই শেষ নয়। তারপর জানিয়ে দিলেন তার নিজ দেশ দক্ষিণ আফ্রিকাতেও একেক জায়গায় উইকেটের আচরণ একেকরকম, ‘আমরা বিশ্বের যেখানেই খেলি না না কেন, একেক জায়গার উইকেট একেকরকম। আমার দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার কথাই ধরুন- প্রিটোরিয়া, পোর্ট এলিজাবেথ থেকে ডারবান- সব জায়গার উইকেট সব সময় ভিন্ন আচরণ করে। সেটাই তো আসল মজা।’
তারপর যা বললেন, তা বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্মের ব্যাটসম্যানদের জন্য বিরাট বার্তা ও শিক্ষনীয় সংলাপ, ‘আসলে ক্রিকেটারদের স্কিল উন্নত করার জন্যই পৃথক কন্ডিশন ও উইকেটের আচরণগত ভিন্নতা দরকার। ভিন্ন ভিন্ন উইকেটে খেলে খেলেই নিজের স্কিল উন্নত করতে হবে। যে উইকেটে যেমন ব্যাটিং শৈলি প্রয়োজন, তেমন ব্যাটিং কৌশল রপ্ত করার পাশাপাশি পৃথক কন্ডিশনে খেলার অভ্যাসও তৈরী হবে। কখনো আপনাকে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু দ্রুত ব্যাট চালাতে হবে এবং আগ্রাসী অ্যাপ্রোচ দেখাতে হবে। আবার কোনো সময় চাপ সামলে খেলতে হবে। এটাই আসলে সত্যিকার ক্রিকেট।’
ডি ভিলিয়ার্সের ওপরের কথাকে শুধুই একটি বিচ্ছিন্ন মন্তব্য ভাবলে চরম ভুল করা হবে। বাংলাদেশে প্রায় সারা বছর উইকেট নিয়ে অনেক কথা হয়। সবাই ঘুরে ফিরে স্লো ট্র্যাকের সমালোচনা করেন। আবার ফার্স্ট ও বাউন্সি পিচে গিয়ে টাইগারদের নাভিঃশ্বাষ ওঠা দেখেও অনেক খুঁনসুঁটি হয়।
কিন্তু ডি ভিলিয়ার্স জানিয়ে দিলেন, আসলে ভিন্ন ভিন্ন উইকেটে খেলে খেলেই হাত পাকাতে হবে। কোন কন্ডিশনের অ্যাপ্রোচ, ব্যাটিং টেকনিক-শৈলি কেমন? তা জানার এবং রপ্ত করার জন্যই যে পৃথক পরিবেশ-পরিস্থিতিতে বেশী করে খেলা জরুরী।
স্লো পিচে অহেতুক জোরে মেরে, বলের ওপর চড়াও হবার অভ্যাস পাল্টানোর তাগিদ আছে ডি ভিলিয়ার্সের কথায়। আবার ফার্স্ট ও বাউন্সি ট্র্যাকে স্বাভাবিকের চেয়ে দ্রুত বডি ম্যুভমেন্ট ও বলের লাইনে যাওয়া এবং ব্যাট পেতে দেয়ার অভ্যাস তৈরীও খুব জরুরী।
বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা কি ডি ভিলিয়ার্সের পরামর্শ মেনে উইকেটের দোহাই না দিয়ে কন্ডিশন উপযোগী টেকনিক, টেম্পারামেন্ট ও অ্যাপ্রোচ রপ্ত করার চেষ্টা করবেন? না বারবার বড় ও ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলতে ব্যর্থ হয়ে সেই স্লো পিচ, ফার্স্ট ও বাউন্সি পিচের ধোঁয়া তুলে দায় এড়ানোর চেষ্টাই করে যাবেন?
এআরবি/এসএএস/এমএস