চীনে চলতি বছরের ‘দুই অধিবেশন’ শুরু হয়েছে আজ (৪ঠা মার্চ, ২০২২)। ইংরেজিতে এই ‘দুই অধিবেশন’-কে বলা হয় Two Sessions। আর চীনা ভাষায় একে ডাকা হয় ‘লিয়াংহুই’ (‘লিয়াং’ মানে ‘দুই’ এবং ‘হুই’ মানে ‘অধিবেশন’)। ভারতের রাজস্থান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়া স্টাডিজ সেন্টারের সাবেক পরিচালক কারোরি সিং চীনের ‘দুই অধিবেশন’-কে আখ্যায়িত করেছেন ‘জনতার গণতন্ত্রের প্রায়োগিক অংশ’ হিসেবে।
তিনি বলেছেন, চীনের উন্নয়ন-প্রক্রিয়ায় চলতি ‘দুই অধিবেশন’ চিহ্নিত হবে একটি মাইলফলক হিসেবে। চীন ইতোমধ্যেই সম্পূর্ণভাবে হতদারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে ও মধ্যম মানের সচ্ছল সমাজ গঠনে সফল হয়েছে। দেশটি এখন চলতি শতাব্দির মাঝামাঝি নাগাদ সম্পূর্ণ সচ্ছল ও আধুনিক সমাজে পরিণত হতে চায়।
সাধারণত প্রতিবছরের বসন্তে তথা মার্চ মাসে চীনে ‘দুই অধিবেশন’ বসে; চলে ১০ থেকে ১৪ দিন। তবে, মহামারির কারণে বিগত দু’বছর দুই অধিবেশনের ব্যাপ্তি ছিল স্প্তাহখানেক। এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না। অধিবেশন চলাকালে মহামারি-প্রতিরোধক বিশেষ ব্যবস্থা তো থাকছেই।
চীনের জাতীয় গণকংগ্রেস (এনপিসি) ও চীনা গণরাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলন (সিপিপিসিসি)-র জাতীয় কমিটির বার্ষিক অধিবেশনদুটিকেই একত্রে ডাকা হয় ‘দুই অধিবেশন’। এই ‘দুই অধিবেশন’ সাধারণত বছরে একবার আয়োজন করা হয়। সিপিপিসিসি’র অধিবেশন খানিকটা আগে শুরু হয়। এর দু-এক দিন বাদে শুরু হয় এনপিসি’র অধিবেশন। সিপিপিসিসি’র অধিবেশন এবার শুরু হয়েছে আজ এবং এনপিসি’র অধিবেশন শুরু হবে আগামীকাল (৫ই মার্চ, ২০২২)। আবার সিপিপিসিসি’র অধিবেশন শেষও হয় এনপিসি’র অধিবেশনের কয়েকদিন আগে।
এবারের ‘দুই অধিবেশন’ হচ্ছে ত্রয়োদশ এনপিসি’র পঞ্চম অধিবেশন ও সিপিপিসিসি’র ত্রয়োদশ জাতীয় কমিটির পঞ্চম অধিবেশন। বলা বাহুল্য, চীনের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এই ‘দুই অধিবেশন’-এর গুরুত্ব অপরিসীম। পাকিস্তান-চায়না ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক মুস্তাফা হায়দার সাইদ বলেছেন, চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চলমান ধারা বজায় রাখতে এবারের দুই অধিবেশনে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়। কোনো কোনো পর্যবেক্ষক বলছেন, এবারের দুই অধিবেশনে শব্দদূষণ হ্রাস, জলাভূমি রক্ষা, সংগঠিত অপরাধ দমনের মতো বিষয়গুলোও গুরুত্ব পাবে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর চায়না-আমেরিকা স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো সৌরভ গুপ্তা মনে করেন, এবারের দুই অধিবেশনে চীনের গণস্বাস্থ্য খাতের বিদ্যমান স্থিতিশীলতা ধরে রাখা ও আরও উন্নত করা এবং আগামী ১২ মাসের জন্য বিভিন্ন খাতের পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন অধিক গুরুত্ব পাবে। বস্তুত, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীনের ‘দুই অধিবেশন’ বাকি বিশ্বের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
চীনা গণরাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলন (সিপিপিসিসি)-র সৃষ্টি হয়েছিল ১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বরে। চীনা কমিউনিস্ট পার্টি দেশের অন্যান্য পার্টির সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিপিপিসিসি গড়ে তোলে। শুরুতে এর নাম ছিল ‘রাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলন’ বা পিসিসি। পরে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় সিপিপিসিসি। পরে প্রথম সিপিপিসিসি-তে ‘সাধারণ কর্মসূচি’ বা ‘কমন প্রোগ্রাম’ অনুমোদিত হয়। এই ‘সাধারণ কর্মসূচি’ই পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য চীনের ডি-ফ্যাক্টো সংবিধান হিসেবে কাজ করে।
প্রথম সিপিপিসিসি-র অধিবেশনই চীনের জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা, রাজধানী, রাষ্ট্রের নাম নির্ধারণ করে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রথম সরকার নির্বাচন করে। বস্তুত, ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত সিপিপিসিসি গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের ডি-ফ্যাক্টো পার্লামেন্ট হিসেবে কাজ করেছে। ১৯৫৪ সালে, চীনা সংবিধান অনুসারে, পার্লামেন্টের দায়িত্ব অর্পিত হয় জাতীয় গণকংগ্রেস (এনপিসি)-র ওপর। সেই থেকে সিপিপিসিসি অনেকটা দুই কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের ‘পরামর্শক উচ্চকক্ষের’ মতো দায়িত্ব পালন করে আসছে।
বর্তমান সিপিপিসিসি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে না; না সিপিপিসিসি নীতি নির্ধারণ করে। কিন্তু এটি এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্লাটফর্ম, যেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন সংগঠন, বিভিন্ন জাতির গ্রুপ, ও সমাজের বিভিন্ন মহলের প্রতিনিধিরা গণতান্ত্রিকভাবে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন ইস্যুতে মতবিনিময় করতে ও পরামর্শ দিতে পারে। কার্যত, সিপিপিসিসি’র সদস্যরা সরকার, পার্লামেন্ট, ও বিচার বিভাগের পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন; বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইস্যুতে পরামর্শ, সমালোচনা, ও প্রস্তাব তুলে ধরেন।
সিপিপিসিসি’র সদস্যরা আসেন সমাজের বিভিন্ন স্তর ও জাতিগোষ্ঠী থেকে। সিপিপিসিসি ক্ষমতাসীন দল চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি); অন্য ৮টি গণতান্ত্রিক পার্টি; বিভিন্ন গণসংস্থা, সংখ্যালঘু জাতি, ও পেশাদার গ্রুপ; হংকং, ম্যাকাও, তাইওয়ান, ও বিদেশফেরত চীনাদের প্রতিনিধি; এবং বিশেষভাবে আমন্ত্রিত ও নির্দলীয় ব্যক্তিবর্গ নিয়ে গঠিত।
সিপিপিসিসি’র ভূমিকা গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখ আছে। সেখানে বলা হয়েছে, সিপিপিসিসি চীনের ইতিহাসে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এবং ভবিষ্যতেও রেখে যাবে। এ ভূমিকা যেমন হবে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের স্বার্থে, তেমনি বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চীনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক জোরদারের স্বার্থেও।
সিপিপিসিসি চীনকে সমাজতান্ত্রিক আধুনিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করতে, চীনা জাতির পুনরুত্থানের মহান ‘চীনা স্বপ্ন’ পূরণে, ও শান্তিপূর্ণ একীকরণের মাধ্যমে বিশ্বের বুকে একটি মাত্র চীন প্রতিষ্ঠার মহান দায়িত্ব পালনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাবে। চীনে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে বহুদলীয় সহযোগিতা ও পরামর্শব্যবস্থা টিকে থাকবে এবং উন্নত থেকে উন্নততর হতে থাকবে।
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং একবার সিপিপিসিসি’র জাতীয় কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বৈঠককালে বলেছিলেন: “সিপিসি’র নেতৃত্বাধীন বহু পার্টির সহযোগিতা ও রাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলনের ব্যবস্থা চীনের মৌলিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা সিপিসি, চীনা জনগণ, বিভিন্ন রাজনৈতিক পার্টি ও নির্দলীয় ব্যক্তিবর্গের যৌথ উদ্যোগে সৃষ্টি হয়েছে, যা চীনের মাটিতে উন্নত নতুন ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা। এ-ব্যবস্থা আধুনিক চীনের বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এবং চীনা জাতির সহনশীলতা ও ‘অমিল পাশে রেখে মিল অন্বেষণ করার’ সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ। এটা মানবজাতির রাজনৈতিক সভ্যতায় চীনের গুরুত্বপূর্ণ অবদান।”
সিপিপিসিসি’র জাতীয় কমিটির সদস্যরা জাতীয় গণকংগ্রেসের অধিবেশনেও উপস্থিত থাকেন। তবে, সেখানে তাদের কোনো ভোটাধিকার নেই। জাতীয় গণকংগ্রেস (এনপিসি) চীনের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর সংস্থা। এনপিসি’কে বলা হয় ‘বিশ্বের বৃহত্তম পার্লামেন্ট’। এর সদস্যসংখ্যা প্রায় তিন হাজারের কাছাকাছি। অবশ্য এনপিসি’র সদস্যসংখ্যা তিন হাজারের বেশি হতে পারবে না। আইন অনুসারে এঁরা নির্বাচিত হন ৫ বছরের জন্য। চলতি বছর এনপিসি’র সদস্য আছেন ২৯৫১ জন। সম্প্রতি এনপিসি’র স্থায়ী কমিটি এ তথ্য জানায়।
এনপিসি’তে চীনের বিভিন্ন প্রদেশ, স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলসমূহ, কেন্দ্রীয় সরকারশাসিত বিভিন্ন শহর, চীনা গণমুক্তি ফৌজ, হংকং, ও তাইওয়ানের প্রতিনিধি থাকেন। বছরে একবার এনপিসি’র অধিবেশন বসে। তবে, এনপিসি’র স্থায়ী কমিটি প্রয়োজন মনে করলে বিশেষ অধিবেশন ডাকতে পারে। তা ছাড়া, এক-পঞ্চমাংশ বা তার চেয়ে বেশি সদস্য একসঙ্গে অনুরোধ জানালেও বিশেষ অধিবেশন ডাকা হতে পারে।
এনপিসি গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের কেন্দ্রীয় পার্লামেন্ট। এনপিসি দেশের জন্য আইন প্রণয়ন করার, সংবিধান সংশোধন করার, প্রেসিডেন্টসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়ার অধিকার প্রয়োগ করে। এ ছাড়াও, এনপিসি রাষ্ট্রের সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে এবং সরকারের কাজ সরাসরি তত্ত্বাবধান করে। এনপিসির একটি স্থায়ী কমিটি থাকে। এনপিসি যখন অধিবেশনে থাকে না, তখন রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয়ে স্থায়ী কমিটিই প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেয়।
চীন সমাজতান্ত্রিক দেশ। এই দেশে ক্ষমতাসীন দল হচ্ছে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি)। সিপিসি দেশের সকল রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন গণসংগঠন, বিভিন্ন সংস্থা, পেশাদার গ্রুপ, বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতি, বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রুপ ও গুরুত্বপূর্ণ নির্দলীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে পরামর্শের ভিত্তিতে দেশশাসনের নীতি মেনে চলে। একেই বলা হয়ে থাকে ‘চীনা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র’।
আজকাল চীনে ‘গোটা প্রক্রিয়ায় জনতার গণতন্ত্র’ (Whole-process People’s Democracy) টার্মটিও ব্যবহার করা হচ্ছে। চীনা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন এই গণতন্ত্রে তৃণমূল পর্যায়ে প্রতিজন প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষের ভোটাধিকার রয়েছে। ১৮ বছর বয়স হলেই চীনারা তৃণমূল পর্যায়ের প্রতিনিধি নির্বাচনে ভোট দিতে পারেন। তৃণমূল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা পরবর্তী স্তরের প্রতিনিধিদের নির্বাচন করেন, এই স্তরের প্র্রতিনিধিরা পরবর্তী স্তরের প্রতিনিধি নির্বাচন করেন, এবং এভাবে শেষ পর্যন্ত জাতীয় পর্যায়ের এনপিসি’র সদস্যরা নির্বাচিত হন।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)।alimulh@yahoo.com
এইচআর/এমএস